সোমবার ১৩ মে ২০২৪
Online Edition

জীবনঘুড়ির আকাশ দেখা

সাজজাদ হোসাইন খান

দশ-বার মিনিট হবে হয়তো। একটা ভাঙা গেইটের সামনে এসে ব্রেক কসলো রিকসা। হা করে আছে ইট। লাল ইট। ছাল-বাকল কবে যে খসে পড়েছে কে জানে। আসলে নামেই গেইট। দরজা-কপাট নাই। এক টুকরা ভাঙা কাঠ ঝুলে আছে। বামপাশে। সময়ের সাক্ষি হয়ে। চাচা বললেন আসো। ভিতরে প্রবেশ করে তো আরো অবাক। ছোট্ট একটি উঠান। ডাইনে দু’তলা দালান। বামে একতলা আর মুখোমুখি একতলা। তিনখানা দালানেরই কাহিল কাহিল অবস্থা। খসে খসে পড়ছে আস্তর। বামেরটির শুধু লাল ইট। আস্তর ফাস্তর ঝুরঝুর। হঠাৎ দেখলে মনে হয় ভাঙা ইটের স্তূপ। মনের চোখে কান্না এসে জমা হলো। ঢাকার বাড়ির এই ছিরি। এমন বাড়িতে থাকতে হবে? আমি এদিক সেদিক চোখ ঘোরাচ্ছি। মামাও আমার চোখে চোখ রাখছেন বারবার। তিনিও উসখুস করছেন। ভেজা ভেজা গন্ধ উড়ছে বাতাসে। চাচা আমার মনের গাছতলায় এসে দাঁড়ালেন। ভাতিজা কি ভাবছো। বাড়ি পছন্দ হয়নি? পুরান ঢাকার সব বাড়ি-ঘরের অবস্থা এরকমেরই। সেই কবে এগুলো তৈরি হয়েছে। মোঘল বাদশারা ছিলো। ইংরেজরা ছিলো। উড়ে উড়ে যাচ্ছে তিনশ’ বছর চারশ’ বছর। এসব দালানের ইটের ফাঁকে ফাঁকে ঘুমিয়ে আছে ইতিহাস। যুদ্ধের কাহিনী শান-সৌকতের কাহিনী। ধরো তুমি সেই ইতিহাসের ঢাকায় এসে পা রেখেছো। কি বলেন ভাইসাব? মামাও হাসলেন, সিঁড়ি ভেঙে ঘরে ঢুকলাম। চুঁ চুঁ করছে পেট। মনে হয় মামারও। সেই কখন দানা পড়েছিলো পেটে! কাপড় চোপর পালটে নিলাম। সবাই। হাতমুখে পানি ছিটানোর পর, রাস্তায় নামলাম আমরা তিনজন।

এ বাসায় পাকশাকের কোনো ব্যবস্থা নাই। আসলে পাকঘর আছে। হাঁড়ি-পাতিলও আছে। কিন্তু এসব নাড়াচাড়ার কেউ নাই। আপাতত নাই। ক’দিন আগেও হান্ডি ফান্ডির টুকটাক আওয়াজ ছিলো। ভাতের গন্ধ ভাসতো। ভাসতো  তরিতরকারির মউ মউ সুবাস। এ দালানের নিচতলায় থাকতেন ফুফু-ফুফারা। ফুফু এখন বাড়িতে বেশ ক’মাস ধরে।  ফুফা একা। আরো দু’চারজন যারা ঘুমান, সম্বল বালিশ আর তোশক। সাথে আধভাংগা চৌকি। তাই খাবার দাবার পথে পথে। আমরাও পথে নামলাম। প্রতি অক্তেই নামি। চাচা থাকেন সাথে। বিশেষ করে রাতের খাবার। দুপুরে একা। বাদ শুধু রোববার। সেদিন অফিস বন্ধ। কোনো কোনো রবি ফুফার ভাগে। এই ভাগাভাগি বেশ মজাই লাগে। মাঝেমধ্যে হোটেল বদল। মামা ফিরে গেলেন পরদিনই। চোখের পর্দায় আন্ধার জেঁকে বসে। আম্মা নাই।  মামাও আড়ালে।  একা একা লাগে। কান্না আসে। চোখের কানায় পানি টলমল। চাচা চলে যান অফিসে। ফিরেন দুপুরের পর। তখন কতকটা ফুরফুরে বাতাস সারা শরীরে ঝিরঝির। এভাবেই যাচ্ছে দিন, আসছে রাত। উঠান পার হলেই আর  এক দালান। সে বাড়িতে আছে একটি মেয়ে, একটি ছেলে। ছেলেটি আমার সমবয়সী। ভাব হয়ে গেলো তার সাথে। নাম মনসুর। সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে। আমার মতো। সেও কি ভর্তির অপেক্ষায়? জানতে চাইলাম। জানালো নবাবপুর সরকারী হাই স্কুলের ছাত্র সে। ক্লাস শুরু হয়নি। হবে হবে ভাব। ভাব ভঙ্গিতেই কাটছে দিন। মনসুরের সাথে খেলাধুলা চলে। তার সাথে এখানে সেখানে যাই। ঘর থেকে একটু আগে বাড়লেই পাকিস্তান মাঠ। বিশাল মাঠ। সে মাঠে এলাকার ছেলেরা খেলে। মেয়েরাও আসে। সব সময় জমজমাট থাকে মাঠ। আড্ডা-খেলা, তারপর সূর্যর চোখে কালো পর্দা। 

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে দিন। রাত যাচ্ছে নীরবে। মনের ভিতর কাঠঠোকরা ঠক ঠক। পড়া নাই লেখা নাই স্কুলেরও দেখা নাই। শুধু ঝিমধরা দুপুর। ঠাঠা রোদ। আম্মা মনের বকুলতলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখের মাঠে আগানগর-বিল ঝিল, পানি, নৌকা। কোনো কোনো রাতে জোনাক জ্বলে। ঘুম উধাও। মনসুর একদিন তার স্কুলে নিয়ে গেলো। এলাকাটির নাম নাকি ঠাঠারি বাজার। স্কুলের মুখোমুখি রেললাইন। দোতলার একটি কামরায় গিয়ে বসলাম। পাশে মনসুর। আরো কয়েকজন আশেপাশে। তখনো পড়াশোনা শুরু হয়নি রীতিমতো। স্কুলটি আমার পছন্দ হলো। কিছু সময় পর হৈহৈ করে সবাই বাড়ির পথে। মনসুর দেখালো ঐ যে ঠাটারি বাজার। তারপর হলো গিয়ে বনগ্রাম রোড। আরো কি কি বললো মাথায় ঢুকলো না। মগজে কেবল স্কুল-ক্লাস। এমনিতেই পেছনে চলে গেছে বেশ কটা দিন। 

আব্বা আসার খবর নাই। স্কুলে ভর্তিরও কোনো আলামত দেখছি না। চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম রাতে। স্কুলের খবর কি। চাচা হাসলেন, বললেন হবে হবে।  (চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ