ইউপি নির্বাচন নিয়ে আজীব তামাশা
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী:
সরকার, আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ও নির্বাচন কমিশন মিলে এক আজব তামাশার সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার শুরু হয়েছিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য থেকে। তিনি এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেন যে, মনে হলো নির্বাচন এবার সুষ্ঠু না হয়েই যায় না। তিনি নানা রকম হুংকার দিতে শুরু করলেন। প্রথমে তিনি বললেন, পয়সা খেয়ে কেউ কেন্দ্রে প্রার্থীদের নাম পাঠাবেন না। অর্থাৎ মনোনয়ন বাণিজ্য চলবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। যারা মনোনয়ন দেয়ার কথা তারা দু’হাতে সবার কাছ থেকে পয়সা খাওয়া শুরু করলো। যাকে নমিনেশন দেবে তার কাছ থেকেও, যাকে নমিনেশন দেবে না, তার কাছ থেকেও। ফলে এক বিশৃঙ্খল হানাহানির পরিবেশ সৃষ্টি হলো। যে নৌকা মার্কা পেল না, সেও তার শক্তি নিয়ে নির্বাচনি মাঠে থেকে গেল। শুরু হলো গ্রামে গ্রামে সংঘাত। সে সংঘাতে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগেরই অর্ধশতাধিক ব্যক্তি খুন হয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহল একেবারে নিশ্চুপ। তাদের তরফ থেকে অস্বীকার করা হচ্ছে না যে, যে খুন হলো সেও আওয়ামী লীগার। কিন্তু তাদের পাশে কেউ দাঁড়ালো না। কেউ তাদের খোঁজখবর নিল না। ভাবখানা এমন যে, গেছ কেন পার্টি লাইনের বিরুদ্ধে। মরলে মরেছ। তার দায়-দায়িত্ব কেন আওয়ামী লীগ নেবে?
এই টাকা খাওয়ার প্রবণতা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তার জন্য প্রকাশ্যে জনসভা করে কেউ কেউ টাকা ফেরত চাইছেন। কাকে টাকা দিয়েছেন, সেটা জোর গলায় ঘোষণা করছেন। কিন্তু যে টাকা খেল, তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না। ফলে মনোনয়ন বাণিজ্য আরও উৎসাহিত হলো। অপর দিকে যারা টাকা দিল ওবায়দুল কাদের গং বরং তাদের বিরুদ্ধে হুমকি দিতে থাকলো যে, যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর এখন জাতীয় সংসদ থেকে ইউপি নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্রই এমন ধারা সৃষ্টি করা হয়েছে যে, যে নৌকা মার্কা পাবে, সে নিশ্চিত পাস। ফলে কামড়াকামড়ি আরও বেড়ে গেছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাণিজ্যের হাজারো ঘটনা ইতিমধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চরকাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী আশরাফ উদ্দীন রাজন (রাজু) উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল আমিনের কাছে মনোনয়ন বাণিজ্যের টাকা ফেরত চেয়েছেন। গত পহেলা নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটার দিকে উপজেলার ফজুমিয়ার হাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নির্বাচনি পথসভায় এ টাকা ফেরত চান তিনি। রাজু তার বক্তব্যে বলেন, যে সমস্ত আওয়ামী লীগ নেতা নৌকার মনোনয়ন দিবেন বলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কিন্তু মনোনয়ন দেন নাই, টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না, আমি সেই টাকা ফেরত চাই।
তিনি বলেন, অ্যাডভোকেট নুরুল আমিনের কাছে টাকা ফেরত চাইলে তিনি আমাকে বিদ্রোহী প্রার্থী করে ভোটের মাঠে নামান। আর আমাকে পাঁচ লাখ টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাস দেন কিন্তু আমি টাকা চাই না। আমি আমার পাঁচ লাখ টাকাই শুধু ফেরত চাই। এখন টাকা ফেরত চাওয়ায় তিনি আমাকে চাঁদাবাজি মামলার হুমকি দিচ্ছেন। মনে রাখবেন, মিথ্যা মামলা করলে চরকাদিয়ার মানুষ আপনাকে ঝাড়–পেটা করবেন। ঝাড়–র মিছিল বের করবেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী রাজু বলেন, কমলনগরের আওয়ামী লীগকে আপনি ধ্বংস করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে আপনাকে দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। এরকম উদাহরণ ইতিমধ্যেই সংবাদপত্রে ভূরিভূরি প্রকাশ হয়েছে। ওবায়দুল কাদের সারাদিন কত কথা যে বলেন, কিন্তু এসব প্রসঙ্গ কখনো তোলেন না।
এরপর আসে রাজাকার প্রসঙ্গ। ওবায়দুল কাদের নিজেই স্বীকার করেছেন যে, আওয়ামী অফিস এখন রাজাকারের কারখানায় পরিণত হয়েছে। নৌকা যারা পেয়েছেন তারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের রাজাকার বলছেন। নৌকা যারা পাননি তারাও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের রাজাকার বলছেন যার বয়স এখন ৬৭ বছরের কম, তাদেরকে তো আর রাজাকার বলা যায় না। তাই যে প্রতিদ্বন্দ্বীর বয়স চল্লিশের মধ্যে তাকে রাজাকার পরিবারের সন্তান বলে গাল দেয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার পিতাকে পর্যন্ত হত্যা করেছে। রাজাকারের সন্তান বলে মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান বৃথা হয়ে যাবে? তাছাড়া সাচ্চা মুসলমান সরকারের জানা থাকার কথা যে, তোমরা পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে আর পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করিও না। সে বাণী অমান্য করছেন কোন যুক্তিতে?
এবার আসা যাক ইউপি নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে। নির্বাচনি আচরণবিধি নিয়ে। রাজশাহী-১ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী এই বলে হুমকি দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকার বিরুদ্ধে যে কাজ করবে বা কথা বলবে তাকে কলমা ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় থাকতে দেয়া হবে না। তিনি জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে তানোরের দগাডাঙ্গা স্কুল ও কলেজ ময়দানে গত ৩ নভেম্বর ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক গ্রামে এ কথা ঘোষণা করে দেন যে, যে ব্যক্তি নৌকার বিরুদ্ধে কথা বলবে বা কাজ করবে কলমার মাটিতে তার ঠাঁই হবে না। তার এই ভাষণের একটি ভিডিও ফুটেজ এলাকায় ভাইরাল হয়েছে। তিনি তার এই নির্দেশ পালনের জন্য দলীয় নেতা ও কর্মীদের প্রতি নির্দেশ দেন।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গোদাগাড়ি-তানোর আসনের এই এমপি বেশ বড় একটি জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। ওমর ফারুক আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান আর আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের খারাপ পরিণতির জন্য সতর্ক করে দেন এবং বলেন যে, তিনি যেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেন। এমপির এ ধরনের তৎপরতা নির্বাচনি আচরণবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। নির্বাচনি কর্মকর্তারাও এ কথা স্বীকার করেন।
এ প্রসঙ্গে ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, কথায় কথায় ওই বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি যদি আমার মনের কথা একটু আধটু বলতে না পারি তাহলে তো আমার জন্য রাজনীতি করা কঠিন হয়ে যাবে। বিদ্রোহী প্রার্থীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের মাধ্যমে আমি তার কাছে জানতে চাই নির্বাচনের পর তার কী অবস্থা হবে। এ বিষয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী গত ৪ নভেম্বর রিটার্নিং অফিসার বরাবর একটি অভিযোগপত্র পেশ করেন। কিন্তু তার কোনো প্রতিকার হয়নি।
এদিকে ওমর ফারুক চৌধুরীর চেয়েও আরেক কাঠি সরেস বক্তব্য রেখেছেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার হুমাইপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থীর জনসভায় আওয়ামী লীগের ঐ নেতা একে-৪৭ রাইফেলের ভয় দেখিয়েছেন। দলীয় প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে শুধু একে- ৪৭-এর ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হবেন না বলে কর্মী-সমর্থকদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন। আর চেয়ারম্যান পদের ব্যালট পেপারের বিষয়ে এ নেতার নির্দেশনা আরো স্পষ্ট। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন নৌকার ভোট কাইত্যার (বাঁশবেতের চাটাই) তলে হবে না। হবে টেবিলের ওপর এবং ওপেন। যারা কথা শুনবেন না তাদের জন্য আছে হয়রানি।
ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ নেতার নির্দেশনাগুলো এসেছে হুমাইপুর ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী রফিকুল ইসলামের নির্বাচনি সভা থেকে। আব্দুল্লাহ আল মামুনের বক্তব্য সংবলিত ৭ মিনিট ১০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে আওয়ামী লীগ নেতার প্রকাশ্য এমন বক্তব্যে নির্বাচনি পরিবেশ নষ্ট হবে বলে আশঙ্কা করছেন অন্য প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ নেতার বক্তব্য প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী মানিক মিয়া বলেন, ভোট যদি কাইত্যার তলে না হয়ে হয় টেবিলের উপর তা হলে ঘটা করে ভোটের আয়োজন করে কী লাভ? নির্বাচন কর্মকর্তাদের উচিত এখনি নৌকাকে জয়ী করে গেজেট প্রকাশ করা। আর একে-৪৭ নিয়ে এলে তো কেন্দ্রে ভোটার থাকবে না, থাকবেন কেবল ঐ আওয়ামী লীগ নেতা।
শুক্রবারের জনসভায় আওয়ামী লীগের ওই নেতা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের উদ্দেশে নানা মন্তব্য করেন। ওয়ার্ড সদস্য প্রার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, মেম্বার প্রার্থীর জন্য একটাই কথা, নৌকার বাইরে কাউকে ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে না। নৌকার ভোট হবে এই টেবিলের উপর, ওপেন। আপনারা যারা বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে মেম্বার প্রার্থী হয়েছেন, জয়ের জন্য চেষ্টা করেন। আপত্তি নেই কিন্তু আপনাদের এজেন্টদের বলে দিবেন নৌকায় ভোট কাইত্যার তলে হবে না। নৌকার ভোট হবে টেবিলের সামনে, সবার সামনে। এখানে যদি কোনো এজেন্ট বা মেম্বার প্রার্থী বিরোধিতা করেন তাহলে তৎক্ষণাৎ তাকে বের করে দিব
প্রার্থীদের আবার সতর্ক করে ওই নেতা বলেন, আমরা শুধু হুমাইপুরের জনগণের শক্তি নিয়ে ঐদিন আসব না। শুধু একে-৪৭ নয়, প্রয়োজনে যা করা দরকার সবই করব। কর্মী-সমর্থকদের অভয় দিয়ে তিনি বলেন, প্রশাসন আমাদের, পুলিশ আমাদের, সরকার আমাদের। আর কিছু বলার দরকার আছে ভাই? এমপির চোখ লাল হয়ে আছে, আওয়ামী লীগের চোখ লাল হয়ে আছে। আর নির্বাচনে যদি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে তাহলে তার দায় নিতে হবে বর্তমান চেয়ারম্যান ও বিএনপির নেতাদের। আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা কোনো সাধারণ মানুষকে হয়রানি করব না, হয়রানি করব যারা সহজ-সরল মানুষকে নিয়ে ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, এতে সংসদ সদস্যের ইঙ্গিত রয়েছে। এই আব্দুল্লাহ আল মামুন বাজিতপুরের সাচ্চু হত্যা মামলার আসামি। সম্প্রতি আদালতে এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পিবিআই। পিবিআই তাকে গত বছরের ১১ নভেম্বর গ্রেফতার করে। প্রায় চার মাস জেল খেটে এখন তিনি জামিনে আছেন। তবে এলাকার এমপি জানিয়েছেন যে, আব্দুল্লাহ আল মামুনের বক্তব্যের বিষয়ে তার কোনো ইঙ্গিত থাকার প্রশ্নই উঠে না।
এরকম আরেক কা- ঘটিয়েছেন মাদারীপুরের কালকিনির যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আফজাল হোসেন মোল্লা। গত শুক্রবার রাতে উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে সূর্যমুখী বাজারে নির্বাচনি পথসভায় তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুর ইউপি নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে ভোট দিলে কারও বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আফজাল বলেন, মাদারীপুর-৩ আসনের এমপি আবদুস সোবহান গোলাপ এতো নরম না। সে রবিবার থেকে স্টীম রোলার চালাতে বলবে। আপনারা চালাবেন আর আমি থাকব আমার কাছে দুইটা অস্ত্র লইয়্যা। আমি থাকমু। কারো বাপ-পুত থাকলে আমার সামনে জানি আসে। দয়া কইরা নৌকার বিরুদ্ধে কেউ যাইয়েন না। নৌকার বিরুদ্ধে গেলে কারো বাঁচন নাই।
হ্যালো সিইসি, হ্যালো ওবায়দুল কাদের, ভোটের বারোটা তো বাজিয়েছেন, এবার গয়রহ নাগরিকদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন। এর নাম নির্বাচন! ছিঃ!