রবিবার ১২ মে ২০২৪
Online Edition

জালেমের পরিণতি

তৌহিদুর রহমান 

এই পৃথিবীতে যার যা প্রাপ্য বা অধিকার তাকে সেই প্রাপ্য বা হক থেকে বঞ্চিত করার নামই ‘জুলুম’। ইনসাফবিরোধী কাজ করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, কারও অধিকার হরণ করা, বিনা অপরাধে মানুষের ওপর হামলা করা, নির্যাতন চালানো, কাউকে শারীরিক, আর্থিক, মানসিক ও মান-সম্মানের ক্ষতিসাধন করা, কারো উপর নৃশংসতা চালানো, অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ দখল করা, অশ্লীল ভাষায় কাউকে গালি দেয়া, কাউকে যন্ত্রণা দেয়া সবই জুলুমের পর্যায়ভুক্ত। এভাবে অন্যায়, অবিচার করে যারা মানুষের হক নষ্ট করে তারা ‘জালেম’।

আমরা বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ইসলাম কখনোই শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব কোন ধর্ম নয়। ইসলাম জীবন পরিচালনার একটা সিস্টেম। এটা একটা পরিপূর্ণ জীবন বিধান। অন্তত কয়েক শতক ধরে ইসলাম যে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতিÑ তা নিয়ে সারা দুনিয়ায় অহরহ আলোকপাত করা হচ্ছে। কিন্তু অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, ইসলাম বিদ্বেষী, ধর্মব্যবসায়ী, স্বার্থান্বেষী মুসলমানের কর্ণকুহরে তা যেন কিছুতেই প্রবেশ করছে না! অতএব, যা হবার তাই হচ্ছে, পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদিতে আজ একচেটিয়া আধিপত্য মুসলিম বিদ্বেষীদের। রাষ্ট্র চালাচ্ছে আজ তথাকথিত সেক্যুলার ধর্মব্যবসায়ীরা। জ্ঞান-বিজ্ঞান আজ ইহুদি-নাসারা ও মুসলিম বিদ্বেষীদের হাতে। সমগ্র সমাজ পরিচালনা করছে আজ তথাকথিত প্রগতিবাদীরা! সাম্রাজ্যবাদ, সমাজবাদ, সেকুলারবাদ, পুঁজিবাদ আজ মুসলমানদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে টেনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে। রাষ্ট্র এখন জুলুমতন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে মানুষের সব ধরনের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। মানুষের জন্য রাষ্ট্রের জন্ম, রাষ্ট্রের জন্য মানুষের জন্ম হয়নি। মানুষের প্রয়োজনেই মানুষ রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলেছে। একমাত্র মানুষের কল্যাণের জন্য একটা সিস্টেম গড়ে তোলা হয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমে। অথচ সেই রাষ্ট্রই আজ জুলুমতন্ত্রের সর্বনিকৃষ্ট হাতিয়ার। সারা দুনিয়াতে এমন একটা রাষ্ট্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে কোন প্রকার জুলুম চলছে না! জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সেই জনগণের উপরই ভয়াবহ নির্যাতন চালায় জালেমরা, শাসকরা। 

কিন্তু ইসলামে সব রকমের অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন করা নয়Ñ এ সমস্ত অন্যায় কাজে সহযোগিতা করাও ইসলামে হারাম করা হয়েছে। তাছাড়া জালিমদের সাথে সম্পর্ক রাখাও ইসলামে হারাম করা হয়েছে। মানুষের ওপর অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন এমনই এক মারাত্মক অপরাধ যার কারণে দুনিয়ার জীবনেই এর শাস্তি কোনো না কোনোভাবে মানুষ পেয়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষী অসংখ্য শাসক দুনিয়াতে সীমাহীন জুলুম করার শাস্তি এই দুনিয়াতেই ভোগ করে গেছেন। হাজার হাজার শাসককে অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন করার কারণে মজলুমের হাতে জীবন দিতে হয়েছে।   

শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি ও প্রাণীর ওপরও জুলুম করা হারাম। জুলুম একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ। আমরা এখানে জুলুম, জুলুমের পরিণাম, জুলুম থেকে বাঁচার উপায় ও কারও প্রতি জুলুম করে থাকলে দুনিয়াতে করণীয় কী সে সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আমরা অনেকে পরহেজগার হিসেবে সমাজে বেশ পরিচিত হলেও অন্যের ওপর জুলুম-নির্যাতন করার ক্ষেত্রে অজ্ঞ জালেমের চেয়ে কোন দিক থেকে কম নই। বিশেষ করে দুর্বল মানুষের ওপর, প্রকৃত ধার্মিকদের ওপর, অসহায়দের ওপর জুলুম করাকে আমরা অনেকে অন্যায় মনে করি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জালেমরা জুলুম করে কৌতুক ও আনন্দ অনুভব করে। মনে রাখা জরুরি যে, জুলুম এমন এক মহাপাপ যা সাধারণত আল্লাহ কখনো ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত যার ওপর জুলুম করা হয়েছে সে যদি জালেমকে ক্ষমা না করে। প্রকৃত ধার্মিকদের আরও মনে রাখতে হবে, শুধু নামায, রোযা, হজ, যাকাতের নাম ধর্ম নয়। সমস্ত ভালো কাজ পালন করা এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার নাম হচ্ছে ধর্ম। সাথে সাথে ভালো কাজের জন্য উপদেশ দেয়া আর অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখাও ধর্ম। এর অর্থ হচ্ছে কুরআন ও হাদিসের ভালো কাজের আদেশগুলো শুধু মেনে নিলে বা মেনে চললেই ধর্ম পালন করা হবে না, এর পাশাপাশি কুরআন ও হাদিসের নিষেধগুলোও বর্জন করতে হবে।

আল্লাহ বলেন, ‘কিছু লোক এমন আছে যারা বলে আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি, আসলে তারা ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দেয় এবং আসলে তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না। কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না। (সূরা বাকারা, আয়াত ৮,৯)। মহান আল্লাহর এ ঘোষণা সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। কিভাবে একজন মানুষ আল্লাহর বান্দা হিসেবে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত প্রদান করে আবার সেই একই মানুষ অহরহ অন্যের হক নষ্ট করে, অন্য মানুষের অত্যাচার জুলুম নির্যাতন চালায়! মানুষ নিজেই আল−াহর সৃষ্টি হয়ে আল্লাহর অন্য সৃষ্টির ওপর জুলুম করবে এ অধিকার আল্লাহ মানুষকে দেননি?

জুলুমের ভয়াবহতা সম্পর্কে কুরআন-হাদিসে অসংখ্য বর্ণনা আছে। জালেম বা জুলুমবাজদের জানা উচিত, তাদেরও একদিন আল্লাহর দরবারে গিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, জালেমদের কর্মকা- সম্পর্কে আল্লাহকে উদাসীন মনে করো না। যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে, জুলুমবাজরা তাদের অত্যাচারের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে। (সুরা শূরা, আয়াত ২২)। 

রাসুল স. বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা জালেমদেরকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন তাদের পাকড়াও করেন তখন আর তাদের রেহাই দেন না। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন, তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও হয় অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য’ (সহি বুখারি ও মুসলিম)। 

রসূলুলাহ স. বলেছেন, ঋণী ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে টাল-বাহানা করাও জুলুমের শামিল। (সহি বুখারি, হাদিস নং- ২২২৭)

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত। রসূলুলাহ স. বলেছেন, মুমিনরা যখন দোযখের আগুন থেকে পরিত্রাণ পাবে তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে একটি সেতুর উপর তাদেরকে থামানো হবে এবং তখন দুনিয়ায় তারা একে অপরের প্রতি যে জুলুম করছিল তার প্রতিশোধ নেয়া হবে। অবশেষে যখন তারা পাপমুক্ত হয়ে পবিত্র হবে তখন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে। এরপর তিনি বলেন, সেই সত্তার কসম যার হাতে মুহাম্মদের জীবনÑ নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যেকের কাছে দুনিয়ার বাড়ি-ঘর যেমন পরিচিত ছিল তার থেকেও বেশি জান্নাতের বাড়ি চিনতে পারবে। (সহি বুখারি, হাদিস নং- ২২৬৩)

রসূলুলাহ স. বলেছেন, মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না; কিংবা তাকে জালিমের হাতে সোপর্দও করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আলাহ তার অভাব পূরণ করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের কোন বিপদ দূর করবে, আলাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহের মধ্যে থেকে সবচেয়ে বড় কোন বিপদ দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলামানের দোষ ঢেকে রাখবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন। (সহি বুখারি, হাদিস নং- ২২৬৫)

হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। রসূল স. মুআয রা-কে ইয়েমেনে পাঠালেন এবং তাকে বললেন, মজলুমের অভিশাপকে ভয় কর। কেননা, তার অভিশাপ ও আল্লাহর মাঝে কোন আড়াল থাকে না। (সহি বুখারি, হাদিস নং- ২২৭১)

হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুলাহ স.-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কারও জমি জোর-জবরদস্তি করে কেড়ে নেবে কিয়ামাতের দিন সাতস্তর জমি তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। (সহি বুখারি, হাদিস নং- ২২৭৫)

ক্ষমতা থাকলেই জুলুম করা ঠিক নয়। জুলুমকারী জুলুম করে সুখে নিদ্রা গেলেও মজলুমের চোখে ঘুম থাকে না। তার কষ্টের কথা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। মজলুমের অভিশাপের পরিণাম হয় ভয়াবহ। মানুষ মানুষের অধিকার হরণ, নির্যাতন, উৎপীড়ন ও যন্ত্রণা দেয়া যেমন জুলুম, তেমনি মহান আল্লাহর সঙ্গে তাঁর কোনো সৃষ্টিকে শরিক করা সবচেয়ে বড় জুলুম। মহান বলেন, আল্লাহর সাথে কোনো শরিক করো না। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে বড় জুলুম। (সূরা লুকমান, আয়াত-১৩)।

জালেম যতই কৌশলী, জ্ঞানী, শক্তিশালী, বিত্তবান বা রাজা-বাদশা হোক না কেন, সে যদি জুলুমের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে অবহিত হতো, তাহলে সে কখনও জুলুম করত না। মহানবী স. বলেছেন, কেউ যদি তার ভাইয়ের সম্মানহানি করে অথবা তার কোনো জিনিসের ক্ষতি করে, তবে আজই তার কাছ থেকে তা বৈধ করে নেয়া উচিত এবং সেই ভয়াবহ দিন আসার আগেই তা করা উচিত। সেদিন টাকা-পয়সা দিয়ে কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না, বরং জালেমের কাছে কোনো নেক আমল থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ হিসেবে মজলুমকে সেই নেক আমল দিয়ে দেয়া হবে এবং ওই মজলুমের অসৎকাজ তার ওপর বর্তাবে। (বুখারি, তিরমিজি)।

 

মুসলমানদের অবশ্যই উচিত, দুনিয়াবাসীকে সত্যের দিকে ডাকা প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ। যারা মানুষকে এ হক থেকে বঞ্চিত করে তারাও জালেমের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সত্য রয়েছে, সে তা প্রকাশ না করে গোপন রাখে? (সূরা বাকারা, আয়াত-১৪০)। আর যেসব মানুষ আল্লাহর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, ‘তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার রবের আয়াত শুনিয়ে উপদেশ দেয়ার পরও সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। (সূরা কাহফ, আয়াত-৫৭)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ