রবিবার ২৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

৭ই নবেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট

মোঃ রাশেদুল ইসলাম রাশেদ : ১৯৭৫ সালের ৭ই নবেম্বরের এই দিনে সংঘটিত সিপাহী ও জনতার বিপ্লবের স্মরণে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উদ্যাপিত হয়ে আসছে। জাতীয় জীবনে এটি একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সিপাহী জনতা রাজপথে নেমে এসে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করেছিল। ১৯৭৫ সালের ৩-৬ নবেম্বর পর্যন্ত দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল। হুমকির সম্মুখীন হয় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব।
১৯৭৫ সালের ৬ নবেম্বর মধ্যরাতে সিপাহী জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করে।  এটাই জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে ইতিহাসে স্থান লাভ করেছে। তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে এবং ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য মানুষের বাক স্বাধীনতা, ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গলাটিপে হত্যা করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিল। বাকশালী সরকার অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী পন্থায় মানুষের ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদের উপর দমন-পীড়ন চালিয়েছিল। এ অবস্থায় স্বাধীনতা রক্ষায় অকুতভয় দেশ প্রেমিক সৈনিক ও জনতার ঢল রাজপথে নেমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম বিশ্বাসীদের জন্য জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ইতিহাস প্রেরণার। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বাকশাল কায়েম হয়েছিল। কাজটা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। তৎকালীন মিডিয়ায় ও মিডিয়ার বাইরে ব্যক্তি ও সমষ্টিপর্যায়ে সরকারের বন্দনা বেশি হতো, কম হতো সমালোচনা। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আগস্ট মাস এসে গিয়েছিল। দেশের ভেতরের কিছু ষড়যন্ত্র এবং দেশের বাইরের কিছু ষড়যন্ত্রমূলক কারণ মিলে একটি শক্ত আকৃতি নিয়েছিল। সব কিছুর পরিণতিতে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলেন; যা দেশের জন্য শোকাবহ ঘটনা ও শোকাবহ দিন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের পর এর সাথে যুক্ত সেনাবাহিনীর মেজরদের সাথে নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণ করেন। তবে খন্দকার মোশতাক সামনে থাকলেও ইতিহাস গবেষকগণ মনে করেন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সেনা কর্মকর্তারা ছিলেন প্রবল ক্ষমতাশালী। সে সময় বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সাথে জড়িত কয়েকজন মেজর বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনীর অনেককিছুই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। এর তিন মাস পরেই নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই যে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানটি হতে যাচ্ছিল তার প্রেক্ষাপটটি তৈরি হয়েছিল ক্ষমতার এই রক্তাক্ত পালাবদলের মধ্য দিয়ে। ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার একটি ফলশ্রুতি হচ্ছে নবেম্বরের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন রকম হতে পারতো। ৭ নবেম্বর না হলে দেশ আধিপত্যবাদীদের হাতে চলে যেত। ৭ নবেম্বরের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশবাসীকে সাম্রাজ্যবাদী, ফ্যাসিষ্ট সরকারের হাত থেকে রক্ষা করার প্রত্যয় নিতে হবে। সেইদিন সিপাই জনতা যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখেছেন তা দেশবাসীকে স্মরণ রেখে কাজ করতে হবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় সময়ের অপরিহার্য দাবি কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন প্রদান ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক এর মতে, ‘বর্তমান বাংলাদেশের সকল নাগরিকককে ৭ নবেম্বরের ইতিহাসকে আগ্রহভরে জাতিকে জানানো উচিত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নদীতে দু’টি স্রোত। একটি স্রোত ক্ষমতাশীনদের অনুকূলে, অন্যটি ক্ষমতাশীনদের বিপরীতে। বিপরীতমুখী স্রোতে জনসম্পৃক্ততা বেশি। দৃশ্যমান স্রোতের নিচে অদৃশ্য যে স্রোত, সেই স্রোতটি ক্ষমতাশীনদের অনুকূলে নয়; ক্ষমতাশীনদের প্রতিকূলে। বঙ্গবন্ধুর আমলে বিদেশী রাষ্ট্রের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শুভাকাঙ্খী যে রকম ছিল তদ্রুপ তার প্রতি বৈরী অশুভাকাঙ্খীও কম ছিল না। তবে বর্তমান আমলে, বন্ধু ভাবাপন্ন বিদেশী রাষ্ট্রগুলো এবং বৈরী ভাবাপন্ন বিদেশী রাষ্ট্রগুলো, প্রত্যেকেই নিজ নিজ নিয়মে অনেক বেশি সচেতন, সজাগ, সতর্ক এবং গোছানো। বঙ্গবন্ধুর আমলে রাজনৈতিক ময়দান ছিল সীমিত। বর্তমান ক্ষমতাশীনদের আমলেও রাজনৈতিক ময়দান সীমিত। সীমিত খেলার মাঠের অসুবিধা অনেক।’
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দেশের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবিলায় ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর সকল মুক্তিকামী জনতা রাজপথে নেমেছিল। আজকের প্রেক্ষাপটে জাতি এমন এক সময় এ দিবসটি পালন করতে যাচ্ছে যখন দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং ভোটাধিকারসহ মৌলিক মানবাধিকার বলতে কোনো কিছু নেই। মানুষের জানমাল, ইজ্জতের কোনো নিরাপত্তা নেই। গুম-খুন, হত্যা, ধর্ষণের মত জঘন্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতি দুঃশাসন একদিকে গোটা জাতিকে গ্রাস করেছে। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণহীন মাত্রাতিরিক্ত পণ্যমূল্য মানুষকে দারুণভাবে হতাশ করেছে। নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের কাছে এখন বাজারে যাওয়া মানেই আতঙ্ক আর অস্থিরতা। দরিদ্র ও কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের মাঝে ত্রাণ কার্যক্রমের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি চরম অমানবিক ও ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন। কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুতদার প্রভৃতির কারণে খাদ্যদ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, চিনি, দুধ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন এবং ক্রমে এসব পণ্য সংগ্রহ কঠিনতর হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর জন্য। আয়ের তুলনায় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উল্লম্ফন ঘটায় মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্য হরদম বেড়েই চলেছে। দেশে ঘনঘন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সম্মিলিত প্রয়াসে জেগে উঠতে হবে নতুন প্রত্যয়ে। ৭ নভেম্বর বিপ্লবের সফলতার সিঁড়ি বেয়েই আমরা পেয়েছি বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। আর সে জন্যই আমাদের জাতীয় জীবনে ৭ নবেম্বরের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র চরম সংকটের মুখে। আজকের এই মহান দিনে সবাইকে আহবান জানাতে চাই যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭৫ সালে এ দেশের মুক্তিকামী জনতা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, সেই একই চেতনাকে বুকে ধারণ করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় আবারও সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সময়ের অপরিহার্য দাবি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ