শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

বাংলাদেশে রাজনীতির সংস্কার

 মনসুর আহমদ

রাজনৈতিক সংস্কার রাষ্ট্রচিন্তার একটি খ-িত অংশ। রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া  রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসের মতো বহু পুরাতন। মানুষ যেদিন থেকে রাষ্ট্র সংগঠনের সদস্য হিসেবে জীবন যাত্রা শুরু করেছে, সেদিন থেকেই  মূলত রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ। রাষ্ট্রের উন্মেষ কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কালের বিভিন্ন স্তরে মানুষের জন্য কল্যাণ রাষ্ট্র উপহার দেয়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রচিন্তায় বিভিন্ন সংস্কার সাধিত হয়েছ, বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তা জন্ম নিয়েছে। প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রচিন্তায় অবদান রেখেছেন সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিস্টটল প্রমুখ। তাঁদের রাষ্ট্রচিন্তায় সংস্কার এসেছে মধ্যযুগের সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট টমস একুইনাস,  মার্সিলিও প্রমুখ চিন্তাবিদদের গির্জা প্রভাবিত ধর্মীয়  বিশ^াস নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রদর্শন ও রাজনৈতিক আদর্শ উপস্থাপনার মাধ্যমে।

শিল্পবিপ্লোবত্তর কালে ধর্মপ্রভাবিত রাষ্ট্রদর্শনের সংস্কার সাধিত হলো। রাষ্ট্র দর্শনে এলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, ভৌগলিক জাতীয়তাবাদ, ভোগবাদ, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রভৃতি। মেকিয়াভেলী, টমাস হবস, জন লক, রশো, মন্টেস্কু প্রমুখ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ কণ্যাণময় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে হাজির হলেন। 

 দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধোত্তর কাল থেকে অদ্যাবধি রাষ্ট্রচিন্তায় পূর্বকাল সমূহের রাজনৈতিক দর্শন ও অদর্শে সংস্কার এল। সেখানে বিশ^মানব সমাজ স্থান করে নিল উদারনৈতিক গণতন্ত্রের উত্থান পতন, মানবতাবাদ, মানবাধিকার প্রভৃতি । কিন্তু বিভিন্ন স্তরে রাজনৈতিক চিন্তার সংষ্কারের পরেও এটাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, রাষ্ট্রচিন্তার সেসব বিষয় মানবতার কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ হয়েছে। গণতন্ত্রের উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে কল্যাণময় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। 

বৈশি^ক রাজনৈতিক সংস্কারের যে ফসল গণতন্ত্রের উত্থান -পতন সে সংস্কারের তরঙ্গাঘাত হেনেছে বাংলাদেশের সমাজতটে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা; যার সাথে সংযোগ ঘটে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রবাহিত উষ্ণ রুধির ধারা স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বাধীনতার জন্য প্রবাহিত রক্ত কণার মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়েছিল সে সময়ের রাষ্ট্রযন্ত্র। সে সময়ের  শাসকগোষ্ঠী গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে পরবর্তীতে একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। কিন্তু প্রশাসন সহ  রাষ্ট্রের বিভিন্নস্তরে লুকিয়ে থাকা দুর্ণীতিবাজদের কারণে তাতে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে কয়েকটি সরকার ক্ষমতায় এল। কিন্তু এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের স্বাদ  উপভোগ করতে ব্যর্থ হয়েছে যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তাদের রাষ্ট্রদর্শন ছিল ভুলে ভরা । যে কারণে  দেশময় চলছিল অশান্তি, অবিশ^াস, হানাহানি, পরশ্রীকাতরতা ও জিঘংসার তা-ব নৃত্য। দেশের এমন এক অরাজকতাময় পরিবেশে দেশে বহাল হয়েছিল কেয়ারটেকার সরকার। কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি পাল্টে রাষ্ট্রে পুনরায় চালু হলো পুরাতন আদলের গণতন্ত্র প্রথা। 

রাজনৈতিক অঙ্গনের কোলাহল আর থামছে না। আজ তাই রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন ভাবনার উদ্ভব হয়েছে-রাজনীতির সংস্কার প্রয়োজন। দুর্ণীতিবাজ রাজনীতিবিদদের হিং¯্র কবল থেকে বাংলাশেকে রক্ষার জন্য রাজনৈতিক দলমূহের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের চিন্তা জাগ্রত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে রাজনৈতিক দল সমূহের সংস্কার সাধনের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ নিয়মনীতি  ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে  এ দেশ একটি দুর্ণীতিমুক্ত কল্যাণময় রাষ্ট্রে রূপ নেবে। 

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ রাজনীতির সংস্কারের চিন্তা করছে। তাদের সংস্কার পরিকল্পনা জাতির কাছে স্পষ্ট নয়। রাজনৈতিক আদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শনের সংস্কার ব্যতিত শুধুমাত্র কর্মপদ্ধতির পরিবর্তন দ্বারা দেশের কোন মঙ্গল হবে না। কিন্তু সংস্কারের নামে চলছে  বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভাঙন, কাদা ছোড়াছুড়ি। আদর্শ ও দর্শন পরিশুদ্ধি বিবর্জিত রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে এ  দেশ কি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হবে?  উত্তর মাত্র একটি- না। 

ক) রাজনৈতিক আদর্শ বলতে কী বুঝায়? M.N Hagopian -Gi g‡Z ivR‰bwZK Av`k© n‡jv A programmatic and theoretical application of some grandiose philosophical system which arouses men to political action and may povide strategic guidance for that action.  - রাজনৈতিক আদর্শ হলো সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিচালনার মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের বিন্যাসিত সংহতিপূর্ণ কোন রাজনৈতিক অভিপ্রায়। এ মতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে বাংলাদেশের বর্তমান বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলির  কোনটিরই  দেশকে দুর্নীতিমুক্ত ও কল্যণময় রাষ্ট্রে পরিণত করার বিন্যাসিত ও সংহতিপূর্ণ কোন অভিপ্রায় নেই। তাদের রয়েছে শুধু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে ব্যক্তি ও পরিবারের  আর্থিক ও মর্যাদার  উন্নতি সাধন, যা সম্প্রতিক কালের বিভিন্ন ঘটনাই প্রমাণ করছে। 

খ) আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে পুরোপুরি সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি। যারাই ক্ষমতায় আছেন এবং ভবিষ্যতে আসবেন বলে আশা পোষণ করেন তারা কেবলমাত্র আইনের মাধ্যমে দেশে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসী। কিন্তু তারা ভুলে যান যে, রাষ্ট্র শুধুমাত্র আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানই নয়। এটি মানুষকে সার্বিক ভাবে সুরক্ষিত রেখে তার পরিপূর্ণতার দিকে পরিচালিত করে। মানুষের কল্যাণ ও পুর্ণতার দিকে পরিচালিত করবার তেমন কোন ধারণা ও  ইচ্ছা বৃহত্তর দলগুলির মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাই এইসব লোক ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্র দুর্নীতি ও কল্যাণময় হবে এমন আশা করা অযৌক্তিক।  কল্যাণময় রাষ্ট্র  পেতে হলে যে দল বা যেসব দল মানুষকে সার্বিক পূর্ণতার দিকে  পরিচালিত করার কর্মসূচি প্রদান করে তাদেরকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে হবে। 

গ) ন্যায়তত্ত্ব বিবর্জিত রাজনীতি : ন্যায়তত্ত্ব কল্যণের মূল ভিত্তি। প্লেটোর মতে, ‘ ন্যায়তত্ত্ব হলো এমন একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জাতি চারিত্রিক পূর্ণতা লাভ করতে পারে। সত্য ও সুষ্ঠু জীবন বিকাশে এর গুরুত্ব প্রভুত।’  কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চারিত্রিক পূর্ণতা অর্জনের  কোন কর্ম পদ্ধতি নেই। যে কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা কর্মীরা সহজেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। প্লেটোর মতে ন্যায়তত্ত্ব ও আদর্শ রাষ্ট্র এর সম্পর্ক পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। প্লেটোর এ মতটি একটি সর্বজন স্বীকৃত মত। তাই ন্যায়তত্বে¦র চর্চা না করে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের নামে তাদের রাজনীতির বাহ্যিক কাঠামোতে যতই চমকপ্রদ পরিবর্তন ঘটাক না কেন তাতে রাষ্ট্রের কোন কল্যণ বয়ে আনবে না। 

 তাই আজ যারা রাজনীতিতে সংস্কারে আগ্রহী তাদেরকে বিশ^াস করতে হবে যে, উপর্যুক্ত তিনটি ধারণা পরিত্যাগ করে যে সংস্কার তারা আনতে আগ্রহী তা কুসংস্কার ব্যতিত কিছু নয়। তাই সংস্কারের নামে কুসংস্কারে না জড়িয়ে দেশটিকে দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণময় রাষ্ট্র গঠনের  লক্ষ্যে রাজনৈতিক আদর্শকে পরিশুদ্ধ  করা, দলে ন্যায়তত্ত্বের চর্চা ও দেশের মানুষকে মানবিক গুণাবলীর পূর্ণতার দিকে পরিচালিত করার কর্মপন্থা গ্রহণ করা দরকার। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ