চলুন গাছ লাগাই
মোঃ সাব্বির হোসেন রানা
বদলেছে মানুষ, বদলেছে পৃথিবী, বদলেছে জলবায়ু। পরিবর্তনের এ অবিরাম যাত্রায় একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে এসে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব। যেখানে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বিগত দুই দশকের জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য করলেই আসন্ন সংকটের পূর্বাভাস পাওয়া যাবে। বইয়ে পড়া “সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ, সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁর গান, পাকা ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণ- এসব ই পাবেন একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে। কিন্তু, মাত্র কয়েক দশক পেরিয়ে এগুলো সব ই প্রায় হারিয়েছি।
টানা কয়েকদিনের প্রচণ্ড গরমে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় প্রচ- গরমে নাকাল হয়ে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষের জনজীবন। শ্রমজীবী মানুষ রয়েছেন চরম ভোগান্তিতে। গরমে গলে যাচ্ছে শহরের বেশ কয়েকটি পিচঢালা সড়ক। এরই মধ্যে প্রকট রোদ উপেক্ষা করেই যাত্রী বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন রিকশাচালকরা। সূর্যের তাপ এতই বেশি যে, খোলা আকাশের নিচে হাঁটলেও গরম বাতাস লাগছে চোখে-মুখে। যাত্রাপথে ছাতা মাথায় দিয়ে তাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন অনেকেই। স্বস্তি পেতে শ্রমজীবী মানুষ রাস্তার পাশে জিরিয়ে নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ হাতেমুখে পানি দিয়ে ঠান্ডা হওয়ার চেষ্টা করছেন। আর শিশুকিশোররা গরম থেকে রেহাই পেতে মাতছে জলকেলিতে।
সতর্ক থাকতে সারাদেশে ৩ দিনের জন্য হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। এদিন তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত শক্রবার (১৯ এপ্রিল) যশোরে তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত শনিবার যশোরে তাপমাত্রা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর চুয়াডাঙ্গায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তারা আরো জানিয়েছেন এ তাপদাহ আরও কিছুদিন বিরাজ করবে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি হওয়ায় অস্বস্তি বাড়বে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই এপ্রিল মাসে গড়ে সাধারণত দুই-তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ ও এক-দু’টি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে আরো জানা যায় গত ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ০.৫%। এমনকি ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা গড়ে ১.৪ক্ক সেলসিয়াস এবং ২১০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ২.৪ক্ক সেলসিয়াস বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে চরম ভাবে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির-(ইউএনডিপি) ‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণ’ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে অন্যান্য ঝুঁকির সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত ঝুঁকির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে শীর্ষে দেখানো হয়েছে। এছাড়াও ক্লাইমেট ভালনারেবল ইনডেক্স অনুযায়ী বিশ্বের ১৯২টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় একটি বলিষ্ঠ অভিযোজন পরিকাঠামো গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণতার ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম তিনটি ক্যাটাগরিতে ১২টি দেশের তালিকায় বন্যায় প্রথম অবস্থানে বাংলাদেশ, ঝড়ে দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ প্রথমে রয়েছে ফিলিপাইন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে দশম অবস্থানে। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে যে বিবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং ইতোমধ্যে পড়েছে তার মধ্যে রয়েছে বৃষ্টিপাত হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি, ঘূর্নিঝড়, জলোচ্ছাস, অতিঝড়, ভূমিকম্প সাহা নানা দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশ সহ দক্ষিন এশিয়ার দেশ গুলোতে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনার পাশাপাশি বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধন রোধ, কার্বন নিঃসরণ রোধ, শিল্পদূষণ রোধ, পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। তাছাড়া জনসেচতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণরোধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
এই তাপদাহ কিংবা রোদের প্রখরতা কমাতে আমাদের নিয়মিত সবাইকে গাছ রোপনে উদ্ধুদ্ধ হতে হবে। এখন আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে বেশী বেশী গাছ রোপন করা। বিভিন্ন সংগঠন বছরব্যাপি প্রতিটি সিজনেই চেষ্টা করে গাছ রোপনের। তবে করোনা যেভাবে মহামারি ভাইরাসের মত দেশকে আক্রান্ত করেছে ঠিক সেভাবে গাছ রোপন করে সঠিক পরিচর্যা’র মাধ্যমে যদি আক্রান্ত করা যেতো তবে দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ মোকাবেলা করতে পারতো। এর মাধ্যমে অতিতাপমাত্রা সহ বিভিন্ন দুর্যোগ লাগব হবে বলে মনে করি।
একটি দেশের আয়তন অনুযায়ী ঐ দেশের ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন সেখানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী একটি প্রতিবেদনে বলেন দেশের মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে বলে জানান।
পরিবেশমন্ত্রী আরো বলেন, ‘সরকারের এসডিজি এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২৫) বাস্তবায়নে বন অধিদপ্তর থেকে দেশব্যাপী বনাচ্ছাদন ও বৃক্ষাচ্ছাদনের পরিমাণ ২০২৫ সালের মধ্যে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ২ ও ২৪ শতাংশে উন্নীত করা হবে।
তাহলে আমরা বুঝতে পারি কত পরিমান বৃক্ষ আমাদের রোপন করা অতিব জরুরী। তবে এই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয় যদি না জনগন সহযোগিতা না করে। এজন্য স্বেচ্ছাসেবক থেকে শুরু করে নিজ নিজ পর্যায়ে গাছ রোপনে এগিয়ে আসতে হবে।
২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে একদিনে ২০ কোটির বেশি গাছ লাগিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলো ইথিওপিয়া এই কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। পূর্বে ২০১৬ সালে একদিন ৫ কোটি গাছ লাগিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলো আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। এছাড়াও স্বেচ্ছাসেবী অনেক সংগঠন বিভিন্ন রেকর্ড গড়েছেন। ২০১৫ সালে ভুটানের একদল স্বেচ্ছাসেবক এক ঘণ্টায় ৪৯ হাজার ছয়শো ৭২টি গাছ লাগিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছে। পূর্বে এই রেকর্ড করেছিলো ভারত।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে ও দেশের এই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনে গাছ রোপনের বিকল্প নেই। তবে তা পরিকল্পিত ভাবে রোপন করতে হবে। তাই সরকারি কিংবা সামাজিক সংগঠন কিংবা ব্যক্তি পর্যায় চলুন গাছ রোপন করি। দেশের অনেক সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবকরা বিশেষ ইভেন্ট এর মাধ্যমে প্রতি সিজনে বৃক্ষ রোপন করে আসছে। গাছ রোপন আজ যদি শুরু না করেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। পরিবেশের বিপর্যয় থেকে দেশবাসীকে রক্ষার জন্য বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। এজন্য বৃক্ষের মধ্যে ছিল তাল গাছ, হরীতকী, বহেরা, অর্জুন, নিম, কৃষ্ণচূড়া, শিউলি, আমলকী, কাঁঠাল, জলপাই, বাদাম, মেহেগনি, রেইন্ট্রি, চাম্বল ইত্যাদি রোপন করা যেতে পারে। পাশাপাশি ছাদকৃষিতেও নজর দিলে নিজ নিজ ভবন অতিরিক্ত তাপদাহ থেকে রক্ষা পাবে। তবে যত্রতত্র গাছ লাগিয়ে রেকর্ড করলেই হবেনা। গাছ রোপন শেষে করতে হবে সঠিক পরিচর্যা। সঠিক পরিচর্যা না পেলে গাছ গুলো বৃদ্ধি পাবে না। তাই গাছ রোপনে করে পরিচর্যায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
প্রকৃতি আল্লাহর দান হলেও এই প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা আমাদের দায়িত্ব। পরিবেশের অন্যতম অবধারক হলো উদ্ভিদ ও গাছপালা। আমাদের জীবনধারণ ও জীবন রক্ষার সব উপকরণই পাই গাছগাছালি, বৃক্ষতরু ও লতাগুল্ম থেকে । প্রিয় নবীজি (সা.) নিজ হাতে গাছ রোপন করেছেন, সাহাবীদের গাছ লাগাতে ও বাগান করতে আগ্রহী করে তুলতেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক বনায়নও করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃক্ষরোপণকে সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ, পাখি বা পশু যখন তাদের আহার্য গ্রহণ করে, তখন তা তার (রোপণকারী) পক্ষে একটি সদকা (দান) হিসেবে পরিগণিত হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করল, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর বিনিময়ে তাকে এই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিফল দান করবেন।’ (মুসনাদে আহমদ)। গাছের প্রতিটি পাতা আল্লাহর জিকির করে। সেই জিকিরের সওয়াব রোপণকারীর আমলনামায় লেখা হয়।
তাই আমাদের বেশি করে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন করা জরুরী। গাছ লাগাতে হবে, গাছের পরিচর্যা করতে হবে এবং অকারণে বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে একটি পরিপক্ব গাছ কাটার আগে তিনটি চারা গাছ লাগাতে হবে।