রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতায় স্বর্ণের দাম লাগামহীন

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: লাগামহীন হয়ে পড়েছে দেশের স্বর্ণের বাজার। ব্যবসায়ীরা স্বর্ণের দাম ইচ্ছামতো বাড়াচ্ছেন। স্বর্ণের দাম বাড়ানোই রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে লাগামহীনভাবে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে চলতি মাসের ১৮ দিনেই বেড়েছে তিন দফা। গত দেড় মাসে স্বর্ণের দাম বাড়নো হয়েছে পাঁচবার। এখন ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম প্রায় ৫৭ হাজারে ঠেকেছে। ফলে চলতি বছরে পাঁচবারে ভরিতে প্রায় ৬ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির যুক্তি দেখাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিলেও এটা তাদের বেশি লাভের প্রবণতার ফল। এছাড়াও স্বর্ণের বাজার এখনও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
জানা গেছে, বর্তমানে স্বর্ণের দামে রেকর্ড গড়েছে। সর্বশেষ চলতি মাসের ১৮ তারিখে স্বর্ণের দাম বাড়িয়েছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। এতে গত দেড় মাসে তারা স্বর্ণের দাম বাড়ালো পাঁচবার। এবারও প্রতি ভরি স্বর্ণে ১ হাজার ১৬৭ টাকা বাড়িয়ে নতুন দর নির্ধারণ করেছে সংগঠনটি। ফলে এখন ২২ ক্যারেটের এক ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম পড়বে ৫৬ হাজার ৮৬২ টাকা। এর আগে ছিল ৫৫ হাজার ৬৯৫ টাকা। ইতোমধ্যে স্বর্ণের এ নতুন দর কার্যকর করেছে ব্যবসায়ীরা। এখন থেকে ২২ ক্যারেটের প্রতি গ্রাম স্বর্ণ ৪ হাজার ৮৭৫ টাকা করে বিক্রি করা হবে। ২১ ক্যারেটের প্রতি গ্রাম স্বর্ণ বিক্রি করা হবে ৪ হাজার ৬৭৫ টাকা। ফলে ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরির দাম পড়বে ৫৪ হাজার ৫২৯ টাকা। ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণ প্রতি গ্রাম বিক্রি করা হবে ৪ হাজার ২৪৫ টাকায়, এতে প্রতি ভরির দাম পড়বে ৪৯ হাজার ৫১৩ টাকা। এ ছাড়া সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি গ্রাম স্বর্ণ বিক্রি করা হবে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে, এতে প্রতি ভরির দাম পড়বে ২৯ হাজার ১৬০ টাকা। এর আগে সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ২৭ হাজার ৯৯৩ টাকা।
স্বর্ণের দাম বাড়ানো হলেও কিছুটা কমেছে রুপার দাম। ২১ ক্যারেটের প্রতি গ্রাম রুপার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ টাকা। এতে প্রতি ভরির দাম ৯৩৩ টাকা। আগে ছিল প্রতি ভরি রুপার দাম ১ হাজার ১৬৬ টাকা।
বাজুস জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমাগত স্বর্ণের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ফলে দেশীয় বুলিয়ান মার্কেটে স্বর্ণের দাম বাড়ায়, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের সর্বসম্মত মতামতের ভিত্তিতে দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাজুস বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে গত এক দশকের মধ্যে স্বর্ণের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এর প্রেক্ষিতেই দফায় দফায় বাড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
এর আগে গত ৭ আগস্ট বাজুস স্বর্ণের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়, যা কার্যকর হয় গত ৯ আগস্ট থেকে। ওই দাম বাড়ানোর ফলে ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ৫৫ হাজার ৬৯৫ টাকা, ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণ ৫৩ হাজার ৩৬২, ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণ প্রতি ভরি ৪৮ হাজার ৩৪৭, সনাতন পদ্ধতিতে স্বর্ণ প্রতি ভরি ২৭ হাজার ৯৯৩ এবং ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি রুপা ১ হাজার ১৬৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।
গত ৫ আগস্টও আরেক দফা দাম বাড়ানো হয়। সে সময় ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণ ৫৪ হাজার ৫২৯ টাকা, ২১ ক্যারেট ৫২ হাজার ১৯৬ এবং ১৮ ক্যারেট ৪৭ হাজার ১৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া সনাতন পদ্ধতিতে স্বর্ণের দাম ২৭ হাজার ৯৯৩ টাকা এবং ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি রুপার দাম ৯৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর আগে গত মাসের ২৩ ও ৩ জুলাই দুই দফা দাম বাড়ানো হয়।
গত দেড় মাসে স্বর্ণের দাম পাঁচবারে ভরিতে প্রায় ৬ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার বছরের শুরুতে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরি ছিলো ৪৮ হাজার ৯’শ ৮৮ টাকা, এখন দাম ৫৬ হাজার ৮’শ ৬২ টাকা। গত সাড়ে ৭ মাসে ৮ দফা স্বর্ণের দাম বেড়েছে। এরইমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে গত ৭ বছরের সর্বোচ্চ দরের রেকর্ড।
এর আগে নতুন বছরের প্রথম দিনেই স্বর্ণের দাম বাড়ার ঘোষণা দিয়েছিল বাজুস। সে সময় ২২ ও ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণ প্রতিভরিতে বাড়ানো হয় ১ হাজার ৫১৬ টাকা। আর ২১ ক্যারেট স্বর্ণ প্রতিভরিতে বাড়ানো হয় ১ হাজার ৪৫৮ টাকা। তবে অপরিবর্তিত ছিল সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ ও রূপার দাম। সে সময় ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের প্রতিভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ৪৮ হাজার ৯৮৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ২১ ক্যারেট ৪৬ হাজার ৬৫৬ টাকা এবং ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪১ হাজার ৬৪০ টাকা। আর প্রতিভরি সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ অপরিবর্তিত রেখে নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ হাজার ৫৮৫ টাকা। প্রতিভরি ২১ ক্যারেট রূপা (ক্যাডমিয়াম) দাম ছিল এক হাজার ৫০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক স্বর্ণের বাজারে। ফলে দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। তবে, ব্যবসায়ীদের এই যুক্তি মানতে পারছেন না অর্থনীতিবিদিরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিলেও এটা তাদের বেশি লাভের প্রবণতার ফল। স্বর্ণের বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আমদানি প্রক্রিয়া দ্রুত চালু করতে হবে। স্বর্ণের বাজার এখনও সরকারের নিয়ন্ত্রেণের বাইরে। দেশে কি পরিমাণ স্বর্ণ রয়েছে তার হিসাবও নেই। অভিযোগ রয়েছে, দেশে যে পরিমাণ স্বর্ণ কেনাবেচা হয় তার অন্তত ৮০ ভাগই আসে চোরাই পথে, যা থেকে সরকার কোনো শুল্ক পায় না।
এদিকে মার্চে স্বর্ণ আমদানির নিয়ম রেখে চূড়ান্ত করা হয় নীতিমালা। এরইমধ্যে আমদানির জন্য ডিলার নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি শুরুর আগে বাজারে স্বর্ণের সরবরাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে নিলামে স্বর্ণ বিক্রির কথা থাকলেও, তা চালু হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, এখন আমাদের যে পর্যায়ের স্বর্ণ আছে সেগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে, তবে সে বিষয়ে এখনো ফয়সালা হয়নি। সুতরাং, নিলামে বিক্রি করার মতো স্বর্ণ এখনো আমাদের নেই।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এনামুল হক খান বলেন, স্বর্ণের দাম বাড়ার সাথে সাথে যদি না বাড়ানো হয় তাহলে দেশ থেকে স্বর্ণ পাচার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর দাম কমার সাথে সাথে যদি তা কমানো না হয়, তাহলে গ্রাহক পাশ্ববর্তী দেশ থেকে নেবার প্রবণতা থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, বৈধ পথে স্বর্ণ আনার জন্য যেহেতু নজরদারি বেড়েছে এবং করের বিষয়টি এসেছে। যে কারণে সম্পূর্ণ বিষয়টি ক্রেতার ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ভরিতে এক হাজার টাকা দিয়ে অঘোষিত কিংবা মজুতকৃত স্বর্ণ শর্তসাপেক্ষে বৈধ করা যাবে। স্বর্ণ বৈধ করতে আয়কর ১ হাজার টাকা ধার্য করে গত মে মাসে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছিলেন এনবিআরের চেয়ারম্যান ও সিনিয়র সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রতি ভরি স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কারে ১ হাজার টাকা, হীরায় ৬ হাজার ও রুপায় ৫০ টাকা আয়কর দিতে হবে। শর্তগুলো হলো- ব্যবসায়ীকে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নিতে হবে এবং রিটার্ন দাখিল করতে হবে। ৩০ জুনের মধ্যে অঘোষিত ও মজুত স্বর্ণ, রুপা ও হীরা সম্পর্কে ঘোষণা দিয়ে কর দিতে হবে। অবৈধ্য স্বর্ণ বৈধ্যও হয়েছে কিন্তু এতো কিছুর পরেও স্বর্ণের দাম কমেনি বরং বেড়েই চলেছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ