শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

করোনা মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য এখন সময়ের দাবি

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল: করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য এখন সময়ের দাবি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনিহার কারণেই এই ঐক্য এখনো গড়ে উঠছে না। তারা বলছেন, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যখন এ দাবি জানাচ্ছে তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। তারা জাতীয় ঐক্য না গড়ে বরং প্রতিপক্ষকে সমালোচনা করছে। সম্প্রতি দেশের বৃহত্ত্র রাজনীতিক জোটের নেতৃত্বে থাকা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন। একই দাবি জানিয়েছে ২০ দলীয় জোটও। ঐক্যের দাবি আসছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। কিন্তু সরকার সেটিকে আমলে নিচ্ছে না। বরং যারা জাতীয় ঐক্যের আহবান জানাচ্ছেন তাদের সমালোচনা করছেন।
করোনা মোকাবিলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানিয়েছে ২০ দলীয় জোট। গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়কারী ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ আহবান জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা বিশে^র সকল ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-পেশার মানুষ আজ এক দুঃসহ সংকট মোকাবিলা করছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে এই মহামারীর ব্যাপকতা ক্রমেই বাড়ছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জনজীবন বিপর্যস্ত ও স্থবির হয়ে পড়েছে। এই দুঃসময়ে দেশের সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, শ্রেণী-পেশার সংগঠন অর্থাৎ সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে। করোনার প্রভাব ও বিস্তৃতি সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য প্রকাশে এবং এই মহা দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও বাস্তবতার পার্থক্যে জনগণ ক্ষুব্ধ এবং এই মহামারী প্রতিরোধে যথাসময়ে যথাযোগ্য প্রস্তুতি গ্রহণে সরকারী উদ্যোগের অভাবে বিপন্ন।
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতিতে ২০ দলীয় জোট সারাদেশে জোটভুক্ত সকল দলের নেতাকর্মীদের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানাচ্ছে। জনগণকে স্বাস্থ্য সচেতন করা, রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হতে সাহায্য করা এবং দরিদ্র জনগণকে খাদ্য, চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের আহবান জানাচ্ছে। পাশাপাশি দেশবাসীকে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এবং দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ মানা এবং পরম করুণাময় আল্লাহর রহমত কামনার জন্যও ২০ দল সকলের প্রতি আহবান জানাচ্ছে।
দেশের করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি উত্তরণে দলমতের ঊর্র্ধে উঠে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা: শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় জামায়াতে ইসলামী জাতীয় স্বার্থে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে-বিদেশে যে সব বাংলাদেশী নাগরিক ইন্তিকাল করেছেন তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোকবাণীতে তিনি এই আহবান জানান।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জাতীয় কমিটি গঠন করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরার বাসায় কয়েকটি গণমাধ্যমের সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি এই মন্তব্য করেন। ফখরুল বলেন, আমরা এই কথাটা বার বার বলেছি যে, আমরা কখনোই সমালোচনার জন্য সমালোচনা করছি না, আমরা সরকারকে সাহায্য করতে চেয়েছি। আমরা বলেছি যে, ত্রুটি নয়, এটাকে দেখিয়ে দিয়ে আসুন আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করি, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছি। তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত একটা জাতীয় কমিটি তৈরি হয়নি। যেটা করা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ তো একশ ৬০ মিলিয়নের দেশ। এখানে একেবারের নিচের দিককার অর্থনীতি। সেখানে এই ধরনের সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে যদি একটা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা যায় সেটাই হবে দেশের জন্য ভালো কাজ। আমরা মনে করি, এখনো সময় আছে জাতীয় কমিটি করা দরকার, এটা গঠন করা উচিত।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অভাবনীয় সংকটে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক আ স ম আবদুর রব। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস কারণে জাতি হিসেবে আমরা এক অভাবনীয় সংকটের সম্মুখীন হয়েছি। এর তীব্রতা এবং বিস্তৃতি আমাদের জাতিকে এখন এক মৌলিক আর দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমরা কি এই বিপত্তি মোকাবিলার জন্য আবার জাতি হিসেবে ১৯৭১ সালের মতো একতাবদ্ধ হতে পারি না?
তিনি বলেন, আমরা ৭১- এ এ রকম ঐক্যই গড়ে তুলেছিলাম। আমরা সকলে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যাইনি, দেশের ভেতরে থেকেও স্ব স্ব অবস্থানে হতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছি। তেমনি আজও সকলের রাস্তায় বেরিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে না, কায়মনোবাক্যে আমাদের এই প্রয়াসে নিজেকে শামিল করতে হবে। আব্দুর রব আরও বলেন, সরকার আর ক্ষমতাসীন দলকে এই উদ্যোগের কান্ডারি হতে হবে। তাদেরকে সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, একক ব্যক্তি, সব শ্রেণি-পেশা দল-মত ও সর্বস্তরের জনগণকে একই প্লাটফরমে এসে এই বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য খোলা মন নিয়ে আহ্বান করতে হবে।
বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাংলাদেশের জনগণকে রক্ষায় সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার বলে মনে করে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এ জন্য সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক করে সবার মতামত নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। বাম জোটের সমন্বয়ক ও বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম, আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু, বাসদ (মার্কসবাদী) নেতা মানস নন্দী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির আকবর খান, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির শহিদুল ইসলাম সবুজ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী সম্প্রতি এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, শুরু থেকেই সরকার এ মহামারীকে গুরুত্ব না দেয়ায় গত ৩ মাসেও তেমন কোনো প্রস্তুতি যে নেয়নি তা দেশের একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানে করোনা পরীক্ষা এবং সেখানকার মুখপাত্র আক্রান্ত ও মৃতের যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে তা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে। দেশবাসী সরকারি ওই ভাষ্য একদমই বিশ্বাস করছে না।
বাম জোট নেতৃবৃন্দ পুনরায় সারাদেশে অন্তত প্রত্যেক জেলায় করোনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপন করে রেনডমভাবে পরীক্ষা করে সঠিক তথ্য জনগণকে জানানো এবং সচেতনতা গড়ে তুলে প্রতিরোধে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। নেতৃবৃন্দ বলেন, তথ্য গোপন করে বরং বিপদকে বাড়িয়ে দেয়া হবে। এতে জনগণ অসতর্ক থাকবে এবং অপঘাতে মৃত্যু ঘটবে।
দেশে করোনা মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে শারীরিক দূরত্ব বজায়ের পাশাপাশি সামাজিক সংঘবদ্ধতা সক্রিয় করা জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান। নেতারা বলেন, গত ডিসেম্বরে চীনে শনাক্ত হওয়া করোনা ভাইরাসের রোগটি দুইমাস পর বাংলাদেশে হানা দিয়েছে। এ পর্যন্ত সীমিত সংখ্যক রোগী শনাক্ত হলেও কিছুদিনের মধ্যে অন্যান্য দেশের মত এখানেও ব্যাপক সংখ্যায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রোগতত্ত্ববিদরা সে রকমই আভাস দিচ্ছেন। নেতারা বলেন, সে ধরনের পরিস্থিতিতে রোগটি ছড়িয়ে পড়া ও মহামারি ঠেকাতে বিলম্বিত করতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখায় হচ্ছে প্রধান কৌশল। কিন্তু সেটি নিশ্চিত করতে হলে পারিবারিক ও সামাজিক সংঘবদ্ধতা আরও সুদৃঢ় ও সংহত করা জরুরি। এজন্যে সরকার ও সমাজের স্বচ্ছল গোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে। বিবৃতিতে নেতারা বলেন, আমরা সরকারকে সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী-শ্রমজীবী শক্তিসমূহকে সংঘবদ্ধ করার উদ্যোগ নেবার আহ্বান জানাচ্ছি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মনে করি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সমগ্র বিশ্ব বর্তমানে মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। করোনাভাইরাস একটি অজানা রোগ। এই ভাইরাস সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনাভাইরাস আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে সমগ্র বিশ্ব মানবতা একই পরিবারভুক্ত। এখানে কেউ নিজেকে আলাদা করতে পারবে না। সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের অনেক কর্তব্য ও দায়িত্ব রয়েছে। সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য হচ্ছে মানুষকে করোনাভাইরাসের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। আরও আগে থেকেই সরকারের প্রস্তুতি নেয়া উচিত ছিল। এখন শুধু সরকারের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলেই আমাদের চলবে না। আমাদের প্রথম কাজ হলো পরস্পর থেকে দূরে থাকা।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল সভাপতি বদরুদ্দীন উমর করোনাভাইরাস প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি হিসেবে ঘোষণার পর দেশে দেশে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় বিভিন্ন রাষ্ট্র জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তাই বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশকেও জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করতে হবে। সব দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এই ভাইরাস মোকাবিলায়। এ ছাড়া সরকারের কাছে তিনি জরুরি ভিত্তিতে ৪০ হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দের আহ্বান জানিয়েছেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ