কবি হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ
আবির সাকিব
“আত্মপ্রকাশের বেদনা হলো তারুণ্যের বেদনা।” এই তারুণ্য কেবলই যে বয়সের ক্ষেত্রেই হবে তা কিন্তু নয়। যে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের প্রথম প্রকাশলগ্নকেও আমরা বলতে পারি সৃষ্টির তারুণ্য। অন্যান্য সৃষ্টিশীল মানুষের মতোই একজন কবি যখন প্রথম কবিতা লেখা শুরু করেন তখন আত্মপ্রকাশের বেদনা তাকেও তাড়িত করে। নিজের এই সৃজনকর্মটি পাঠক খোঁজে, যা তার ষ্টির অনুপ্রেরণা হবে, প্রাসঙ্গিক পরামর্শ দেবে। কবির আত্মপ্রকাশলগ্ন থেকেই নানান কাব্য নির্দেশনা মেনে অতি সচেতনভাবেই কাব্যরচনায় ব্রতী হতে হয়।
কবিতা প্রকাশের মাধ্যম যুগে যুগে নানান ভাবে হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে পত্রপত্রিকার পাশাপাশি ফেসবুকও হয়ে উঠেছে কবিতা প্রকাশের অন্যতম একটি মাধ্যম। পত্রপত্রিকার লেখাগুলো সম্পাদকের হাত হয়ে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন হয়ে এলেও ফেসবুকের লেখায় তা অনিকেত থাকছে। তাই শুধুমাত্র ফেসবুকভিত্তিক সাহিত্য চর্চা করাটা একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবির কখনোই একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ নয়, বরং সাহিত্য প্রচার ও প্রসারের জন্যে তাকে প্রত্যেকটি গ্রহণযোগ্য মাধ্যমেই বেশি বেশি দাপিয়ে বেড়াতে হবে।
এই লেখাটির শুরুতেই আমি কবি আল মাহমুদের ‘দিনযাপন’ গ্রন্থ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়েছি যে, ‘আত্মপ্রকাশের বেদনা হলো তারুণ্যের বেদনা।’ একই বিষয়ে কবি শামসুর রাহমান তার ‘কবিতা এক ধরনের আশ্রয়’ প্রবন্ধে লিখেছেন : ‘মূলত আত্মপ্রকাশের তাগিদে কবি কবিতা লেখেন।’ হ্যাঁ, এই আত্মপ্রকাশের বেদনা কবিদের ভিতরেই সবচেয়ে বেশি কাজ করে। বিখ্যাত কবি রবার্ট ফ্রস্ট তাই জুতোর সুখতালিতেও কবিতা লিখেছেন। আমরাও নানাভাবে এই লেখ্যকাজটি সম্পন্ন করে থাকি। তাবে কবিতাটি কোথায় লিখলাম, কতটা সময় নিয়ে লিখলাম, এগুলো অবশ্য মুখ্য বিষয় নয়, বরং মুখ্য বিষয় হচ্ছে : আমি কিংবা আপনি শুরু থেকেই নিজের লেখালেখিতে কতোটা যতœবান, সচেতন, কিংবা বছরের পর বছর কবিতা লিখলেও আমাদের অভিজ্ঞতার ভাড়ারে কতটা চৈতন্যে ফিরলাম।
এই লেখাটির বিষয় শিরোনামের সাথে সঙ্গতি রেখে এখানে আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে নিজস্ব কিছু কিছু অনুসরণীয় বিষয় তুলে ধরতে চাইÑÑÑ
১) কবিতার প্রাথমিক এবং মৌলিক বিষয়গুলো জানা এবং তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্রমেক্রমে সিদ্ধহস্ত হওয়া।
২) নিজের লেখাটি সম্পন্ন হলে বারবার তা পড়া। এই পড়াকালীন সময়ে নিজের কানকে বোদ্ধা পাঠকের আসনে রেখে বারবার নিজের কবিতাটি কাটাছেঁড়া অব্যাহত রাখা, যতক্ষণ না আপনার কর্ণকুহর হয়ে মন তৃপ্তি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে উপযুক্ত কারও পরামর্শ নিতে কখনো লজ্জা পেলে চলবে না।
৩) ব্যাপকভাবে অগ্রজ কবিদের কাব্যগ্রন্থ এবং কাব্যসংক্রান্ত প্রবন্ধ ও নিবন্ধের বই, সাময়িকী, সাহিত্য পত্রিকা. ইত্যাদি ব্যাপকভাবে পড়াকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করা। অতঃপর পাঠ-পরবর্তী অভিজ্ঞতাকে সচেতনভাবে নিজের লেখালেখিতে কাজে লাগানো।
৪) কবিতাকে পাঠকের মনে স্থান দেওয়ার কৌশল অনুধাবন, উদ্ভাবন করে তা প্রয়োগ করা। কেননা পাঠক বিমুখ কবিতা লেখাটা কেবলই মৃত সন্তান প্রসব করারই নামান্তর।
৫) শব্দ প্রয়োগে চৌম্বকত্ব, কিছুটা নতুনত্ব যেমনটা অন্যেরা লিখেন না ভাবখানা এমনটাই হওয়া চাই।
৬) খুবই জীবনঘনিষ্ঠ উপমা, চিত্রকল্প, রূপকল্প... ইত্যাদি সচেতনভাবেই প্রয়োগ করা। কবিতার শরীরে নিজের জীবনের ঘটনাপ্রবাহের কাব্যিক নির্মাণ এমনটা হওয়া উচিত যেন, সেই যাপিত জীবনের ঘটনানিচয় কবির নিজের হলেও পাঠক যেন তা পড়ে মনে করবেনÍ ‘এটা তো আমারই কথা, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনারই বয়ান কিভাবে করলেন কবি!’
৭) কবিতা থেকে মেদ কমিয়ে ফেলে মূল কথাগুলো তুলে এনে কবিতাকে মার্জিত বলয়ে রাখা।
৮) কবিতায় আলোআঁধারি থাকলেও তা যেন অন্তত একশ্রেণির পাঠকের কাছে হলেও বোধগম্য হয়। কেন না এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে, কবিতা হলো কবি এবং পাঠকের ভাবনা- বিনিময়ের মাধ্যম।
৯) বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলো যতটা সম্ভব সমকালীন কবিতায় এড়িয়ে চলা আবশ্যক, কেননা এটিকে অনেক গুণীকবি অবক্ষয়ের লক্ষণ বলেছেন। আমাদেরকে এ বিষয়টির গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে কবি আল মাহমুদ তার ‘কবির কররেখা’ গ্রন্থের ১৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘..... যখন একটা আধুনিক কাব্যভাষার শব্দরাজি ব্যবহৃত হতে হতে জরাজীর্ণ ও দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে তখন এর হাত থেকে কবিদের পরিত্রাণের পন্থা উদ্ভাবন করা উচিত।’ কালে কালে প্রকৃত কবির হাতেই পুরাতন শব্দ-ভাবনার মধ্যে দিয়েই শব্দের নতুন পরিবর্তন ঘটে।
কবিতায় পুরানো শব্দ প্রয়োগের এই বিষয়টিকে আমলে নিয়ে, ধীরে ধীরে নিজস্ব লেখায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে স্বকীয় কবিতা নির্মাণে শ্রম দেওয়া আবশ্যক মনে করি। তবে এ বিষয়ে তর্কবিতর্ক কিংবা নাক বাঁকানোর আগে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের কথাগুলোও স্মরণে রাখতে অনুরোধ করবো, আর তা হচ্ছে “কবিতার যিনি প্রকৃত মহাজন, চাইলে তিনি পুরানো শব্দকেও ঘষে-মেজে নতুন হাটে অ্যান্টিকের উচ্চমূল্যে চালাতে জানেন। কিন্তু আনাড়িদের হাতে পড়লে একই যাত্রায় উল্টো ফল ঘটে। আজকাল ঐতিহ্যে ফেরার নামে অনেকেই সেই উল্টোটিই ঘটাচ্ছেন। তত্ত্ব-প্রণোদনায় কবিতা লেখার এটি একটি নতুন দায়।” (কবিতা ও পোস্টমডার্নিজম । আবু হাসান শাহরিয়ার)।
১০) প্রতিষ্ঠিত তিন ছন্দ যথা অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত ছন্দে বেশি বেশি কবিতা লিখার চর্চা করা আবশ্যক। কেননা ছন্দ জানা কবিরাই স্বেচ্ছাচারী কাব্য রচনা থেকে সহজেই বেরিয়ে আসার রাস্তাটা খুঁজে পান। আর কাব্যজগতে প্রতিষ্ঠিত সত্যিটা এই যে, ছন্দ জানা কবিরাই ভালো গদ্য কবিতা লিখেছেন এবং লিখছেন। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে সাহিত্যে ছন্দের পরিধি কিন্তু আরও ব্যাপক। আর এই ছন্দ মানার ব্যাপারেও কিন্তু কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি সতর্কবানী সবসময় আমাদের সামনে রাখা জরুরি, সেই বানীটি হচ্ছে : ‘ছন্দ জানা ভালো কিন্তু এর দাসত্ব করা ভালো নয়।’
১১) কোনো গুষ্ঠী বা দলের বলয়ে না থেকে ক্রমশই নিজের সাহিত্য কর্মকে সর্বজনীন করার চেষ্টা অব্যাহত রেখে নিরলসভাবে কাব্য সৃষ্টি করে যাওয়া।
১২) সবযুগেই কুম্ভিলক বা কবিতা চোরেরা কবির বারা ভাতে ছাঁই দিতে গিয়ে শেষতক নিজেরাই অস্তমিত হয়েছেন, কেননা কাব্যসৃষ্টিতে নিজের ঝোলার মধুটাই সব। অন্তত সাহিত্যে অন্যের ধনে পোদ্দারি চলে না। তাই আসুন নিজের সৃজনশীলতা দিয়েই আমরা যার যার কাব্য সাজাই। চৌর্যবৃত্তি কখনোই যেনো আমরা মাথায় না আনি।
সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখাটির ইতি টানতে চাইছি। তিনি লিখেছেন : “ কবিতার প্রথম কাজ পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করা, দ্বিতীয় কাজ সময়কে ধারণ করা, তৃতীয় কাজ পুরনো কবিতা থেকে উত্তরণ।” এই মহার্ঘ নির্দেশনাগুলো মেনে আমাদের সবাইকে লেখালেখির শুরু থেকেই অত্যন্ত যতœবান হওয়া জরুরি। সেইসাথে সাহিত্য নির্মাণকলার অন্যান্য নিয়ামকগুলো অবলম্বন করে কাব্য রচনায় আমাদের ব্রতী হওয়া আবশ্যক। আর আমরা তা করতে পারলেই আখেরে কাব্যপ্রতিভার সুফল গোলায় তুলতে পারবো।