রবিবার ০৫ মে ২০২৪
Online Edition

রেইনট্রির ধর্ষণ মামলার রায় সম্পর্কে সচেতন মহলের অনেক প্রশ্ন

আসিফ আরসালান : আপন জুয়েলার্সের মালিকের পুত্র এবং তার সহযোগী চার বন্ধুসহ ধর্ষণ মামলায় পাঁচজন আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়ায় সারা দেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। এই মামলার বিচারক কামরুন নাহার রায়ের পর্যবেক্ষণে যা বলেছিলেন সে সম্পর্কে খোদ সরকারি মহলেই তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘন্টা পর কোন অভিযোগ এলে পুলিশকে সেই অভিযোগ বা মামলা গ্রহণ না করার নির্দেশ দেন বিচারক কামরুন নাহার। তার এই  ধরনের পর্যবেক্ষণে খোদ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ওই বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখবেন বলে জানান। যেদিন আইনমন্ত্রীর ব্যবস্থা সম্পর্কিত চিঠি লেখার কথা জানান, সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। পরের দুই দিন শুক্র ও শনিবার ছিল বিধায় তিনি প্রধান বিচারপতির কাছে রোববার চিঠি লিখবেন বলে জানান। কিন্তু আইনমন্ত্রীর চিঠি লেখার আগেই কামরুন্নাহারের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি মাহমুদ হাসান এ্যাকশন নেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে নারী ও শিশু অধিকার ট্রাইব্যুনাল নম্বর ৭ থেকে কামরুন্নাহারকে প্রত্যাহার করেন এবং তার সম্ভাব্য বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেন। শুধু তাই নয়, এই মামলার সংক্ষিপ্ত রায়ে তিনি যা বলেছিলেন অর্থাৎ ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা গ্রহণ না করা সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে বাদ দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে এই ধরনের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে তার সমগ্র রায়টিই প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখানে আইনগত জটিলতা পরিহারের জন্য একটি পুরাতন ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। বিচারপতি এটিএম  আফজাল যখন আপিল বিভাগের তথা বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন তখন সুপ্রিম কোর্টের কার্যাবলি সম্পর্কে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। ঐ সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বিচারপতি আফজাল উপস্থিত ছিলেন। তখন জনৈক বক্তা সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় নিয়ে বলেন যে এই রায়টি আমার সঠিক মনে হয়নি। কিন্তু যেহেতু এটি আদালতের রায় তাই আমি এ সম্পর্কে কথা বলতে পারব না। তখন প্রধান অতিথি অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি আফজাল বলেন যে আদালতের রায়ের সমালোচনা করা যাবে না, এ ধারণা সঠিক নয়। একটি রায় প্রকাশিত হওয়ার পর সকলেই যে সেই রায়টি সমর্থন করেন সেটি তো সত্য নয়। তবে দেখতে হবে যে রায়টি পছন্দ না হলে বা সমালোচনা হলে সেটি যেন গঠনমূলক হয়। রায়ের সমালোচনা করতে হলে আপনাকে দেখাতে  হবে যে আইনের কোন কোন ধারার ব্যত্যয় ঘটেছে। শুধু আবেগ তাড়িত হয়ে সমালোচনা করলে হবেনা। আপনার সমালোচনা হতে হবে যুক্তিনির্ভর।
কোনো মামলার রায় শুরু হয় নিম্ন আদালত থেকে। সংক্ষুব্ধ পার্টি ঐ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করতে পারেন। হাইকোর্টের রায়ও যদি তিনি সংক্ষুব্ধ থাকেন, তাহলে তিনি সুপ্রিমকোর্টে অর্থাৎ আপিল বিভাগে আপিল করতে পারেন। আপিল বিভাগের রায়ও যদি ওই পার্টি সংক্ষুব্ধ থাকেন তাহলে ঐ রায়টি রিভিউ করার জন্য তিনি পুনরায় সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ হতে পারেন। তবে রিভিউ পিটিশনে সংক্ষুব্ধ পার্টিকে দেখাতে হবে যে কোর্টের রায়ে আইনের লংঘন কোন স্থানে হয়েছে, অথবা ঐ মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট আইনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ওভার লুক করা হয়েছে কিনা।
॥ দুই ॥
ওপরের এই পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের আলোকে কামরুন্নাহারের রায়ের বিচার বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। প্রথমেই যে প্রশ্নটি এসে দাঁড়ায় সেটি হল ধর্ষণের ৭২ ঘন্টা পর ধর্ষণের কোন মামলার নেয়া যাবে না এ সম্পর্কে তিনি যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সেটি সম্পূর্ণ বেআইনি। ফৌজদারি আইনের কোথাও ৭২ ঘন্টা সম্পর্কে কোন ধারা নাই। ফৌজদারি আইনের ওপরে হলো দেশের সংবিধান। সংবিধানের কোথাও মামলা গ্রহণ করার কোনো সময়সীমা নেই। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে দেশের ফৌজদারি আইন এবং সংবিধান সম্পর্কে কামরুন্নাহারের সম্পূর্ণ জ্ঞান নাই, যেটুকু আছে সেটুকু আংশিক জ্ঞান। এই ধরনের ব্যক্তি বা বিচারকের রায় যে কতখানি সঠিক এবং আইন নির্ভর সে সম্পর্কে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
যে গ্রাউন্ডে কামরুন্নাহার আসামিদের সকলকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন সেই গ্রাউন্ড সম্পর্কেও ‘ডেইলি স্টার’, ‘ডেইলি নিউএজ’ সহ একাধিক পত্রপত্রিকায় অনেক প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বনানী থানায় এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন যে তিনি এবং তার বান্ধবী আলোচ্য মামলার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের পুত্রের জন্মদিনের পার্টিতে অংশ নিয়েছিলেন। এই পার্টির এক ফাঁকে ঐ দুই ছাত্রীকে প্রধান আসামিসহ অপর চার যুবক বলাৎকার করে। এই পাঁচ ব্যক্তিকে খালাস দেয়ার রায়ে বিচারক কামরুন্নাহার মামলার প্রসিকিউশনকে এই বলে ভর্ৎসনা করেন যে তারা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি এবং এমন দুর্বল মামলা চালিয়ে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। দেশের ৭২ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিচারক কামরুন্নাহারের এই মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করেন এবং বলেন যে অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করা এবং পুলিশের দুর্বল তদন্তের জন্য ভিকটিমরা দায়ী নয়। তারা আরো বলেন যে দুর্বল এবং একপেশে তদন্ত এখন পুলিশি তদন্তের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি আরও বিশেষ করে প্রযোজ্য সেইসব নির্যাতিত নারীর ক্ষেত্রে যেখানে আসামি শাসক দলের অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৫ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক ছাত্রীর ধর্ষণ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের অযোগ্যতা ও গাফিলতির অভিযোগ করেছেন ঢাকার একটি আদালত। সর্বশেষ উদাহরণ হল গত জুলাই মাসে। তখন একজন কলেজ ছাত্রী আত্মহত্যা করে। এই আত্মহত্যায় উস্কানি দেয়ার অভিযোগ ওঠে বসুন্ধরা গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের বিরুদ্ধে। পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে আসামিদের তালিকা থেকে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম কেটে দেয়া হয়। তখনও নারীদের সংগঠনসমূহ একজন ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তদন্তকালে পুলিশের অযোগ্যতা এবং গাফিলতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এই পটভূমিতে দাবি উঠেছে যে রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জন ছাত্রীকে ধর্ষণ করার তদন্ত বিচার বিভাগ কর্তৃক পরিচালনা করা হোক।
এই দাবি সরকারের মেনে নেয়া উচিত। এটি শুধু ন্যায়বিচারের জন্যই নয়। পাবলিক পারসেপশন বা জনগণের মধ্যে এই ধারণা প্রোথিত হয়েছে যে বিচার এবং তদন্ত পরিচালিত হয় ধনিক গোষ্ঠীর এবং ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। সাক্ষ্য আইনে এ ব্যাপারে যে ধারা রয়েছে সেটিও বাতিল হওয়া উচিত। এ সম্পর্কে একটু পরেই আমরা আলোচনা করব।
এই মামলার রায় প্রদানকালে বিচারক কামরুন্নাহার এমন দু’চারটি মন্তব্য করেছেন যা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ও আপত্তিকর। ধর্ষণের মেডিকেল রিপোর্ট সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন যে ঐ রিপোর্টে ধর্ষণের স্বপক্ষে অপর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে। বরং ঐ রিপোর্ট থেকে মনে হয় যে এই দুই মহিলা যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত ছিলেন। তার এমন ধারণার ভিত্তি ছিল এই যে তারা স্বেচ্ছায় ঐ পার্টিতে অংশ নিয়েছে, স্বেচ্ছায় তারা মদ্যপান করেছে, স্বেচ্ছায় তারা পার্টিতে নৃত্য করেছে এবং স্বেচ্ছায় তারা সুইমিংপুলে সাঁতার কেটেছে। কামরুন্নাহার রায়ে আরো বলেন যে এই মামলার তদন্ত অফিসার প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। অন্য কথায় বলা যায় যে এটি ছিল একটি মিথ্যা অভিযোগ। এ কারণে তিনি তদন্ত অফিসারকে ভর্ৎসনা করেন এবং বলেন যে তদন্ত অফিসার আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। এই মামলার বিচারকাজে যে কয়টি কার্যদিবস অতিবাহিত হয়েছে সেই কয়টি কার্যদিবসে বলাৎকারের অন্যান্য মামলার বিচার করা যেত।
ধর্ষণ মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে অতীতে হাইকোর্ট ৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে একটি নির্দেশনা এই যে কোনো ভিকটিমকে বলা যাবে না যে সে যৌন কর্মে অভ্যস্ত বা তার যৌন কর্মে অভিজ্ঞতা রয়েছে। এটি শুধু বিচারক নয়, মেডিকেল রিপোর্ট প্রণয়নের সময় চিকিৎসক এবং ফরেনসিক এক্সপার্টরাও যেন ঐ ধরনের বাক্য না লেখেন সেজন্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শুধু তাই নয়। যদি তাদের ঐ ধরনের অতীত কোন অভিজ্ঞতা থেকেও থাকে তাহলেও সেটি রিপোর্টে উল্লেখ করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় নির্দেশনা ছিল এই যে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে এই বিষয়টি নিশ্চিত করবেন যে ধর্ষণের ভিকটিমকে আইনজীবী এমন কোন প্রশ্ন করতে পারবেন না যেটি তার মান মর্যাদার জন্য ক্ষতিকর এবং যেটি ধর্ষণ প্রমাণ করার জন্য প্রসঙ্গিক নয়।
এই প্রসঙ্গে সাক্ষ্য আইনের কথা এসে যায়। ১৮৭২ সালের যে সাক্ষ্য আইন বলবৎ রয়েছে তার একটি ধারায় আদালতে মামলা চলাকালে নারীকে ‘দুশ্চরিত্রা’ বলার বিধান রয়েছে। গত ১৬ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের নিকট জানতে চেয়েছে যে এর আগে ১৯৭২ সালের দুশ্চরিত্র সম্পর্কিত ধারাটি বাতিল করার জন্য সরকারকে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে সরকারের নিকট থেকে হাইকোর্ট সেটি জানতে চান। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানান যে সরকার এই ধারাটি বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। হাইকোর্ট আগামী ৪ঠা জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষকে ঐ দুটি ধারা সংশোধনের বিষয়ে হলফনামা আকারে রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
আলোচ্য রিট পিটিশনে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, এই আইনটির একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। সেটি হল- ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহ হয়। ১৮৫৯ সালে এই বিদ্রোহ শেষ হয়। ১৮৬০ সালে পেনাল কোড প্রণীত হয়। ১৮৬১ সালে প্রণীত হয় পুলিশ রেগুলেশন অ্যাক্ট। আর ১৮৭২ সালে প্রণীত হয় সাক্ষ্য আইন। এসব কোন আইনই জনগণের স্বার্থে করা হয়নি। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে এসব আইন করা হয়েছে। সেই আইন ব্রিটিশ আমলে আমরা চাইনি, পাকিস্তান আমলে চাইনি, সুতরাং বাংলাদেশ আমলেও সেটি থাকতে পারে না। এই আইনের ওপরই প্রণীত হয়েছে আমাদের শাসনতন্ত্র বা সংবিধান। এটি শাসনতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং এই আইন অবিলম্বে বাতিল হওয়া উচিত।
Email: [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ