বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪
Online Edition

স্বাধীনতার চেতনা ও আজকের তরুণ স্বপ্নের সন্ধানে

আখতার হামিদ খান : “মোদের সাক্ষাৎ হলো অশ্লোষার রাক্ষষী বেলায় সমুদ্যত দৈব দুর্বিপাকে”
(দু:সময়/ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)
গ্র্যাজুয়েশনের সিঁড়িতে দাঁড়ানো এক তরুণ কথাপ্রসঙ্গে আমাদের এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “আচ্ছা, আপনারা ১৯৭১ আর স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো অতীত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না কেন? কেন শুধু শুধু স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে এতে আলোচনা? আমাদের দেশে কি এছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই? জাতির পিতা আর স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে এতো মাথা ব্যথাই বা কেন?
আমার বিচক্ষণ বন্ধু তার স্বভাবজাত উদারতার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে এসে অনেকটা চিৎকার করেই যখন সেই তরুণের সাথে আলাপচারিতা করছিলেন তখন তার চোখে-মুখে ক্রোধের চিহ্ন, হতাশার মলিন ক্ষত। তার চোখে সেই তরুণটি তখন অনেকটা দেশদ্রোহীর কাঠগড়ায়।
মাঝে মাঝে খুঁজে বের করতে ইচ্ছা করে, কেন এমনটি হয়।
আজকের যে তরুণ একাত্তরে তার জন্মই হয়নি। তবুও সেই অনাগত সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার যে পূর্বপুরুষ জীবন দিলো তা তার কাছে কেন অর্থহীন অতীত বলে মনে হবে?
বাঙালির জীবনের সবচাইতে গৌরবের দিনগুলো, আনন্দ-বেদনার মিশেল দেয়া সেই হিরন্ময় সময়, একটি জাতির জন্ম মুহূর্তের তীব্রতম যন্ত্রণা কি তবে শুধুই একটি জেনারেশনের আবেগ হয়েই থাকবে? আসলেই কি অর্থহীন অতীত বলে মনে হবে?
বাঙালির জীবনের সবচাইতে গৌরবের দিনগুলো, আনন্দ-বেদনার মিশেল দেয়া সেই হিরন্ময় সময়, একটি জাতির জন্ম মুহূর্তের তীব্রতম যন্ত্রণা কি তবে শুধুই একটি জেনারেশনের আবেগ হয়েই থাকবে? আসলেই কি অর্থহীন সব বিতর্ক? আমাদের তরুণ প্রজন্ম কি ভুলে যেতে বসেছে তার পিতার আত্মত্যাগের কথা, তার মায়ের সম্মান বিসর্জনের বিষাক্ততা?
যদি তাই হয় তবে এ কার পাপ? কেন এমন হলো। সাদাদের দাস হয়ে আমেরিকায় চলে আসা কালো মানুষ আজ যখন তার ‘রুটস’ এর সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশাল কালো আফ্রিকার প্রতিটি অন্ধকার অরণ্যে তখন আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি ভুলে যেতে চাইছে তার ঠিকানা, তার উৎসমূল, তার শুদ্ধ সাহসী পদপাত, স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে তার বেড়ে-ওঠা?
“পুরো পেঁচারা সব কোটরের থেকে
এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে”
(অবসরের গান/ জীবনান্দ দাশ)
একাত্তরের দিনগুলোতে যারা ছিল বাঙালির প্রতিপক্ষ, যারা পরাজিত হয়েছিল সেদিনের ফুঁসে ওঠা তারুণ্যের শৌর্য-শক্তির কাছে, মানুষের যুথবদ্ধতার কাছে তারা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করেছে। তাদের পরাজয়ের হাতড়ে খুঁজে বের করেছে। তাদের পরাজয়ের মূল কারণ হচ্ছে বাঙালির মিলনের সূত্র, ঐক্যবদ্ধতার মন্ত্র, সাহসী হয়ে ওঠার আশ্চর্য কৌশল।
পরাজিতরা জেনেছে তাদের হার মানতে হয়েছিল এক শক্তিশালী ও সুন্দরতম স্বপ্নের কাছে। যে স্বপ্ন মানুষকে সাহসী করে তোলে, ভালবাসতে শেখায় নিজেকে এবং স্বজাতি ও স্বজনকে।
পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা খুঁজে খুঁজে ঠিকই বের করেছে, শেখ মুজিব নামের দীর্ঘদেহী মানুষটির মেধা, বিচক্ষণতা আর সাংগঠনিক ক্ষমতার চাইতেও বেশি শক্তিশালী ছিল তাঁর চোখের অনন্ত স্বপ্ন। যে স্বপ্ন তিনি দেখতেন তা বিশ্বাস করতেন, স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ করতেন।
সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তিনি তার স্বপ্নকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙা-চোরা মানুষটির গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখে। সে স্বপ্নের নাম স্বাধীনতা।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের জন্য জাতিকে ধাপে ধাপে প্রস্তুত করেছিলেন। এই প্রস্তুতির যাত্রা শুরু ভাষা আন্দোলন থেকে, বিকাশ প্রতিকূল রাজপথে সংগ্রামের অন্তবিহীন ধারায়, পাশাপাশি বাঙালির উদ্বেল মনোজগতে।
ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে শুধু তাঁর নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকারই দেয়নি, দিয়েছিলাতার সাহিত্য নির্মাণের প্রেরণা, শিল্পকলা-সঙ্গীতসহ সংস্কৃতির প্রতিটি কণ্ঠস্বরে তাঁর নিজস্ব ভাষা। ঠিক এখানেই ছিল বাঙালির মিলনের সূত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল উৎস। সে কারণেই আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে শঠতা এবং চাতুর্যের সাথে বন্দি করা হয়েছে মাত্র সাড়ে নয় মাসের সীমাবদ্ধ মলাটে।
একটি নিরস্ত্র জাতি কোন মন্ত্রের প্রেরণায় সশস্ত্র হয়ে উঠলো তা চলে গেছে পিছনে। তেইশ বছরের প্রস্তুতিপর্ব হয়ে পড়েছে মূল্যহীন। মুক্তিযুদ্ধ, যা ছিল ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জনযুদ্ধ তাকে ক্ষুদ্র ও খ-িত করে দেখানোর স্বার্থে অস্বীকার করা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে, চেতনা বিকাশের অনুচক্রের পারস্পর্যকে এবং আবিষ্কার করা হয়েছে “সব ভুলে যাওয়ার তত্ত্ব”। সবাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা নাব লে দার্শনিক উদাসীনতায় বলা হচ্ছে, এতদিন পর পুরনো কথা তুলে লাভ কী?
আবার কেউ কেউ বলছেন, “দেশটাতো সবার। মুক্তিযুদ্ধ-রাজাকার বিভেদ না করে আসুন ভবিষ্যতের জন্য কাজ করি।”
স্বাভাবিকভাবেই যে তরুণ মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, একাত্তরের আগুনের পরশমণি যাকে স্পর্শ করেনি সে সরলমনেই গ্রহণ করেছে এই তথাকথিত নিরপেক্ষতা। সেই তরুণের মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক বিমূর্ত বিষয় যা তাঁর ভবিষ্যতের জন্য কিছুই দেবে না। তার কাছে ইতিহাসের পাঠোদ্ধারকে মনে হয়েছে অতীতমুখিনতা। আমাদের রাজনীবিদ আর বুদ্ধিজীবীগণ তারস্বরে ভাষণ দিয়েছেন কিন্তু এই তরুণের মানসিকতাকে ছুঁতে পারেননি, তাঁকে আন্দোলিত করতে পারেননি।
সে কারণেই, আমাদের তরুণের মনোজগতে নায়কের আসে চে গুয়েভারার রোমান্টিক ছবি থাকলেও মেজর হায়দারের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা তার কাছে এক অচেনা মানুষ।
ঢাকা শহরের ক্র্যাক প্লাটুনের বীরত্ব তার কাছে অজ্ঞাত। দেশের আনাচে-কানাচে সংঘটিত সেই ভয়াবহ লড়াই আর জয় বাংলার স্বপ্ন মাতাল মুক্তিযোদ্ধার গল্প সে জানে না।
একদিন, দু’দিন নয়। ১৯৭৫ এর পর থেকেই এই ধারাবাহিক মগজ ধোলাই চলে আসছে। যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ছিল মুক্তিযুদ্ধের অর্জন সেই দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। ভোটের বাক্সের ভানুমতির খেলায় জিতে একাত্তরের ঘাতক আজ পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় এই দেশে।
পরাজিত শক্তি ফিরিয়ে আনতে চায় এক তালিবানী অন্ধকার যেখানে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে আধুনিকতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এমনকি প্রযুক্তির নিত্যনতুন বিকাশের ধারা।
অন্যদিকে যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবি করেন তারা এমন ভাষায় কথা বলে যাচ্ছেন যা এই তরুণের কাছে দুর্বোধ্য।
‘তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা বাংলাদেশ?’
তাহলে পরিত্রাণের উপায় কী?
আমরা কি শুধু ইতিহাস বিকৃতিকে দায়ী করে উটপাখির মতো মরুভূমিতে মুখ গুঁজে থাকবো? ভবিষ্যতে প্রজন্ম কি জানবে না কীভাবে এদেশ তাদের হলো? বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুধারা কি তার কাছে কোনও মূল্যই বহন করবে না?
অবশ্যই বহন করবে। কারণ, আজকের তরুণের আছে একটি যুক্তিনিষ্ঠ চেতনার রন্দ্রে রন্ধ্রে অমোঘ এক দেশপ্রেমিক সত্তা। সে হিপোক্রেট নয়, মতান্ধ নয়; ধর্মান্ধ তো নয়ই।
মুক্তিযুদ্ধকে তার কাছে নিয়ে যেতে হবে তার নিজস্ব চেনা পথে, অতীতকে তার কাছে উপস্থাপন করতে হবে আগামীর বুনিয়াদ হিসেবে। অযুত শহীদের যে উত্তর পুরুষ আজও একটি সুন্দর সম্ভাবনাময় দেশের স্বপ্ন দেখে তার সে স্বপ্নকে শ্রদ্ধা করতে হবে। তাকেই বলতে দিতে হবে, সে কেমন বাংলাদেশ চায়। এ জন্য শুধু প্রয়োজন একটি জিনিসের- তাকে কথা বলতে দিতে হবে। শুনতে হবে তার স্বপ্নের কথা, স্বপ্নভঙ্গের কথা, তার কাঙ্কিত পৃথিবীর কথা। নিজের প্রতি সৎ সেই তরুণই একদিন বোধের অনিবার্যতায় আবার খুলে ফেলবে ইতিহাসের বন্ধ দরোজা। ভবিষ্যতের আলোর ঝলকানি তাকে তার ‘রুটস’ চেনাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারাদেশ ঘুরে বাঙালির দু:খ-সুখের কথা শুনেছিলেন, বাঙালি তরুণের নাড়ির স্পন্দন ধরতে পেরেছিলেন। মহাসামুদ্রিক উত্তাল জোয়ারের মতো তার পিছনে কাতারবন্দি হয়েছিল সেদিনের তরুণরা ফিরে এসেছিল প্রত্যাশিত স্বাধীনতা নিয়ে।
আজকের তরুণের সব আছে। আবেগ আছে, মেধা আছে, সংবেদনশীলতা আছে, একটি মানবিক মনোভূমি আছে।
এখন শুধু অপেক্ষার পালা।
আমরা অপেক্ষায় কান পেতে আছি, চেতনার গহনদ্বারে কড়ানাড়ার শব্দ শোনার জন্য।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ