শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

চাকরিতে প্রবেশের বয়স ও তরুণদের হতাশা

প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন : বাংলাদেশে সরকারি চাকরির প্রজ্ঞাপনে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ১৮ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত। ৩০ বছরের এই প্রাচীরের কারণে লাখ লাখ উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী বেকারের জীবন থেমে গেছে। তারা আজ হতাশাগ্রস্ত। অথচ তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করতেই লেগে গেছে ২৭-২৮ বছর। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সেশনজট সহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যান্য আভ্যন্তরীণ সমস্যা। চাকরির পিছনে শিক্ষিত বেকাররা হন্যে হয়ে ছুটছেন। কিন্তু এই কম সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে অর্থাৎ ৩০ বছরের এই প্রাচীরের কারণে তারা পাচ্ছেন না চাকরিতে প্রবেশের পর্যাপ্ত সুযোগ ও সময়। এক দিকে পদ খালি থাকা সত্ত্বেও নেই পর্যাপ্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, আবার অন্যদিকে সীমিত কয়েকটা নিয়োগ থাকলেও পদসংখ্যা কম। তার উপর বয়সের বাধার সাথে যুক্ত হয়েছে কোটা প্রথা, নিয়োগ বাণিজ্য, নিয়োগে দলীয় প্রভাব ইত্যাদি সমস্যা। ফলে চাকরিতে প্রবেশ করতে না পারায় তারা উৎকণ্ঠা আর হতাশায় ভুগছেন। উপর্যুপরি দিনদিন তাদের এই বৃদ্ধি বেকারত্বের হারকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে দেশ কখনই বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি কামনার স্বপ্ন দেখতে পারছে না। অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ পিতা-মাতা রোগে ভোগে, অনাহারে-অর্ধাহারে থেকেও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করছেন। তাই এই সব পিতা-মাতা, বিভিন্ন সচেতন মহল আর লক্ষ তরুণের একটাই যৌক্তিক প্রশ্ন ও দাবী- বয়স কেন বাধা হবে? আর কেনই বা আবেদনের ক্ষেত্রে বয়স সীমা বর্ধিত করা হবে না? এই সব যৌক্তিকতা সামনে নিয়ে তরুণদের একটা বিশাল অংশ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেও আসছে। কিন্তু কেন তাদের এই দাবিকে মেনে নেয়া হচ্ছে না তা আমাদের বোধগম্য নয়! চাকুরির আবেদনে বয়স সীমা ৩০ বছর পর্যন্ত কেন এই প্রশ্নের উত্তরে হয়ত তেমন কোন যৌক্তিক উত্তর কেউ দিতে পারবে না। কারণ এর অনুকূলে সঠিক ও পর্যাপ্ত অর্থবহ তেমন কোন যুক্তিই নেই।

চাকরির বয়স ৩৫ নিয়ে সুর উঠেছিল ২০১২ সালের শেষ দিকে বা ২০১৩ সালের শুরুর দিকে। সচেতনতা ও যুগোপযোগী জ্ঞানের কারণেই স্পীকার থাকাকালীন বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপিরা, ডিসি সম্মেলনে সকল জেলার ডিসিরা, বিভিন্ন কলামিস্টরা এর প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা উপলব্ধি করেছেন। নবম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে ও দশম জাতীয় সংসদে ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ সহ আজ পর্যন্ত কমপক্ষে ৭০ থেকে ৭৫ বার এর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। গত ২৭ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বিশ্বের সকল দেশের নিয়োগ বিধি, এ দেশের বর্তমান গড় আয়ু, আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের তুলে ধরা সকল যৌক্তিক দিকের সঠিক আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে বয়স বাড়ানোর বিষয়টাকে আমলে নিয়েই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ এবং অবসরের বয়স ৬৫ করার সুপারিশ করেন। শুধু তাই নয় এর দ্রুত বাস্তবায়নের জন্যও মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। সর্বশেষ গত ১২ জুলাই দশম জাতীয় সংসদের একবিংশতম অধিবেশনের এক ভাষণেও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ১০ সেপ্টেম্বর আবারও চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ এবং অবসরের বয়স ৬৫ বছর করার পক্ষে জোরালো প্রস্তাব রাখেন। তাছাড়া বর্তমান সরকারও বয়স বাড়াবে এমন প্রতিজ্ঞা করেছিল ৩৫ নিয়ে সুর উঠার সূচনালগ্নতেই। সরকার ২০১৪ সালে নতুন করে ক্ষমতায় এসেই যদি উচ্চ শিক্ষিত ছাত্র জনগোষ্ঠীর এই দাবীটা মেনে নিত তখন হয়ত লাখ লাখ বেকারদের আর এই দাবী নিয়ে মাঠে নেমে আন্দোলন করতে হত না, কারাবরণ আর পুলিশি নির্যাতনের শিকার হতো না।

তাছাড়া সরকার এখন এই বয়সসীমা ৩৫ করলেও কম হবে। কারণ সময় আজ গড়িয়ে অনেক দূর চলে গেছে। যে দাবী বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল নতুন করে ক্ষমতায় আসলেই অর্থাৎ ২০১৪ সালের দিকেই। পাঁচ বছর পরে সেই গ-িটা ৩৫ এর বেশী হওয়া উচিৎ। জানা যায়, বর্তমান বিশ্বের ১৬০টিরও বেশী দেশের চাকরির নিয়োগে আবেদনের বয়সসীমা রয়েছে ন্যূনতম ৩৫ থেকে ৫৯ বছর পর্যন্ত। তাহলে কি বাংলাদেশ নামের ছোট্ট ভূ-খ-টা পৃথিবী নামক গ্রহের বাহিরের? কিসের এত বাধা এই বয়স বাড়ানোর পথে? বয়স বাড়িয়ে দিলেই কি সবাইকে চাকরিও দিতে হবে বা সবার চাকরি হয়ে যাবে? শুধুমাত্র সবাই যার যার মত করে আবেদন আর প্রতিযোগিতা করার সুযোগটুকুই পাবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ‘সরকারি নিয়োগ-লাভে সুযোগের সমতা’ অংশে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে-“প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।” কিন্তু বাস্তবে এর উল্টো নীতিই অনুসরণ করা হচ্ছে।

আমাদের দেশে চাকরিতে প্রবেশে রয়েছে দ্বৈত নীতি। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যা কখনোই কাম্য নয়। মুক্তিযোদ্ধার কোটা বাদে আবেদনে বয়সের বেলায় সর্বোচ্চ সুবিধা পাচ্ছেন ডাক্তার, নার্স আর বিভাগীয় প্রার্থীরা যথাক্রমে ৩২, ৩৬ এবং ৪০ বছর পর্যন্ত। তাহলে কি আমরা বলতে পারি এ ক্ষেত্রে আমরা সাংবিধানিক নীতিতেই রয়েছি? আমরা এমন এক দেশে বাস করি যেখানে একদিকে আবেদনে বয়সের বাধা আর অন্যদিকে শিক্ষার কোন মূল্য নেই। বাস্তবতা এমন, মাস্টার্স পাশ করা ২৭/২৮ বছর বয়সী একজন মানুষকে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকুরীতে যোগদান করতে হয়। আর মূর্খ একজন ১০ বা ১২ বছর বয়সী বাস হেলপার এর দৈনিক বেতন ৪০০/৫০০ টাকা। কেউ কোন ফ্যাক্টরিতে ২০ বছর কাজ করলে তার বেতন হয় লাখ টাকা আর ২০ বছর পড়ালেখা করে কেউ যখন চাকুরীর জন্য যায় তখন তার বেতন হয় ১০ হাজার টাকা। তাছাড়া এই লেখাপড়া শেষ করতে কত কাঠ-কয়লাও পোড়াতে হয়েছে। পিতা-মাতার লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অথচ এই শিক্ষিতরাই আজ পরিবার, সমাজ তথা সবার কাছেই অবহেলিত। আজ বড় অবেলায় তাদের ঠিকানাটা কোথায় হওয়া উচিৎ? এই প্রশ্ন গোটা দেশের শিক্ষিত সচেতন মহলসহ দেশকর্তা ও দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে। তাহলে কি তাদেরকে শিক্ষিত করে পিতা-মাতারাও বড়ই ভুল করেছেন? নাকি তাদেরকে স্কুলের পরিবর্তে কোন বাস বা ট্রাকের হেলপার বা কোন ফ্যাক্টরিতেই কাজে পাঠানো উচিৎ ছিল? তাছাড়া এই সব শিক্ষিতদের ২০ বছরের অর্জিত সনদের মেয়াদ ও মূল্য শেষ হয়ে যায় ২/৩ বছরে। কারণ এই সনদ নিয়ে একদিকে যেমন প্রজাতন্ত্রের কোন কর্মে প্রবেশ করা যাচ্ছে না তেমনি বেসরকারি কোন ক্ষেত্রেও প্রবেশ করা যাচ্ছে না। তাছাড়া বিভিন্ন নিয়োগে একেকটা পদে ২/৩ বছর অভিজ্ঞতাও চাওয়া হয়ে থাকে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করা ছাত্রছাত্রীরা এই অভিজ্ঞতা কোথায় পাবে? আর এই অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগটুকুও তো থাকতে হবে! বলা হয়ে থাকে শিক্ষার কোন বয়স নেই। অথচ চাকরিতে প্রবেশে রয়েছে বয়সের দেয়াল। কিন্তু নিম্ন আয়ের এ দেশে কর্মহীন শিক্ষার মূল্য কতটুকু?

চাকরির আবেদনে বয়স বাড়ালে সরকার যে সব ক্ষেত্রে লাভবান হবে তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরা হল-

* শিক্ষিত বেকাররা প্রজাতন্ত্রের কাজে প্রবেশ করলে দেশ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে।

* শিক্ষিত তরুণরা নানা রকম অপরাধকর্ম যেমন- মাদক সেবন, মাদক ব্যবসা, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সাথে আর যুক্ত হয়ে পড়বে না।

* সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও আওতাধীন দফতরসমূহে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ৩ লাখ ১০ হাজার ৫১১ টি(সূত্রঃ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) শূন্যপদ মেধাবীদের দ্বারা পূরণ হয়ে যাবে।

* বেসরকারি সেক্টরগুলোতেও যেমন ব্যাংক, বিভিন্ন কর্পোরেট অফিস, বহুজাতিক কোম্পানীগুলোতেও প্রবেশের সুযোগ থাকবে।

* নিয়োগ পরীক্ষায় ভাল প্রতিযোগিতা থাকায় যোগ্য লোক সঠিক মেধার বলে নিয়োগ পাবে।

* প্রতিটি আবেদনের মাধ্যমে ব্যাংক ড্রাফ্ট বা ট্রেজারি চালান মারফত সরকার কয়েক কোটি করে টাকা পাবে।

* উচ্চ শিক্ষিত তথা পিএইচডি ডিগ্রীধারীরা প্রজাতন্ত্রের কাজে লাগবে এবং ব্রেনড্রেন এর সংখ্যা শুন্যের কোটায় চলে আসবে।

* সকারের আগাম আধুনিক সকল রূপকল্প বাস্তবায়নে সকলেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।

* বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনেকটাই পূরণ হবে অর্থাৎ দেশ সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত হবে এবং

* এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের তালিকা আরও সমৃদ্ধ হবে। 

তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় সরকারি চাকরির আবেদনে বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বার তার বেশী করা শতভাগ যৌক্তিক এবং এ ব্যপারে কাল বিলম্ব না করে অর্šÍবর্তীকালীন সরকার গঠনের আগেই এর প্রজ্ঞাপন জারি করা উচিৎ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ