শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

ইসলামী ব্যাংকিং ও মরহুম মুহাম্মদ ইউনুছ

 দিদারুল আলম মজুমদার

ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং এ আমি যে মুহাম্মদ ইউনুছের অবদানের কথা লিখছি তিনি ফেনীর নিভৃত পল্লী ছাগলনাইয়ার চম্পকনগর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী মুহাম্মদ ইউনুছ, যিনি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে পারিবারিকভাবে ইসলামী অনুশাসনের উপর ভিত্তি করে বেড়ে উঠেছেন। ছাত্র জীবনে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তিনি এ পথে আরও সমৃদ্ধ হয়েছেন। আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন বলে কুরআনে বর্ণিত নির্দেশের আলোকে তিনি তার ব্যক্তি জীবন ও পরিবারকে তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করেছেন।

সুদ এমন একটা জিনিস যার থেকে নিজে নিজে বাঁচতে চাইলেও সমাজ ও রাষ্ট্রে সুদের কারবার থাকলে তা থেকে বেঁচে থাকা দুষ্কর। কারণ আমাদের জীবন চলার পথে অনেক লেনদেন থাকে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে। নিজের পোশাক আশাক খাওয়া দাওয়াসহ সকল ব্যবহারিক বিষয়াশয় মিলিয়ে যে রিজিকের ব্যবস্থা হয় তার সাথেই হক হালাল জড়িত। দৈনন্দিন-জীবনে আয় রোজগার এবং খরচের সাথে হালাল হারাম জড়িত। আমরা মানুষ হিসেবে চালাক হওয়ার কারণে দুনিয়ার জীবনে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে বসি এবং পার পেয়ে যাই। যা মুনকার নাকিরের কারণে আল্লাহর সাথে করা যাবে না আবার ইয়াওমুল হাশরে যখন চোখ হাত-পা নিজেই কর্মফলের সাক্ষী দেবে তখন অন্য কাউকে দায়ী করে নিজের দায়িত্ব এড়ানো যাবে না। রাসুল (সা.) বলেছেন তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল এবং এই দায়িত্ব-কর্তব্য দিয়ে তোমাদের সকলকে জবাবদিহি করতে হবে। আমরা বলে থাকি যে যত বড় জামা পড়ে থাকি, সে তত বেশি সুদের কারবারে জড়িত। কারণ হিসেবে উল্লেখ করি, যে গার্মেন্টসে উক্ত জামা কাপড় তৈরি হয়েছে ওই গার্মেন্টস ব্যাংক লোন নিয়ে চলছে বিধায় সেখানে সুদ জড়িত আছে। 

আর আমি একজন মাওলানা হয়ে সুদের বিরুদ্ধে ওয়াজ করেও বেশি সুদে জড়িত লম্বা কাপড়ের তৈরি জুব্বা পড়ে যাচ্ছি। তাহলে এই জুব্বার কারণেও আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তবে আমি সুদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে যত দূর সম্ভব জনমত তৈরি করেছি। যা রাষ্ট্রের উপর চাপ হিসেবে পরিগণিত হবে এবং রাষ্ট্র আইন করে সুদ বন্ধ করবে বলে আশা করি। এই ধরনের কর্মসূচির ফলে আমরা আল্লাহর কাছে জবাবদিহি থেকে হয়তোবা বেঁচে যেতে পারি, না-হয় আল্লাহর পাকড়াও থেকে কোনভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এই প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে মরহুম মুহাম্মদ ইউনুছ ছিলেন সোচ্চার ব্যক্তি। যার প্রচেষ্টায় এই উপমহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

অনেকে ধরণা করে থাকেন ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত যে কোন একটি ব্যাংকের মতোই। আসলে কি তাই? কেউ জবাব দিয়ে থাকেন- সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল,  রাসূল (স:) এর হাদিস দিয়ে বলে থাকেন বিসমিল্লাহ বলে মুরগি জবাই দিলে হালাল হবে এবং বিসমিল্লাহ ছাড়া জবাই দিলে হারাম হবে। উপরোক্ত বিষয় সত্য এবং তার উপর আমল করা অবশ্যই কর্তব্য। তবে এই নিয়ত এবং বিসমিল্লাহির সাথে আরও বহু আমল বা কাজ যুক্ত হবে যা ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই আমাকে আপনাকে অনেক সংযত হয়ে এবং আল্লাহ প্রেরিত কুরআন এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) এর হাদিস পাঠের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান থেকে বাস্তবে কাজ করে যেতে হবে।

আরেকটি কথা হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংক গুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারের নির্দেশিত পথেই চলছে, যাতে লাভ লোকসানের অংশীদারিত্বের কোন নমুনা নেই বলে যে অভিযোগ রয়েছে তা কিন্তু ঠিক। তবে ব্যাংকের প্রাথমিক পর্যায়ে লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্ব ওপেন থাকাতে আমরা বাংলাদেশের মানুষ যাতে সবাই লোকসান দেখিয়ে উত্তর ব্যাংকে দেউলিয়াত্বের দিকে নিচ্ছিলাম তখনই সরকারি নীতির পাশাপাশি ব্যাংকটি এক্ষেত্রে কঠিন অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়েছে। তাই এখন যাচাই বাছাই করেই লাভ লোকসানের উপর বিষয়টি ব্যাংকের অবস্থান ঠিক রেখে তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এতে যিনি সুবিধা পেয়েছেন তিনি প্রশংসা করে যাচ্ছেন, আর যিনি কোন ধরনের সুবিধা পায়নি তিনি হরহামেশা এই ব্যাংকিং এর সমালোচনা করে যাচ্ছেন, আর বলছেন কিসের ইসলামী ব্যাংক, এটি অন্যান্য ব্যাংকের চাইতে আরো বড় ডাকাত। তাই ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয়ে আরো ভাবতে হবে এবং ইসলাম উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিশ্বে ব্যাংক ব্যবস্থা অনেক পুরোনো হলেও শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার আবির্ভাব পুরোনো নয়। আধুনিক পৃথিবীতে ১৯৫০ সালের শেষ দিকে পল্লী এলাকায় একটি স্থানীয় ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানে প্রথম একটি ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ সফল হতে পারেনি। মিসরের রাজধানী কায়রো থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে নীল নদের বদ্বীপ ’মিটগামারে’ ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সেভিংস ব্যাংক, যা আধুনিক বিশ্বেও প্রথম আনুষ্ঠানিক ইসলামিক ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত। একে মিটগামার ব্যাংক বলা হয়। 

ড. আহমদ নাজ্জার ছিলেন এ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৩-৬৭ সাল পর্যন্ত শুধু মিসরেই ৯টি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সবকটি ইসলামি ব্যাংক বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। ১৯৭১ সালে কায়রোতে প্রথম ইসলামী ব্যাংক হিসেবে ‘নাসের সোশ্যাল ব্যাংক’ পুনরুজ্জীবিত হয়।

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে মুসলিম দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে নিজ নিজ দেশে অর্থনীতি ইসলামিকরণের যে সিন্ধান্ত নেয়া হয়, দেশে দেশে ইসলামি ব্যাংক গঠন তারই ফলাফল। (চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ