রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

জালিমের কারাগারে শহীদ হয়েছেন মুরসি----এরদোগান

১৮ জুন, আল জাজিরা, এএফপি, চ্যানেল নিউজ এশিয়া, আনাদুলো এজেন্সি : মিসরের ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান। গত সোমবার ইস্তাম্বুল থেকে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে তিনি বলেন, জালিমের কারাগারে শহীদ হয়েছেন মুরসি। কারাগারে নিক্ষেপ করে যারা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে সেই জালিমদের ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না।

এরদোগান বলেন, আমাদের চোখে মুরসি একজন শহীদ; যিনি তার বিশ্বাসের জন্য জীবন দিয়েছেন। ইতিহাস সেই একনায়ককে (জেনারেল সিসি) ক্ষমা করবে না, যে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে নির্যাতন করেছে এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার যাবতীয় চক্রান্ত করা হয়েছিল। আদালতে নিজের ওপর জুলুমের প্রতিবাদ করেছেন তিনি। মিসরের জনগণও নিজের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর মুরসির এ মৃত্যু জুলুমের সাক্ষী হয়ে থাকবে।

তিনি বলেন, মিসরীয়দের মুক্তির জন্য শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মুরসি যে সংগ্রাম করে গেছেন তা যুগ যুগ ধরে মুসলমানরা স্মরণ করবে। তুর্কী প্রেসিডেন্ট বলেন, আদালতের এজলাসে তার মৃত্যু হয়েছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আল্লাহ তাআলার দরবারে আমাদের শহীদ ভাইদের জন্য রহমত কামনা করছি।

নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করে কারাগারে পাঠানো এবং বিচারের নামে হাজার হাজার মুরসি সমর্থককে মিসরের জান্তা সরকার বন্দী করে রাখলেও এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রাখায় পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনা করেন এরদোগান। তিনি বলেন, মোহাম্মদ মুরসি তার হাজার হাজার বিপ্লবী সমর্থককে নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। কিন্তু পাশ্চাত্যের কেউ এর প্রতিবাদ করেনি।

এরদোগান বলেন, জেনারেল সিসি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হটিয়ে বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করে ৫০ জনকে ফাঁসি দিয়েছেন। তার দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে পশ্চিমারা সব সময়ই নীরব থেকেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ। তুরস্ককে ফাঁসির আদেশ বাতিলের জন্য তারা বারবার আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা এমন সময়ে খুনি সিসির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে মিসরে সম্মেলনে অংশ নিয়েছে যখন দেশটির নাগরিকদের ফাঁসি দেওয়া হচ্ছিল। এ থেকে প্রমাণিত হয় ইউরোপ মানবাধিকার বিষয়ে দ্বিমুখী আচরণ করছে।

ইউরোপীয় দেশগুলোর এমন আচরণকে ভণ্ডামি হিসেবে আখ্যায়িত করেন এরদোগান। তুর্কী প্রেসিডেন্ট বলেন, মিসরের জালিম শাসক হয়তো গ্রেফতারকৃত নেতাদের অত্যাচার করে সাময়িক বিজয় অর্জন করেছে। কিন্তু তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস মানুষের মন থেকে মুছে দিতে পারবে না। উল্লেখ্য, ১৭ জুন মিসরের একটি আদালতের এজলাসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মোহাম্মদ মুরসি। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, ‘আদালতের এজলাসে হঠাৎ পড়ে গিয়ে’ তার মৃত্যু হয়েছে। গত ৭ মে তিনি আদালতে বলেছিলেন, তার জীবন হুমকির মুখে। 

দি ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দৃষ্টিতে শহীদ প্রেসিডেন্টের মৃত্যু : মিসরের বিচার বিভাগীয় একটি সূত্র বলছে, আদালতে তার বিচারের শুনানিতে বিরতি চলার সময় তিনি মূর্ছা যান।

গুপ্তচরবৃত্তির মামলার একটি অধিবেশন সবে শেষ করেছেন আদালত কর্মকর্তারা। তখন বিচারককে তারা জানান, মুরসি মূর্ছা গেছেন, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। পরবর্তী সময়ে হাসপাতালেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে এসব তথ্য জানা গেছে।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুরসি শেষ বারের মতো নিজের পরিবারের দেখা পান। তার মাস খানেক পরে তার আবদাল্লাহ নামের এক সন্তানকে আটক করে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ। তার আইনজীবী দলের সদস্য আবদেল মাকসুদ ২০১৭ সালের নভেম্বরে সাবেক এই ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্টের দেখা পেয়েছিলেন।

তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধীরে ধীরে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা দ্য ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, মুরসিকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা নিতে দেয়া হয়নি। দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেতে দেয়া হয়েছে। মৌলিক মানবাধিকারের সবকিছু থেকে তাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। আর এতে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে তাকে।

মুরসির মৃত্যু ও তার আটকাবস্থা নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত করতে মিসরীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও একই দাবি করেছে। তারা বলছে, বছরের পর বছর ধরে মুরসিকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।

সংস্থাটি আরও জানায়, মিসরের চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের একটি তদন্ত করা উচিত। বিশেষ করে সেখানের কারাগারগুলোতে ব্যাপক নিষ্ঠুরতা ও মুরসির মৃত্যু নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।

মৃত্যুতে বিশ্ব নেতাদের শোক অবহেলার অভিযোগ

মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যুর ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। পাশাপাশি এই ঘটনায় শোক জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, নেতা ও সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। যার কিছু তুলে ধরা হলো-

তুরস্কের প্রেসিডেন্টের শোক : ড. মুরসির মৃত্যুর সংবাদে সাংবাদিকদের করা প্রশ্নের জবাবে উত্তর দিতে গিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেন,‘গাড়ি থেকে নামার সময় আমার কাছে ড. মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যুর খবর আসে। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের শহিদ ভাইয়ের জন্য দোয়া করছি, আল্লাহ যেন শহিদের ওপর রহম করেন। আদালতের এজলাসেই তার মৃত্যু হয়েছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি আল্লাহর কাছে তার জন্য রহমত কামনা করি।’

কাতারের আমিরের শোক : কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি তার নিজের ভেরিফায়েড টুইটার অ্যাকাউন্ডে শোক জানিয়ে লিখেন,‘মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির হঠাৎ মৃত্যুর খবর পেয়ে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি। তার পরিবার ও মিসরবাসীর জন্য সমবেদনা জানাই। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তার কাছে সবাইকে ফিরে যেতে হবে।’

ব্রিটিশ এমপি প্যানেলের বিবৃতি

যথাযথ চিকিৎসা সেবা না দেয়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসির অকাল মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্রিটিশ রাজনীতিক ও আইনজীবীদের একটি প্যানেল। তারা বলেন,‘দীর্ঘদিন ধরে অবহেলার ফলে মুরসির শারীরিক অবস্থা যে পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তাতেই তিনি অকালে মারা গিয়েছেন। মিসরের বর্তমান সরকার মুরসির ব্যাপারে এসব বক্তব্যকে মোটেও গুরুত্ব দেয়নি।’ তারা আরো বলেন,‘মৃত্যুর আগে তার পরিবারসহ বিভিন্ন মহল থেকেই সরকারি কর্তৃপক্ষকে মুরসির শারীরিক অবস্থা মোটেও ভালো নয় বলে জানানো হয়েছিল। এ অবহেলায় কারাগারে তার মৃত্যু হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছিল। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মুরসিকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না বলে বারবার তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। এসব কথার কোনো গুরুত্ব দেয়নি সরকার ও কর্তৃপক্ষ। যার ফলশ্রুতিতে মুরসিকে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।’

ব্রিটিশ ইন্ডিপেনডেন্ট ডিটেনশান রিভিউ প্যানেলের বিবৃতি

ড. মুরসির মৃত্যুতে চরম অবহেলার অভিযোগ করেছে ব্রিটিশ ইন্ডিপেনডেন্ট ডিটেনশান রিভিউ প্যানেল। তারা বলছেন, সাবেক এ প্রেসিডেন্টকে কারাবন্দি রাখার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।

তার প্রতি অবহেলার কারণে মৃত্যুর আগেই ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল সিসিকেও দায়ী করেছিল যুক্তরাজ্যের বিশেষ স্বাধীন বন্দিত্ব পর্যালোচনা প্যানেল ইনডিপেনডেন্ট ডিটেনশান রিভিউ প্যানেল। তারাসহ আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থা আগেই মিসরকে সতর্ক করে বলেছিল যে, মুরসি কারাগারে অকালে মারা যেতে পারেন। কারণ তার প্রতি আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে মিসর সরকার।

মুসলিম ব্রাদারহুডের বিবৃতি : মিসরের জনপ্রিয় মুসলিম সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যুতে সরকারের অবহেলা ও দায়িত্বশীলতার অভাব উল্লেখ করেছে। এক বিবৃতিতে তারা বলছে, ড. মোহাম্মদ মুরসিকে ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার ও পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর পর থেকেই মুরসির শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে এবং এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার মিসরের আদালতে বিচার চলাকালীন সময়ে তার মৃত্যু হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ