রবিবার ০৫ মে ২০২৪
Online Edition

সিলেটে হিজড়াদের দৌরাত্ম্যে নাজেহাল নগরবাসী

সিলেট ব্যুরো : সিলেটে হিজড়াদের দৌরাত্ম্যে নাজেহাল নগরবাসী। রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, বাসা-বাড়ি, দোকানপাট যেখানে-সেখানে টাকার জন্য মানুষকে নাজেহাল করছে সংঘবদ্ধ হিজড়া দল। তারা বাসা-বাড়িতে জোর করে ঢুকে টাকা-পয়সা, এমনকি শৌখিন জিনিসপত্র কেড়ে নিচ্ছে। আগে মানুষ যা দিতো, তা নিয়েই খুশি থাকত হিজড়ারা। কিন্তু ইদানীং তাদের আচরণ বদলে গেছে। তাদের দাবির পরিমাণ অর্থ না দিলে বিশৃঙ্খলা শুরু করে।
গত রোববার বিকেলে নগরীর আম্বরখানা এলাকায় মালবাহি ট্রাক আটকে দাবি করে তাদেরকে বকশিস হিসেবে এক কার্টুন তেল দিতে। এতেই ক্ষান্ত হয়নি ইট দিয়ে মিনি ট্রাকটির গ্লাস ভেঙে দেয়। পথচারিদের নাস্তানাবুদ করে হিজড়া দল। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসলে হিজড়ারা পুলিশকেও নাজেহাল করে। প্রদর্শন করতে থাকে নগ্ননৃত্য আর অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ।
এভাবে মহানগরীসহ সিলেটজুড়ে সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হিজড়া দল। বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নামে বিভক্ত হয়ে অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে সর্বত্র চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। এজন্য তারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর সর্বত্র রয়েছে এদের নেটওয়ার্ক। বিভিন্ন বাস কাউন্টারসহ বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের পাশাপাশি বাসা-বাড়ি, অফিসে তারা টাকা তুলছে। নগরের কদমতলী বাস টার্মিনাল, হুয়ায়ুন রশীদ চত্ত্বর, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, আম্বরখানা, রিকাবীবাজার, তালতলা, লামাবাজার, মেডিকেল রোড, সুবিদবাজার, কুমারপাড়া, নয়াসড়ক, টিলাগড়, শিবগঞ্জ, উপশহর, মেন্দিবাগ, সোবহানিঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় হিজড়াদের চাঁদাবাজি চলছে। আর এসব নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কদমতলীস্থ ‘কুইন্স টাওয়ার’ থেকে। সেখানে একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন হিজড়াদের দলপতি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, হিজড়ারা রাতের বেলায় ছিনতাই, মাদক সেবন ও বিক্রিসহ অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে। সুযোগ বুঝে এরা পথচারী, রিকশারোহীদের টাকা ও মোবাইল সেট জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পাশাপাশি রাতে হিজড়ারা পুলিশের সোর্স হিসেবেও কাজ করে। রাতে নীরিহ পথচারীদের আটকিয়ে হয়রানি করে থাকে। কেড়ে নেয় মোবাইল ফোন, টাকা পয়সাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। বাধা দিলে জোর করে পকেটে মাদক ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশের কাছে তুলে দিচ্ছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, ট্রাফিক সংকেতে যানবাহন থামার পর হিজড়ারা সামনে এসে দাঁড়ালে যাত্রীদের কিছু করার থাকে না। তাদের সঙ্গে তর্ক করলে যাত্রীদের আরো বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। নগরীর জিন্দাবাজারে যানজটের আটকা পড়ে যানবাহন। এ সময় হামলে পড়ে একদল হিজরা। রিকশা ও গাড়ীতে থাকা যাত্রীদের কাছে দাবি করে টাকা। তাদের চাহিদা মোতাবেক টাকা না দেয়াতে যাত্রীদের গালাগালি শুরু করে। এ রকমই হিজড়াদের অত্যাচার ও গালাগালি শুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই নগরীতে ঘটছে।
এমনই একজন ভুক্তভোগী জানান, সকালে দারোয়ান প্রধান গেইট খোলা রাখেন। এই সুযোগে ৫ জন হিজড়া এসে হাজির। শুরু করে হট্টগোল। তখন ৫ হাজার টাকার একটি ‘বকশিশ স্লিপ’ ধরিয়ে হুমকি দেয় টাকা না দিলে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করার। বাসায় একা থাকায় পরে বাধ্য হয়ে ২ হাজার টাকা বের করে দিলে রেগে গিয়ে বলে ‘ভিক্ষা দিচ্ছিস নাকি রে, পুরো পাঁচ দে, নইলে আজেবাজে কথা বলে গালি দিয়ে হিজড়ারা টানাহেঁচড়া করে। এই অবস্থায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যাই। পরে বাড়িভাড়ার জমানো টাকা থেকে তাদেরকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে কোনো মতে বিদায় করি।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হিজড়াদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্বিঘ্ন চাঁদাবাজিতে অল্প সময়েই ধনাঢ্য হয়ে ওঠার বাসনায় ইদানীং পুরুষরা অপারেশনের মাধ্যমে নকল হিজড়ায় পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে এক শ্রেণির পতিতাও হিজড়া সংগঠনে ঢুকে পড়েছে। সাজগোজ করে তারাও হিজড়া হয়ে যাচ্ছে। এসব ভুয়া ও নকল হিজড়াদের অত্যাচার মাত্রাতিরিক্ত বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এলাকার আধিপত্য ও চাঁদাবাজি নিয়ে মাঝেমধ্যেই হিজড়া গ্রুপগুলো সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এসব বিরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় এসএমপির বিভিন্ন থানায় মামলা ও জিডি হয়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেট হিজড়া কল্যাণ সংস্থার সভাপতি সুন্দরী হিজড়া জানান, নগরীতে কিছু নকল হিজড়া রয়েছে। তাদের বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন সিলেটের অধিকাংশ লোকজন। এরা আমাদের হিজড়া কল্যাণ সংস্থার কেউ না। আমাদের সংগঠনের কোন সদস্য চাঁদাবাজির সাথে জড়িত নয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসীদের আশ্রয়সহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছে অনেক হিজড়া। সিলেটে হিজড়ারা কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের দলনেতাও আলাদা আলাদা। হিজড়াদের মধ্যে কারো কারো রয়েছে অঢেল সম্পদ। এমনই একজনের নাম হিজড়া সুন্দরী। সে হিজড়াদের একটি সংগঠনের সিলেট বিভাগীয় সভাপতি। থাকে কদমতলীস্থ ‘কুইন্স টাওয়ারে’। রয়েছে অভিজাত ফ্লাট। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রন করে পুরো মহানগরীর হিজড়াদের। তার অধীনে রয়েছে অন্তত শতাধিক হিজড়া। ওই ফ্লাটে তার কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগীদের নিয়ে তাকে হিজড়া সুন্দরী। সেখানে চলে মাদক ব্যবসা-সেবন ও দেহ ব্যবসা। এছাড়াও ওই ফ্লাটে অনেক মানুষকে জিম্মি করে আদায় করা হয় মোটা অংকের মুক্তিপন। হিজড়া সুন্দরী কয়েক বছরের ব্যবধানেই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনেছেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে সুদে লাগানো আছে তার লাখ লাখ টাকা। কয়েক কোটি টাকা দামে বাড়ি বা ফ্লাট কেনার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এসব তথ্য মিলেছেন তারই ঘনিষ্টজনদের কাছ থেকে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) বি.এম আশরাফ উল্যাহ তাহের জানান, হিজড়াদের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ এলেও মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তবে কেউ যদি ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধ করে তাহলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ