শনিবার ১৮ মে ২০২৪
Online Edition

পরশে যার পাথর হলো সোনা

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) তখন মদিনায় হিজরত করেছেন। এমনকি তিনি সেখানকার রাষ্ট্রপ্রধানও। মদিনার অনেকেই ইসলাম কবুল করেছেন। তবে সবাই তা তখনও গ্রহণ করেনি। এরমধ্যে নামকরা একজন ধনাঢ্য ইহুদি পণ্ডিত ছিলেন। নাম জায়িদ ইবনে সুনাহ।
একজন সাহাবীর প্রয়োজন মেটানোর জন্য রাসূল (স) এ ইহুদি পণ্ডিত জায়িদ ইবনে সুনাহর কাছ থেকে ঋণ হিসেবে কিছু খেজুর নেন। নবীজি (স) ইহুদিকে একটি তারিখ বলেন, যে-তারিখে তিনি ঋণ ফেরত দেবেন।
একদিন নবীজি (স) জান্নাতুল বাকিতে একজনের জানাযাশেষে সাহাবীদের নিয়ে মসজিদে নববিতে ফিরছিলেন। সঙ্গে ছিলেন আবু বকর (রা), ওমর (রা) এর মতো মহান সাহাবীবৃন্দ।
ঠিক সেসময় ঐ ইহুদি লোকটি রাসূল (স) এর গলার চাদর টেনে ধরে রেগেমেগে রূঢ় ভাষায় বললেন, “ও মুহাম্মদ! আমার কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছিলে, সেটা কখন দেবে? আমি তো তোমার পরিবারকে চিনি। ঋণ নিলে তা পরিশোধের আর কোনও খবর থাকে না!”
নবীজি (স) তখন মদীনার রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁকে সবার সামনে এতো বড়ো অপমান করা হলো অথচ ঋণ পরিশোধের যে তারিখ ধার্য করা ছিল, সেটা তখনও বাকি আছে। একে তো সময়ের আগেই চেয়েছেন, তাও আবার অভদ্র রূঢ় ভাষায়। সঙ্গে থাকা হযরত ওমর (রা) সহ্য করতে পারলেন না। তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে ফেললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি অনুমতি দিন, তার মাথাটা গলা থেকে এখনই নামিয়ে ফেলি?”
নবীজি (স) এর এক্ষেত্রে যেমন ক্ষমতা ছিল, তেমনই তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ। অমার্জিত আচরণের জন্য ইহুদি সুনাহর তিনি শাস্তি দিতে পারতেন। তাঁকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেবার অধিকারও নবীজি (স) এর ছিল। কিন্তু, তিনি উল্টো হযরত ওমর (রা) কে বললেন, “ওমর, তোমার কাছ থেকে তো উত্তম ব্যবহার আশা করেছিলাম। তুমি এভাবে না বলে বরং আমাকে বলতে পারতে, ‘আপনি তাঁর ঋণ পরিশোধ করুন’। কিংবা তাঁকে বলতে পারতে, আপনি সুন্দরভাবে ঋণের কথা বলতে পারতেন।”
অসুন্দরের জবাব সুন্দর করে, অনুত্তমের জবাব কী করে উত্তমভাবে দিতে হয় সেটা নবীজি (স) ওমরসহ উপস্থিত সাহাবীদের শেখালেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (স) হযরত ওমরকে নির্দেশ দিলেন, “ওমর, যাও তাঁর সঙ্গে এবং ঋণ পরিশোধের পর তাঁকে আরও বিশ সা’ (এখনকার প্রায় ৩২ কেজি) খেজুর দিয়ে দিও। কারণ, তুমি তাঁকে জীবননাশের হুমকি দিয়েছো।”
হযরত ওমর রাজিআল্লাহু আনহু ইহুদি জায়িদ ইবনে সুনাহকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তাঁকে তাঁর প্রাপ্য ঋণ প্রদান করলেন এবং সঙ্গে আরও ৩২ কেজির মতো খেজুর দিলেন। ইহুদি পণ্ডিত তো বিস্মিত!
তিনি একে তো সময়ের আগেই পাওনা দাবি করেছেন, তার ওপর সবার সামনে নবীজিকে অপমান করেছেন। তবুও নবীজি (স) তাঁকে পাওনা দিয়ে দিলেন। সঙ্গে দিচ্ছেন অতিরিক্ত আরও ৩২ কেজি খেজুর!
ইহুদি পণ্ডিত জিজ্ঞেস করলেন, “অতিরিক্ত এগুলো কেন?”
হযরত ওমর (রা) বললেন, “কারণ, আমি আপনাকে হুমকি দিয়েছি। সেটার কাফফারা হিসেবে নবীজি এগুলো দিতে বলেছেন।”
এটা শুনে ইহুদি বললেন, “ওমর, তুমি কি জানো আমি কে?” হযরত ওমর (রা) বললেন, “না, আমি জানি না। আপনি কে?”
ইহুদি জায়িদ বললেন, “আমি জায়িদ ইবনে সুনাহ।”
তাঁর নাম শুনে হযরত ওমরের চক্ষু চড়কগাছ!
জায়িদ ইবনে সুনাহ? মদিনার সেই বিখ্যাত ইহুদি রাবাই পণ্ডিত? ওমর তাঁর নাম জানতেন, কিন্তু তিনিই যে ঐ ব্যক্তি, তা তিনি জানতেন না।
জায়িদ ইবনে সুনাহ বললেন, “হ্যাঁ, আমিই সেই ইহুদি রাবাই। আমাদের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে মুহাম্মদ এর নবী হবার প্রমাণের যতো ভবিষ্যৎবাণী পাওয়া যায়, সবগুলোই আমি তাঁর মধ্যে পেয়েছি। শুধু দুটো বিষয় পরীক্ষা করা বাকি ছিল।”
সেই দুটো হলো: তাঁকে কেউ রাগালে তিনি সহনশীলতা দেখাবেন।
কোনও মূর্খ তাঁর কাছে এসে খারাপ আচরণ করলে তিনি বরং সেই মূর্খের সঙ্গে ভালো আচরণ করবেন। অর্থাৎ তিনি মন্দের জবাব ভালোর মাধ্যমে দেবেন, অনুত্তমের জবাব উত্তমের মাধ্যমে।
জায়িদ ইবনে সুনাহ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে সেই দুটো গুণও এবার দেখতে পান। তিনি নবীজি (স) কে রাগানো সত্ত্বেও তিনি তাঁর সঙ্গে রাগ করেননি। উল্টো তাঁর পাওনার বেশি তাঁকে দিয়েছেন।
এবার জায়িদ ইবনে সুনাহ বললেন, “ও ওমর, তুমি সাক্ষী থেকো, এখন থেকে আমি আল্লাহকে আমার রব হিসেবে, ইসলামকে আমার দীন হিসেবে এবং মুহাম্মদ (স) কে আমার নবী হিসেবে স্বীকার করে নিলাম। আমার অঢেল সম্পদ আছে। আমি আমার অর্ধেক সম্পদ ইসলামের জন্য দান করে দিলাম।”
উল্লেখ্য, এভাবেই জায়িদ ইবনে সুনাহ নিজের জীবন বদলে নিলেন। যাত্রা শুরু হলো তাঁর আঁধার থেকে আলোর পথে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর ভালোবাসার পরম পরশে মদিনার বিশিষ্ট এ ইহুদি পণ্ডিত জায়িদ ইবনে সুনাহর পাথরহৃদয় সোনায় পরিণত হলো। অন্যথায় তাঁর বিপুল অর্থসম্পদের অর্ধেকটা দীনের খেদমতে নবীজি (স) এর হাতে দ্বিধাহীনভাবে সঁপে দেবেন কেন?*
বলতে দ্বিধা নেই, দুনিয়াজুড়ে মুসলিমদের নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ইউরোপ ও আমেরিকাসহ অনেক দেশে হাজার হাজার মানুষ কালেমা পাঠ করে স্বেচ্ছায় এবং সচেতনভাবে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে সমবেত হচ্ছেন। পাল্টে ফেলছেন পুরনো জীবনবোধ, সংস্কার এবং সংস্কৃতি। আমরাও তাঁদের স্বাগত জানাই। অভিনন্দিত করি।
* তথ্যসূত্র: সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৮৮, আল-বায়হাকী: ১১০৬৬, মুস্তাদারক হাকিম: ৬৫৪৭। ইমাম হাকিম হাদীসটি সহীহ বলেছেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ