শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

রোগীর সেবা শুশ্রুষা করাও ইবাদত

 মাহমুদ শরীফ:

ইসলাম মহান আল্লাহ প্রদত্ত ও মহানবী হযরত মোহাম্মদ সা: প্রদর্শিত একমাত্র সার্বজনীন দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা। নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত যেমন ইবাদত, তেমনি অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং তার সেবা শুশ্রুষা করাও নফল ইবাদত। এটা রাসূল সা: এর সুন্নাত। আর ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ এটাতো মানবতা। আজ বিশ্বে অমুসলিমরা মানব সেবায় বেশি অগ্রগামী। ওদের আমল আছে ইমান নেই, আর আমাদের ইমান আছে আমলের অভাব। ছাত্রজীবনে একটি বাণী শিখেছিলাম যার গুরুত্ব তখন না বুঝলেও এখন বুঝছি। সেটা ছিল- ‘এমন জীবন তুমি করেছ গঠন, জন্মে কেঁদেছ তুমি হেসেছে ভুবন/এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরণে হাসবে তুমি কাঁদবে ভুবন’! মানবতার সেবার মাধ্যমেই এমনটি হওয়া অসম্ভব নয়। আর বিপদেই আসল বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়। 

মহান আল্লাহতায়ালা বান্দাকে রোগব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা করেন। অসুস্থতার মাধ্যমে মুমিনের পাপ মোচন হয়। সাহাবীরা রহমত স্বরূপ অসুস্থতা কামনা করতেন। ইমাম বুখারি (রহ) সহ অনেকেই রোগীর সেবাকে ওয়াজিব বলেছেন। ইবনে তাইমিয়া (রহ) বলেন, রোগীর সেবা প্রদান ‘ওয়াজিবে কিফায়া’।  জানাযার নামায যেমন ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ সবার পক্ষ থেকে ২/৪ জন করলেই আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু কেউ অংশ না নিলে সবাইকে গোনাহগার হতে হবে।

‘রোগীর সেবায় হাদিসে ‘ইআদত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। জিয়ারাত (সাক্ষাৎ) শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। কেননা, তা সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রোগীর ক্ষেত্রে ‘ইআদাত’ আনা হয়েছে যার অর্থ বারবার ফিরে আসা। শব্দটি রোগীদের বার বার দেখতে যাওয়ার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে। (আশ-শারহুল মুমাত্তা : ৫/২৩৬)

পবিত্র আল কোরআনের সুরা বাকারা ১৫৫-১৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের কিছু ভয় ক্ষুধা ও ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল ফসলের ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করিব। শুভ সংবাদ দাও ধৈর্য্যশীলদের। যারা তাদের উপর বিপদ এলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই এবং তার দিকেই ফিরে যাব‘।

সুতরাং একজন মুমিন রোগে আক্রান্ত হলে হতাশ হবে না, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ধৈর্য্যরে সাথে মোকাবেলা করতে হবে। আল্লাহর রহমত কামনায় নিজেকে আরো আবেদ হওয়া উচিত। সুরা বাকারা ১০ নং আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন, ‘তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি, আল্লাহ ব্যাধিকে আরো বাড়িয়ে দেন, তাদের জন্য আছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাবাদী’।

মূলতঃ ব্যাধি দুই ধরনের। এক অন্তরের এবং দুই শারীরিক। আমরা অন্তরের ব্যাধি সারাতে কোরআন-হাদীসের দিক-নির্দেশনা মানবো। আর শারীরিক ব্যাধি থেকে সুস্থতার জন্য চিকিৎসা নেব। ভরসা করব আল্লাহর উপর, তিনিই শেফাদানকারী, ভালো-মন্দের মালিক।

হাদিস শরীফে রাসূল সা: বলেছেন ‘এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের পাঁচটি অধিকার রয়েছেÑ ১. সালামের জবাব দেয়া; ২. হাঁচির উত্তর দেয়া; ৩. দাওয়াত কবুল করা; ৪. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া ৫. জানাযায় অংশগ্রহণ করা’। (মুসলিম-৪/২১৬২) 

হাদিসে কুদসিতে রাসূল সা: আরো ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন মহান রাব্বুল আলামিন বলবেন। হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। বান্দা বলবে, আপনি তো বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আমি আপনাকে কিভাবে দেখতে যেতে পারি? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, তুমি তাকে দেখতে গেলে তার কাছে আমাকে পেতে’। (মুসলিম-২৫৬৯)

হাদিসের আলোকে একজন রোগীকে দেখতে যাওয়ার অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। সহীহ মুসলিম শরীফে জান্নাতের ফল বাগানে অবস্থান করার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে রোগী দেখতে যাওয়া, সেবা করা ব্যক্তিকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো মুসলিম অসুস্থ মুসলিম ভাইয়ের সেবায় নিয়োজিত হয়, সে ফিরে আসা পর্যন্ত জান্নাতের ফল বাগানে অবস্থান করে‘। 

ফেরেশতারাও তার জন্য দোয়া করেন। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল বেলা কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায় ৭০ হাজার ফেরেশতা বিকেল পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করে। আর বিকেলে গেলে সকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে এবং জান্নাতে একটি ফলের বাগান তৈরি করা হয়’। (আবু দাউদ-৩০৯৮, তিরমিজি-৯৬৯, ইবনে মাজাহ-১৪৪২)।

শুধু মুসলিম নয়, অমুসলিমদের সেবা-শুশ্রƒষা করার প্রতিও নবী সা: গুরুত্ব দিয়েছেন। হজরত আনাস রা: সূত্রে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, ‘এক ইহুদি যুবক রাসূল সা:- এর খেদমত করত। সে অসুস্থ হলে রাসূল সা: তাকে দেখতে যান। তার মাথার কাছে বসে তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সে তার পিতার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। তার পিতা বলল, তুমি আবুল কাশেম সা:-এর অনুসরণ করো। অতঃপর সে ইসলাম গ্রহণ করল। রাসূল সা: সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি এই যুবককে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন বলতে বলতে বের হলেন’ । (বুখারি-১৩৫৬)। অতএব এই নফল আমলটি আমরা সহজেই করতে পারি।

একজন রোগীকে দেখতে যাওয়ার জন্য কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। যেটা সুন্নাত তরিকা মত করাই শ্রেয়। যেমন- 

১. অজুসহ যাওয়া: রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে সওয়াবের উদ্দেশে কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায়, তাকে জাহান্নাম থেকে ৬০ বছর সমপথ দূরে রাখা হবে’। (আবু দাউদ-৩০৯৭) 

২. শরীরে হাত : রোগীর শরীরে হাত দিয়ে তার অবস্থা জানা। (মুসনাদে আহমাদ) 

৩. সান্ত¦নার বাণী শোনানো: রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা যখন কোনো রোগীর কাছে যাবে, তার জীবন সম্পর্কে আনন্দদায়ক কথা বলবে, তাকে সান্ত¦নার বাণী শোনাবে। (এ বাণী) ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে না, যা ঘটার তাই ঘটবে- কিন্তু তার মন সান্ত¦না লাভ করবে, যা রোগী দেখতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য’। (তিরমিজি-২০৯৪)। 

৪. উঁচু আওয়াজে কথা না বলা: ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘সুন্নাত হলো রোগীর পাশে কম বসা এবং বড় আওয়াজে কথা না বলা’। (মিশকাত-১৫৮৯)

৫. দোয়া করা: হযরত ওসমান ইবনে আবুল আস রা: বলেন- আমি নবী সা: এর কাছে ব্যথার বিষয়ে বললাম, তখন নবী সা: বললেন- তোমার দেহের যে স্থানে ব্যথা, সেখানে হাত রেখে তিনবার বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে সাত বার “আউযু বি ইজ্জাতিল্লাহি ওয়া কুদরাতিহি মিন সাররি মা আজিদু ওয়া উহাজির! পড়। ওসমান বলেন, আমি এরূপ করলাম- আল্লাহ ব্যথা দূর করে দিলেন। (মুসলিম) 

৬. নিজের জন্য দোয়া চাওয়া : হজরত ওমর রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসূল সা: এরশাদ করেন; ‘তোমরা যখন কোনো রোগীকে দেখতে যাবে, তার কাছে দোয়া চাইবে! কারণ তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতো কবুল হয়। (ইবনে মাজাহ-১৪৪১)। 

এছাড়াও-৭. মুমূর্ষু রোগীর কাছে সূরা ইয়াসিন পাঠ করা। ৮. বেশি প্রশ্ন না করা। ৯. চিকিৎসকের সতর্কবার্তা মেনে চলা। ১০. চাহিদা পূরণ করা। এক্ষেত্রে অর্থ পথ্য ফলমূল নিয়ে যাওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে রোগী দেখতে যাওয়া আত্মীয়তা ঝালাই করা যেন উদ্দেশ্য না হয়। রোগী দেখতে এসে খাদ্য-খাবার নিয়ে উৎসব করা বেমানান। 

আগতদের মেহমানদারী করতে যেয়ে রোগীর পরিবারের সদস্যরা যেন অতিষ্ঠ-বিরক্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। তাদের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, সমবেদনা জ্ঞাপন করা, সাধ্যমত সাহায্য-সহযোগিতা করা উচিত। আল্লাহ সবাইকে এমন কাজ করার তৌফিক দিন। আমিন!

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ