রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

আসামী নয় অতিথি

মাখরাজ খান: ঘটনাটা ঘটেছিল খলিফা মামুনের আমলে আব্বাসীয় খীলফা মামুন সবেমাত্র সিংহাসনে আরোহন করেছেন। এখনও সমগ্র খিলাফত এলাকায় তার হুকুমত পুরোপুরি জারি হয়নি- এমনি একদিন মামুনের দরবারে এক আসামী হাজির করা হলো। খলিফা এ আসামীর বিরুদ্ধে আগেই অভিযোগ পেয়েছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ। খলিফা আসামীকে দেখেই অগ্নিশর্মা হলেন। তিনি তার দরবারের আলী ইবনে আব্বাস নামক এক আমত্যকে বললেন, তুমি এ আসামীকে তোমার বাড়িতে নিয়ে শৃঙ্খলবদ্ধ করে রাখ। শাহী কয়েদখানায় একে রাখলে অন্যান্য কয়েদীদের সে বিপথে পরিচালিত করতে পারে। আগামীকল্য দরবারে তাকে হাজির করবে, দেখ কোনভাবে যেন সে পালিয়ে না যায়।

আলী ইবনে আব্বাস বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন জাঁহাপনা আসামী পালাতে পারবে না। পালাতে গেলে তার জীবন যাবে এবং কাল দরবারে তার নিষ্প্রাণ দেহটি হাজির করা হবে।

ঠিক আছে। যাও।

আব্বাস আসামীকে নিয়ে বাড়িতে হাজির হলেন। তার স্ত্রী বললো, এ কি হাত-পা বাঁধা লোক নিয়ে বাড়িতে হাজির হলে, রাতে একে কোথায় রাখবে?

-কেন বাড়িতে রাখবো? বললেন আব্বাস।

তার স্ত্রী জবাব দিলো, সন্ধ্যা তো হয়ে এলো, লোকটাকে তো কিছু খেতে দেয়া প্রয়োজন। তাছাড়া যদি লোকটা নামায পড়ে তাহলে তো তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিতে হবে।

আব্বাস তার স্ত্রী কথা শুনে চিন্তিত হলেন। যদি তার কারণে লোকটি নামায় আদায় না করতে পারে তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আর যদি নামায পড়ার জন্য বন্ধন মুক্ত করা হয় আর এই সুযোগে সে পালিয়ে যায় তাহলে খলিফা তার গর্দান নিবেÑ ভাবতে ভাবতে মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলো।

আব্বাস তাকে বললেনÑ আজান শেষ হলে তোমার সাথে দু’একটা কথা বলবো। আশা করি তুমি সঠিক জবাব দিবে।

লোকটা মাথা নেড়ে জানালো সে সত্যি কথা বলবে।

আজান শেষ হলে আব্বাস বললেনÑ এবার কথা বলি, তারপর দু’জন মিলে জামাত করে নামায পড়বো।

লোকটা বললোÑ বলুন।

-তোমার বাড়ি বাগদাদের কোন জায়গায়?

-বড় মসজিদের কাছে।

আব্বাস মনে মনে বললেনÑ এই বড় মসজিদ এলাকায়ই তো বছর খানেক আগে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

-বাড়িতে তোমার কে কে আছে?

-স্ত্রী, মা, আর এক ছেলে এক মেয়ে।

আব্বাস এবার মনে মনে বললো, আমি যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে এক মাস ছিলাম, তারও এক ছেলে এক মেয়ে ছিল।

-তোমার কি কোন ভাই আছে?

-না।

আব্বাস এবার মনে মনে বললো, সে এক বছর আগে যে বাড়িতে ছিল সে বাড়ির মালিকেরও কোন ভাই ছিল না।

আব্বাস বললেন, প্রায় বছর খানেক আগে তোমাদের ওখানে একটা গ-গোল হয়েছিল, তোমার কি মনে আছে?

-হ্যাঁ, আমার মনে আছে, আমি তখন বাড়িতেই ছিলাম।

তখন ইরাকের শাসনকর্তা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ফজলের ভ্রাতা হাসান বিন সাহল। ঐ সময় ইরাকের জনগণ তার ভ্রাতা ফজল এবং ইরাকের শাসনকর্তা হাসান বিন সাহলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। প্রধানমন্ত্রী তখন ইরাকেই ছিলেন। ইরাকের জনগণ তার কাছে কর মাফ করার আবেদন জানালে তিনি তাদের বেত্রাঘাতের আদেশ দেন, কয়েকজনকে কারারুদ্ধ করেন। এরপর জনতা ফজল এবং সাহলকে অবরুদ্ধ করে তারা দু’জনকেই সাত দিন আটকিয়ে রেখেছিল। এর মধ্যে খলিফার তরফ থেকে বোধ হয় একজন গিয়েছিল জনগণকে বুঝানোর জন্য, তাকেও জনতা আক্রমণ করেছিল এবং সে পালিয়ে আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রথম আমি ইতস্তত করেছিলাম, জনতার রোষে পড়ে আমাদের জীবনও বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু লোকটা এমনভাবে কাকুতি মিনতি শুরু করেছিল যে, আমি তাকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছিলাম এবং এক মাস পর তাকে নগদ অর্থ এবং ঘোড়া দিয়ে স্বদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

-যে লোকটা তোমার বাড়িতে এতদিন ছিল, তুমি কি এখন দেখলে তাকে চিনতে পারবে?

-আমার সবকিছু মনে নেই, তবে ঐ লোকটার মুখে আপনার মুখের মধ্যে যে ধরনের দাগ আছেÑ এ রকম একটা দাগ ছিল। সে যদিও এক মাস আমার বাড়িতে লুকিয়ে ছিল। কোথাও বের হতো না, তবু দিনে কখনও ঘুমাতে দেখিনি।

আব্বাস এবার তার স্ত্রীকে ডাকলেন। স্ত্রী ঘোমটা দিয়ে এসে দাঁড়ালো।

আব্বাস বললেনÑ এর সামনে ঘোমটা দেয়ার দরকার নেই, তুমি এর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দাও এ যেন কোন ব্যথা না পায়।

এবার হাত-পা বাঁধা লোকটি আব্বাসের কথা শোনে আশ্চর্য হয়ে বললোÑ এ কি বলছেন জনাব। হাত-পা খোলা থাকলে যে কোন সময় আমার পালানোর মতলব হতে পারে। আমার অপরাধ কি আমি জানি না, তবে মনে হয় খলিফা আমাকে কতল করবেন। যারা আমাকে বাড়ি থেকে ধরে এনেছে তারা এ রকমই বলেছে আমাকে স্ত্রী ছেলেমেয়ের সাথে কথা বলতে দেয়নি।

আব্বাস বললেন, খলিফার হাবভাব দেখেও আমার সে রকমই মনে হয়েছে। আমি তোমার গায়ে একটা ফলের আঁচড়ও পড়তে দিব না। কারণ তুমি আমাকে বাগদাদে জনরোষ থেকে বাঁচিয়ে ছিলে, তোমাকে খলিফার রোষ থেকে যদি বাঁচাতে না পারি, আমি নিজেকে চিরদিন অপরাধী মনে করবোÑ তুমি চলে যাও? কাল খলিফার দরবারে আমার যাই হয় হবে, তোমাকে সেখানে আমি নিয়ে যাব না।

শৃঙ্খলমুক্ত লোকটি জবাব দিলোÑ আমি আপনাকে একবার প্রাণে বাঁচিয়েছিলাম বলে প্রতিদান হিসেবে আপনি নিজের জীবন দিবেন সেটা তো হয় না। বরং আমি আপনাকে এতটুকু বলতে পারি যে, যারা আমার বিরুদ্ধে খলিফার কাছে অভিযোগ করেছে তারা আমার শত্রু, তাদের অভিযোগগুলো খলিফা যেন নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দেখেন, নিরপেক্ষ তদন্তে আমি যদি দোষী সাব্যস্ত হই, তাহলে আমার প্রাণদ- হলেও আফসোস থাকবে না। আমি হাসিমুখে জল্লাদের কাছে আমার গর্দান পেতে দিব।

আব্বাস বললেনÑ বলো, তোমার বিরুদ্ধে কে বা কারা খলিফার কাছে নালিশ করতে পারে?

লোকটি বললোÑ আমি জানি না, তবুও এতটুকু জানি তারা খলিফার লোক আর খুব প্রভাবশালী। আব্বাস বললেন, যতো প্রভাবশালীই হোক খলিফা সব সময় ন্যায়বিচার করেন, আশা করি তোমার ব্যাপারেও তিনি ন্যায়ের পক্ষেই থাকবেন।

পরদিন আব্বাস খলিফার দরবারে একাই হাজির হলেন। খলিফা তাকে বললেনÑ

-কিহে আব্বাস, তুমি একা কেন? তোমার কাছে যাকে জিম্মা রেখেছিলাম সে কি পালিয়ে গেছে?

আব্বাস চুপ করে থাকলেন। খলিফা বললেন, লোকটা যদি পালিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তোমাকেই তার শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর এর নির্ধারিত শাস্তি হলো মৃত্যুদ-। এখন তোমার কিছু বলার থাকলে বলো। পরিবারের কাউকে অসিয়ত করার থাকলে তাদের ডেকে এনে করে যাও।

আব্বাস বললেন, পরিবারের কারও সঙ্গে আমার কোন কথা নেই। কথা শুধু আপনার সাথে। মেহেরবানী করে যদি আমাকে বলতে দেন বলবো, না হলে জল্লাদের তরবারীর নিচে মাথা পেতে দিবো।

খলিফা বললেন, বলো তুমি কি বলতে চাও?

আব্বাস বললেন, যে ব্যক্তি এক মাস তার বাড়িতে রেখে আমার জীবন বাঁচাতে পারে, খলিফার সম্মান রক্ষার্থে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন, সে আপনার বিরোধিতা করতে পারে না। তা ছাড়াও আমি তাকে মুক্ত করে দিয়েছিলাম, সে যায়নি। বলেছে যার জীবন আমি আল্লাহর রহমতে বাঁচিয়েছি আমার জীবনের জন্য তার জীবন বিপন্ন করতে পারি না। খলিফা বললেনÑ

তোমার কথা শোনে মনে হচ্ছে লোকটা সৎ। সৎ মানুষ পুরস্কৃত করাই খলিফাদের ধর্ম। যাও অশ্বশালা থেকে লোকটার জন্য দশটি তেজি ঘোড়া আর খাজাঞ্জিখানা থেকে সহ¯্র স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে আস। আজই তাকে আমি সসম্মানে বিদায় দিতে চাই।

আব্বাস বললেনÑ মহান আল্লাহ আপনার রাজ্যের সীমানা আরও বাড়িয়ে দিন। আপনাকে দীর্ঘায়ু করুন।

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ