শনিবার ১৮ মে ২০২৪
Online Edition

এসএমই খাতে উপযুক্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করতে হবে

এম এ খালেক :

করোনা সংক্রমণের আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে স্বল্প সুদে প্রণোদনামূলক ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত অর্থবছরে এই খাতে ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ৩১৬ জন উদ্যোক্তাকে এই ঋণ দেয়া হয়েছে। আরো ২৩০ জন উদ্যোক্তার অনুকূলে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য মোট ২০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত এক মাসে ১৯টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসএমই ফাউন্ডেশন মোট ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদে একজন এসএমই উদ্যোক্তা ১ লাখ টাকা হতে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাচ্ছেন। এর মধ্যে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হচ্ছে জামানতবিহীনভাবে। নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ দেয়া হচ্ছে। মোট ঋণের অন্তত ২৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দেয়া হচ্ছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের একজন পরিচালক বলেন, এসএমই খাতে দেয়া ঋণের কিস্তি নির্ধারিত সময়ে আদায় না হবার কোনো নজীর নেই। তাই এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণদানের ক্ষেত্রে ঋণ নীতিমালা সহজীকরণ করা যেতে পারে। বর্তমানে এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো নানা ধরনের জটিল নীতিমালা অনুসরণ করছে। ফলে অনেকের পক্ষেই ব্যাংক থেকে এসএমই খাতের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।  ট্রেডিশনাল ব্যাংক সাধারণত জামানত ছাড়া ঋণ দিতে চায় না। অনেক উদ্যোক্তা আছেন, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা জামানত দেবার ক্ষেত্রে জটিলতার পড়েন। আমাদের বিদ্যমান সামাজিক অবস্থায় একজন নারী চাইলেই তার পৈত্রিক সম্পত্তি এবং স্বামীর সম্পত্তিতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। তাকে এ জন্য দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করতে হয়। ইসলাম ধর্মে নারীদের সম্পত্তির অধিকার দেয়া হয়েছে সুস্পষ্ট আইন দ্বারা। একজন নারী তার পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পান। একই সঙ্গে স্বামীর সম্পত্তির উপরও তার আনুপাতিক অধিকার থাকে। ইসলাম ধর্মে নারীদের যেভাবে সম্পদায়িত করা হয়েছে, পিতার এবং স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার দেয়া হয়েছে অন্য কোনো ধর্মে নারীদের সেভাবে সম্পদের উত্তরাধিকার দেয়া হয়নি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যারা এই সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করেন তারা নারীদের অধিকারকৃত সম্পত্তি কোনোভাবেই দিতে চান না। ভাইয়েরা মনে করেন, বোনদের সম্পত্তি দেয়ার কি প্রয়োজন আছে? স্বামীর সংসারেও একজন নারী স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় সম্পদের উত্তরাধিকার পান না। কিন্তু ব্যাংক তো ঋণ দেবার সময় সেটা বুঝে না। ব্যাংক চায় তার ঋণের নিরাপত্তা বিধানের জন্য উপযুক্ত জামানত। 

নারী উদ্যোক্তাগণ সাধারণত তাদের স্বভাবগত কারণেই ঋণ খেলাপি হন না। তারা ঋণের কিস্তি নিয়মিত ফেরৎ দেন। ঋণ দেবার পর সেই ঋণের কিস্তি আদায় করতে না পারার জন্য ব্যাংকাররাই অনেকাংশে দায়ী। ব্যাংক যদি উপযুক্ত ব্যক্তিতে বাছাই করে সঠিকভাবে ঋণ দান করেন তাহলে সেই ঋণের অর্থ আত্মসাৎ করার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন, এনজিও’রা তাদের দেয়া ঋণের কিস্তি প্রায় শতভাগ আদায় করতে পারলে ট্রেডিশনাল ব্যাংকগুলো তা পারছে না কেনো? এনজিও থেকে সাধারণত দরিদ্র মানুষ ঋণ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে নারী ঋণ গ্রহীতার সংখ্যাই বেশি। নারীরা সাধারণত নীতিগত কারণেই ঋণের অর্থ আত্মসাৎ করার কথা চিন্তা করেন না। এছাড়া নারীরা দুর্বল বলে তাদের নিকট থেকে চাপ দিয়ে ঋণের কিস্তি আদায় করা সহজ। কিন্তু ট্রেডিশনাল ব্যাংকগুলো যাদের ঋণ দেয় তারা সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষ। তাদের আর্থিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। তাই চাইলেই তাদের নিকট থেকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করা যায় না। কিন্তু এনজিও’র নিকট থেকে যে সব দরিদ্র নারী ঋণ গ্রহণ করেন তাদের আর্থিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকায় তাদের নিকট থেকে ঋণের কিস্তি আদায় করা খুবই সহজ। আমাদের দেশে ব্যাংক ঋণ পেতে আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। আবার ঋণ খেলাপি হতেও আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ঋণদানের ক্ষেত্রে আবেদনকারির আর্থিক অবস্থা এবং জামানত দানের ক্ষমতাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তারা অভিজ্ঞতাকে কোনো গুরুত্ব দেয় না বা মূল্যায়ন করে না। একজন অভিজ্ঞ মানুষ সাধারণত ঋণ গ্রহণ করে তা আত্মসাৎ করেন না। কিন্তু শুধু আর্থিক অবস্থা এবং জামানত দানের ক্ষমতাকে ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলেই ঋণ দানের পর সেই ঋণের কিস্তি আদায়ে সমস্যা হয়। উন্নত দেশগুলোতে এসএমই খাতের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। কোনো কোনো দেশে এসমেই খাতের অবদান জিডিপি’েত ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। আর আমাদের দেশের জিডিপি’তে এসএমই খাতের অবদান মাত্র ২৫ শতাংশ। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারের মাধ্যমে এসএমই খাতের সংজ্ঞায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে। আগে কটেজ অ্যান্ড মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিকে এসএমই খাতের অন্তভুক্ত বলে বিবেচনা করা হতো না। ফলে তারা এসএমই খাতের জন্য দেয়া প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা পেতো না। এই সমস্যা দূরীকরণের জন্য কটেজ অ্যান্ড মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিকে এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত করে এই খাতের নতুন নামকরণ করা হয়েছে, ‘কটেজ,মাইক্রো,স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্ট্রারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)। এর ফলে কুটির শিল্প এবং অতি ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রাপ্তির রাস্তা উন্মুক্ত হয়েছে। আগে কুটির ও মাইক্রো শিল্পের উদ্যোক্তাদের ঋণের জন্য এনজিও এবং গ্রামীণ মহাজনদের উপর নির্ভর করতে হতো। এসএমই খাতের সংজ্ঞা পরিবর্তন করার পাশাপাশি মন্ত্রী পরিষদের সভায় নারী উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণদানের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এই দু’টি উদ্যোগ যে কোনো বিবেচনায়ই যুগান্তকারি। কিন্তু উদ্যোগগুলো খাতা কলমেই সীমিত রয়েছে। এখনো এর বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ঋণ যেভাবে দেয়া হয় তা দারিদ্র্য বিমোচনের মোটেও সহায়ক নয়। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে এমন পরিবারের সংখ্যা ৮ থেকে ৯শতাংশের মতো। সেই দারিদ্র্য বিমোচনও আবার টেকসই নয়। সামান্য অভিঘাতেই তারা আবারো আগের অবস্থানে ফিরে যায়। একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য বিমোচন করে না। তাদের আরো বেশি করে দারিদ্র্যাবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করে মাত্র। ক্ষুদ্র ঋণ দরিদ্র মানুষকে পানিতে ভেসে থাকতে সহায়তা করে তীরে উঠতে সাহায্য করে না। ক্ষুদ্র ঋণের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে এর সুদের হার অত্যন্ত বেশি। বর্তমানে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) নির্ধারিত ক্ষুদ্র ঋণের সুদ হার হচ্ছে ২৪ শতাংশ। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আরো বেশি পরিমাণে সুদ গ্রহণ করে থাকে। তাদের সুদ ক্যালকুলেশন পদ্ধতি বিচিত্র ধরনের। ফলে সাধারণ দরিদ্র মানুষ তাদের কারসাজি বুঝতে পারে না। প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ মানুষের সার্বিক চাহিদা পূরণের পক্ষে মোটেও যথেষ্ট নয়। তাই তারা একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়। এভাবে তারা ঋণজালে জর্জরিত হয়ে পড়েন। কারো হয়তো একটি গরুর খামার প্রতিষ্ঠার জন্য ২ লাখ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু একক এনজিও সেই প্রতিষ্ঠানকে হয়তো ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ দিতে পারবে না। এই অবস্থায় উদ্যোক্তা কি করবেন? তাকে গরুর খামার প্রতিষ্ঠান করতে হলে অন্য কোনো সূত্রে থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হবে। তিনি হয়তো আরো তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ লাখ টাকা করে ঋণ গ্রহণ করলেন। চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণের ফলে এই ঋণ পরিশোধের সময় তিনি বিপাকে পতিত হন। 

অনেক সময় এক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করে তা দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন। কোনো কারণে তিনি আর্থিক ভাবে বিপন্ন হয়ে পড়লে তাকে ঋণের কিস্তি পরিশোধে সমস্যায় পড়তে হয়। প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণের বিকল্প একটি পন্থা উদ্ভাবন করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ। তিনি এই পদ্ধতির নামকরণ করেছেন ‘উপযুক্ত ঋণ।’ উপযুক্ত ঋণের মূল কথাই হলো যার যেটুকু ঋণ প্রয়োজন তাকে সেটুকু ঋণ দেয়া। ঋণদানের পূর্বে আবেদনকারির আর্থিক সামর্থ্য, ঋণ ব্যবহারের ক্ষমতা ও দক্ষতা এবং কতটা ঋণের প্রয়োজন তা নিরূপন করা হয়। এরপর তাদের ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আর কোনো ব্যক্তিকে ঋণদানের আগে সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা হয়। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ঋণদান পরবর্তী সময়ে সার্বক্ষণিক মনিটর করা হয়। ঋণ গ্রহীতা কোনো সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। কেউ সমস্যায় পতিত হলে তা সমাধানের জন্য সহায়তা করা হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যারা উপযুক্ত ঋণ গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনের হার খুবই সন্তোষজনক। 

সরকার গত অর্থবছরে সিএমএসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনামূলক ঋণ বরাদ্দ করলেও ব্যাংকগুলো ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করতে সমর্থ্য হয়। চলতি অর্থ বছরেও সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন করে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনামূলক ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই ঋণ বিতরণের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। এক শ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তা আছেন যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চান না। তাদের এই নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তন করার ব্যবস্থা করতে হবে। গত অর্থবছরে বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনামূলক ঋণ বরাদ্দ করা হয়েছিল। সেই ঋণের প্রায় পুরোটাই বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু বৃহৎ উদ্যোক্তাদের মধ্যে যারা প্রণোদনামূলক ঋণ নিয়েছেন তাদের অনেকেই সেই ঋণের অর্থ অপব্যবহার করেছেন। প্রণোদনামূলক ঋণের একটি বিশেষ শর্ত ছিল এই ঋণের অর্থ দিয়ে স্বাভাবিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা যাবে না। উল্লেখ্য, স্বাভাবিক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ। আর প্রণোদনামূলক ঋণের সুদ হার হচ্ছে সাড়ে ৪ শতাংশ। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে, বৃহৎ উদ্যোক্তাদের অনেকেই প্রণোদনামূলক ঋণ গ্রহণ করে সেই অর্থ দিয়ে ইতিপূর্বে গৃহীত স্বাভাবিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছেন। অনেকেই এই ঋণের অর্থ অন্য খাতে প্রবাহিত করেছেন। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ