বুধবার ২২ মে ২০২৪
Online Edition

কোরআনি মক্তব হারিয়ে যাচ্ছে

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : ইসলামের প্রাথমিক যুগে জ্ঞান অর্জনের জন্য তেমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। তবে ইসলামের আদি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল মসজিদ। হজরত আদম (আঃ) দুনিয়াতে এসে পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেছিলেন। এটিই মূলত মানব জাতির প্রথম শিক্ষাগার। ইসলাম প্রচারের সূচনা থেকেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানব জাতির মহান শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং ইসলামী শিক্ষার নিয়মনীতি প্রবর্তন করেন। মানবিক মূল্যবোধের মূল ভিত্তি হল ধর্ম। ধর্মীয় বিশ্বাস চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, আদর্শ, নিয়ম-নীতি, রীতি নীতির মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষা মূলত মক্তব দেয়। একজন মানুষকে সত্যিকার অর্থে ভালো মানুষ হওয়ার পেছনে যতগুলো উপাদান নিহীত তার মধ্যে মক্তব প্রধান কাজটি করে। সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিটি মানুষের চরিত্রকে মহান করে তোলে। তাই মানুষের আত্মিক সামাজিক উৎকষ সাধনের জন্যে জাতীয় জীবনে মক্তব শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামের শিক্ষার ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের এলার্জি বিরাজ করছে। অথচ যে সমাজ যত বেশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সে সমাজ তত বেশি উন্নত এটা ইতিহাসে প্রমাণিত। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের মধ্যে গড়ে তোলার পেছনে কোরআনের মক্তব বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

সমগ্র মানবজাতির হিদায়েতের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নাজিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল কোরআন। এই গ্রন্থের ধারক-বাহক হওয়ার জন্য মহান আরশের অধিপতি আমাদেরকে মনোনীত করেছেন। সূরা ফাতিরের ৩২ নম্বর আয়াতে কারীমায় মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমি আমার বান্দাদের মাঝে তাদের সে কিতাবের উত্তরাধিকারী করেছি, যাদের পছন্দ করেছি। সুতরাং কোরআনের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিটি মানুষের জ্ঞানার্জন করা ফরজ। আল্লাহর রাসূল (সা.) কোরআন পাঠের উপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে কোরআন নিজে শিখে এবং অন্যকে শিখায়।’ (বুখারী-৫০২৮) কোরআনের মোজেযা জানার জন্যে বড় আলেম হওয়ার প্রয়োজন নেই। একটু ঠা-ামাথায় চিন্তা করলেই উত্তর পাওয়া যাবে। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোনো গ্রন্থ আবিষ্কার হয়নি যে গ্রন্থ প্রতিটি মুর্হুতে মানুষ পড়ে। অথচ আল্লাহতায়ালা সমগ্র মানবজাতির হিদায়াতের জন্য এমন একটি গ্রন্থ প্রেরণ করেছেন যা বিশ্বের সব ভাষাভাষি মানুষের জন্য একই ভাষায় লিপিবদ্ধ। কোরআন শিক্ষা করা, মুখস্থ করা ও তাতে দক্ষতা লাভের ফজিলত এত বেশি যা হাজার পৃষ্ঠা লিখলেও সমাপ্তি টানা সম্ভব নয়। রাসূল (সাঃ) বলেন ‘যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করবে এবং তা মুখস্থ করবে এবং বিধি-বিধানের প্রতি যতœবান হবে, সে উচ্চ সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গে অবস্থান করবে। আর যে কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কোরআন পড়বে, তার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখবে সে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে।’ (মুসলিম ঃ ২৪৬৫)

মুসলিম সুলতানি যুগ থেকে শুরু করে মোগল আমল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৮০০ বছর মুসলমানদের নিকট ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব ছিল প্রবল। প্রতিটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ক্ষমতাসীন শাসকরা। কিন্তু ব্রিটিশ বেনিয়া ছলে বলে কৌশলে মুসলমানদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে বন্ধ করে দেয় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষানীতির বিরোধীতা করা তো দূরের কথা উল্টো মুসলমানরা পাশ্চত্য ধ্যান-ধারণাপ্রসুত আধুনিক শিক্ষাকে সাদরে গ্রহণ করে। রাজধানী শহরের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম আমাদের গাও গেরামের প্রতিটি পাড়া মহল্লায় হাজারো মক্তব-মাদরাসা ছিল। শিশু-কিশোররা কায়দা সিপারা হাতে নিয়ে মক্তবে যেত। বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে স্কুল কলেজে পাঠানোর চেয়ে মক্তবে পাঠাইতে বেশি স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করতো। এমনকি গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন মহিলারা কোরআনের শিক্ষার প্রসার বাড়ানোর জন্যে পাটি, মাদুর বিছিয়ে ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। সে সময় কোরআন পড়ার বেশ কদর ছিল। বিয়েশাদির ক্ষেত্রেও কোরআন পড়তে পারে এমন পাত্রীদের তালাশ করা হতো। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। মুসলমানদের ঐতিহ্যের ধারক মক্তবগুলো এখন বিলুপ্তিপ্রায় অবস্থা। শিশু-কিশোররা এখন আর দলবেধে মক্তবে যায় না বা যেতে দেয়া হয় না। কারণ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশের কি শহর, কি গ্রাম সর্বত্র আজ মক্তবের সময় কিন্ডারগার্ডেন স্কুল চালু করা হয়েছে। একশ্রেণির অভিভাবক মক্তব শিক্ষার ব্যাপারে বড্ড উদাসীন হওয়ার কারণে শিশুদের কচি মনে ইসলামী মূল্যবোধের পরির্বতে বিজাতীয় সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক এটা সবারই অনুধাবন করা প্রয়োজন। 

হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন, ‘মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব আমলের ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের ধারাবাহিকতা জারি থাকে। এক. সদকায়ে জারিয়া। দুই. কোনো এলমের মাধ্যম রেখে যাওয়া, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হবে। তিন. নেক সন্তান রেখে যাওয়া যে তার জন্য দোয়া করবে।’ (মুসলিম ঃ ১৬৩১) যে ঘরে কোরআন তেলাওয়াত হয়, সে ঘরে আল্লাহর রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হয় যা হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন লোকেরা কোনো ঘরে একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব কোরআন পাঠ করে, তখন তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়। আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে নেয় এবং স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের মজলিসে তাদের আলোচনা করতে থাকেন।’ (মুসলিম ২০৭৪)। কিয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশি মর্যাদাশীল হবেন কোরআনের পাঠক। সেদিন বলা হবে, পড় যেভাবে দুনিয়াতে পড়তে। তোমার পড়া যেখানে শেষ হবে সেখানেই হবে তোমার স্থান। (মুসনাদে আহমদ ১৯২) 

পৃথিবীতে এমন একটি গ্রন্থ কী খুঁজে পাওয়া যাবে যে গ্রন্থের একটি শব্দ পড়লে দশটি নেকী পাওয়া যায়। অথচ কোরআনের একটি হরফ পড়লে একটি নেকি হয়। আর একটি নেকি দশ নেকির সমান। বোখারি ঃ ৬৪৬৯) কোরআন তেলাওয়াতের এই সম্মান শুধুমাত্র তেলাওয়াতকারী নিজেই পাবে তা কিন্তু নয়! মা-বাবাকেও দেয়া হবে সম্মান। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন পড়েও তদনুযায়ী আমল করে, কেয়ামতের দিন তার মা-বাবাকে নূরের মুকুট পরানো হবে, তার আলো হবে সূর্যের আলো অপেক্ষা প্রখর।’ (আবু দাউদ ৩৬৭৫) বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল কলেজ মাদরাসা থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ ছেলে মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে দেশ ও জাতির মুখ উজ্জল করছে এটা ঠিক। কিন্তু আমরা যদি চিত্রের উল্টো পৃষ্ঠের বিষয়টি একটু খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাবো ওইসব জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলে-মেয়েরা নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে উত্তীর্ণ নন। এটা দেশ সমাজ ও জাতির জন্য এক অশনিসংকেত। সত্যিকার অর্থে একটি সোনার বাংলাদেশ গঠন করতে চাইলে মক্তব শিক্ষার প্রসার রাষ্ট্রীয়ভাবে বাড়ানো জরুরী। দেশের সুশীল সমাজ, শিক্ষাবিদ, আইনবিদ, মসজিদের সম্মানিত খতিব, ইমাম সাহেব, অভিভাবকগণ সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে মক্তব শিক্ষা হারিয়ে যাওয়ার আগেই গ্রাম-মহল্লাতে মক্তব শিক্ষা চালু করার জন্যে সকলেরই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ