রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রথম প্রস্তাবক নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী

আখতার হামিদ খান : ১৮৮৫ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস গঠনের মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দাবী উঠলে তখন মুসলিম সমাজের নেতৃত্বে শূন্যতা দেখা দেয়। এই শূন্যতা পূরণে যিনি বীরদর্পে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি হলে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। প্রখ্যাত ওলি হযরত মাহমুদ শাহ-এর পুত্র ময়মনসিংহ জেলার বিখ্যাত ধনবাড়ীর জমিদার সৈয়দ জনাব আলী চৌধুরীর ঔরসে ১৮৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। মাতার নাম ছিল সৈয়দা রাবেয়া খাতুন। সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরীর সারা খাতুন নামে এক বোন ছিল। বাল্য বয়সে তাদের পিতা-মাতা উভয়ে ইন্তেকাল করেন। তখন থেকে তারা নাটোর জেলার বিখ্যাত মুসলিম জমিদার সৈয়দ এরশাদ আলীর কাছে প্রতিপালিত হন। তিনি ছিলেন তাদের মামা।
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী তিনি স্বধর্মের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে লেখক সৃষ্টির জন্য পত্র-পত্রিকা প্রকাশ ও ছাপাখানা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যে ছাপাখানা থেকে সাপ্তাহিক সুধাকর ও মিহির নামক পত্রিকা প্রকাশ হতো। কলকাতায় স্থাপিত তার সেই ছাপাখানার নাম ছিল আলফাতুন্নেছা প্রেস। আলফাতুন্নেছা ছিলেন তার স্ত্রী। যিনি বগুড়ার প্রসিদ্ধ নওয়াব সৈয়দ আব্দুস সোবহান চৌধুরীর কন্যা ছিলেন। নওয়াবজাদা সৈয়দ আলতাফ আলী চৌধুরী ছিলেন তাদের পুত্র। আর আলতাফ আলী চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ আলী। যিনি অবিভক্ত বাংলার অর্থ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সৈয়দ মোহাম্মদ আলী ছিলেন নওয়াব আলী চৌধুরীর প্রকৃত ভাবশিষ্য ও যোগ উত্তরসূরি।
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর পূর্ব পুরুষ শাহ্ আতিকুল্লাহ বাগদাদ থেকে ভারতবর্ষে আসেন। তিনি ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক সাধক ও আলীয়ে কামেল। মোঘল শাসন আমলে পাবনা জেলার নাকালিয়া এলাকা বিরাট জায়গীরি লাভ করে সেখানে বসবাস করেন। পরবর্তীতে তার বংশধরদের একটি শাখা ঢাকা জেলার হাসমিলান নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। হাসমিলানে বসতি স্থাপনকারী হযরত শাহ আতিকুল্লাহ (রঃ)-এর বংশের এক মেয়ের বিবাহ হয়েছিল সেলজুক তুর্কী বংশের উত্তর পুরুষ ধনবাড়ির জমিদার রাজ আলী খাঁর সঙ্গে। কিন্তু তারা নিঃসন্তান ছিলেন। তখন রাজ আলী খাঁর স্ত্রী তার এক ভাইয়ের পুত্রকে গ্রহণ করেন। সেই পালিত পুত্রের নাম ছিল খোদা বকশ। রাজ আলী খাঁর ইন্তেকালের পর তার সমুদয় সম্পত্তি লাভ করেন খোদা বকশ। তিনিও একজন ধামির্ক ও কামেল মানুষ ছিলেন। তার দিক থেকে পরবর্তী বংশধররা হচ্ছে হযরত শাহ মাহমুদ (রঃ) সৈয়দ জনাব আলী, সৈয়দ আলতাফ আলী, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী বগুড়া ও তার পুত্র কন্যা যথাক্রমে সৈয়দ হাম্মাদ আলী, সৈয়দ হামদে আলী, সৈয়দ মাহমুদ আলী ও সৈয়দা মাহমুদা। সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরীর সৈয়দা সখিনা খাতুন নাম্মী আর এক স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে নওয়াবজাদা হাসান আলী চৌধুরী। তার কন্যা আশিকা আকবর । সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী তার আত্মজীবনীতে তার বংশ ধারা উল্লেখপূর্বক লিখেছেন যে, তার পূর্ব পুরুষ বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিরানী (রঃ) এর বংশধর ছিলেন।
শৈশবে গৃহশিক্ষকের নিকট আরবী, ফার্সী ও বাংলায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। এরপর তাঁর রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হয় এবং পরবর্তীতে কলিকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে এফ এ পাস করেন। যৌবনের শুরুতে নওয়াব আলী চৌধুরী ময়মনসিংহ জেলার অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হন। এই ম্যাজিষ্ট্রেট থাকাকালীন সময়ে তিনি এদেশের গরীব অশিক্ষিত মুসলিম জনসমাজের সার্বিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরপর তাঁর রাজনৈতিক হাতে খড়ি শুরু হয় মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার ও জিলা বোর্ডের সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি জমিদারিতে এতটুকু প্রজাবৎসল ছিলেন যে, স্বীয় জমিদারী এলাকায় প্রজাদের তাঁর অনুমতি ব্যতীত আদালতে মামলা করতে যেতে দিতেন না।
নওয়াব আলীর মধ্যে সেই জমিদারী মেজাজ ছিল না। তিনি নিজেও বিরাট এষ্টেটের জমিদার হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের সাথে সম্পর্ক নিবিড়ভাবে করার ক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন রয়েছে তার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন। তিনি তার জমিদারী আয়ের সিংহভাগ সেই সময় পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশের মুসলমানদের শিক্ষা ও রাজনীতি এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে ব্যয় করেছেন।
১৮৮৬ সালে মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আলীগড়ে স্যার সৈয়দ আহমদ ‘অল ইন্ডিয়া এডুকেশন কনফারেন্স’ গঠন করেছিলেন। ১৮৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে স্যার সৈয়দ আমীর আলীর সভাপতিত্বে কলিকাতায় এর প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। আবার তাঁরই সভাপতিত্বে ১৯০৩ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারী ‘ক্যালকাটা মোহাম্মেডান ইউনিয়ন’-এর বার্ষিক অধিবেশনে এর বঙ্গীয় শাখা গঠিত হয়। ১৯০৪ সালের ২ ও ৩ এপ্রিল রাজশাহীতে প্রথম এই বঙ্গীয় শাখা সমিতির অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠিত হলে তিনি তার অন্যতম সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তাদের বাধার মুখে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়ে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামক একটি মুসলিম প্রধান দেশের জন্ম লাভ করলে নওয়াব আলী চৌধুরী একটা সর্বভারতীয় মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি মুসলমানদের অনগ্রসরতার জন্য অশিক্ষাকে মূলতঃ দায়ী বলে মনে করতেন। ১৯০৫ সালে যেদিন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়, সেদিনই ঢাকার নর্থব্র“ক হলে তাঁর ও ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ‘প্রাদেশিক মুসলিম সমিতি’ নামক রাজনৈতিক সংগঠন গঠিত হয়। এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম সমাজকে শিক্ষামন্ত্রে উজ্জীবিত করে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনের ভিত প্রস্তুুত করা।
১৯০৬ সালের ১৪ এবং ১৫ এপ্রিল নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব সলিমুল্লাহ প্রমুখের সগযোগিতায় ঢাকায় ‘ক্যালকাটা মোহাম্মেডন ইউনিয়ন’-এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যার সলিমুল্লাহ ও নওয়াব আলী চৌধুরী যথাক্রমে এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও সমিতি কর্তৃক উত্থাপিত শিক্ষা বিষয়ক বেশকিছু প্রস্তাব সরকার কর্তৃক গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়। তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি-অনেকগুলো মুসলিম হোস্টেল স্থাপন, ছাত্রবৃত্তি বৃদ্ধি, পাঠ্যসূচী সংশোধন, নতুন মিডল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজী, ইতিহাস, ভুগোল শিক্ষার ব্যবস্থা। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নতুন প্রদেশে মোট ৪টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৪ সালে প্রথম রাজশাহীতে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ১৯০৮, ১৯১০ ও ১৯১১ সালে ময়মনসিংহ, বগুড়া ও রংপুরে। ১৯১১ সালে রংপুর অধিবেশনে নওয়াব আলী চৌধুরী মাতৃভাষা বাংলার স্বপক্ষে প্রথম সোচ্চার হয়ে বলেন, ‘বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, মাতৃস্তনের ন্যায়, জন্মভূতির শান্তি নিকেতনের ন্যায় বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা আমাদের নিকট প্রিয়, কিন্তু হতভাগ্য আমরা, প্রিয় মাতৃভাষার উন্নতিকল্পে আমরা উদাসীন। অধঃপতন আমাদের হবে না তো কার হবে?’
১৯০৬ সালে প্রাদেশিক শিক্ষা কমিটি কর্তৃক মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের রিপোর্ট প্রণয়ন করলে ১৯০৮ সালে জনশিক্ষা পরিচালক হেনরী সার্প নিজ তত্ত্বাবধানে এই রিপোর্ট সমীক্ষার জন্য নওয়াব আলী চৌধুরীকে অন্যতম সদস্য করে কমিটি গঠন করেন। ১৯১০ সালে এই সমীক্ষা রিপোর্ট বাংলা ও আসাম সরকারের কাছে বিবেচনার জন্য দাখিল করা হলেও তা বাস্তবায়নের আগেই বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়ে যায়। বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ার কারণে বিক্ষুব্ধ মুসলমানদের দাবীর মুখে বড় লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারী ঢাকায় এলে নবাব সলিমুল্লাহ ও নওয়াব আলী চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল মুসলিম প্রতিনিধি বড় লাটের সাথে সাক্ষাৎ করে মুসলমানদের বিভিন্ন সংশয়, বিশেষতঃ শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। এতে নবাব সলিমুল্লাহ ও নওয়াব আলি চৌধুরীর চাপের মুখে বড় লার্ট বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণস্বরূপ ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সম্মত হন এবং প্রতিশ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯১২ সালে ‘নাথান কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করেন। নওয়াব আলি চৌধুরী ছিলেন ঐ কমিটির অন্যতম সদস্য।
তিনি ১৯০৬-১৯১১ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ ও আসাম ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য এবং ১৯২১-১৯২৩ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। ১৯১৪ সালে তিনি আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সময়ে তিনি সামরিক বড় লাটের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্যও ছিলেন।
বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ার পর যুক্ত বাংলার প্রাদেশিক শিক্ষা সমিতির প্রথম সম্মিলিত অধিবেশন ১৯১৪ সালের ১১ ও ১২ এপ্রিল নওয়াব আলী চৌধুরীর সভাপতিত্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক সমিতি উভয়কে সংযুক্ত করা হয়। সভাপতির ভাষণে তিনি যে শিক্ষানীতি সম্পর্কিত বক্তৃতা দেন সেটা তাকে উপমহাদেশের অন্যতম শিক্ষা চিন্তাবিদরূপে প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এবং ১৯১৫ সালে ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ থেমে যায় ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তখন নওয়াব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী শুধু তার প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে নয়, অর্থ নিয়ে এগিয়ে আসেন। সেসময় নওয়াব আলি চৌধুরী ছিলেন ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলের সদস্য। তিনি ১৯১৭ সালে ৭ ও ২০ মার্চ ইম্পিরিয়াল কাউন্সিলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ চাপা পড়ে থাকার কথা উত্থাপন করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এতে চাপা পড়ে যাওয়া কাজ আবার পূর্ণোদ্যমে আরম্ভ হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অর্থাভাব দেখা দিলে এ দানবীর একাই বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দান করেন। জনশ্রুতি আছে এ টাকা সংগ্রহ করতে তিনি তাঁর জমিদারির কিছু অংশ বন্ধক রেখে টাকার সংস্থান করেন। শিক্ষানুরাগী নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী আটত্রিশটি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য নানাস্থানে জমি প্রদান করেছিলেন। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান স্থাপনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তিনি ধনবাড়ী, সোনাতোলা, কোদালিয়া, গফরগাঁও, পিংনা, জঙ্গলবাড়ী, হযরত নগর প্রভৃতি স্থানে বেশকিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তিনি সাহিত্যসেবীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। মহাকবি কায়কোবাদের সাহিত্য প্রকাশনায় তাঁর দান ছিল অপরিসীম। তিনি মুসলিম জাগরণে জনৈক সাংবাদিককে একটি প্রেস কিসে দান করেছিলেন। ভাষা সৈনিক, সমাজসেবী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী জমিদার নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী একজন সাহিত্যিকও ছিলেন। তাঁর রচিত পুস্তক বাংলা ‘ঈদুল আজহা’ (১৯০০), ‘মৌলুদ শরীফ’ (১৩২২ হিঃ), ইংরেজী Vernacular Education in Bengali (১৯০০) এবং ‘Primary Education in Rural Areas’ (১৯০৬) প্রকাশিত হলে সকল মহলে প্রশংসিত হয়।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর ‘স্বদেশী আন্দোলন’-এর প্রবক্তা হিন্দুদের ভারতীয় এক জাতীয়তাবাদের ‘হিন্দী’ এবং খেলাফত আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের ‘উর্দু’ স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা দাবীর মুখে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২১ সালে লিখিতভাবে বৃটিশ সরকারকে জানিয়ে দেন যে, ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হোক না কেন, বাংলার-রাষ্ট্রভাষা বাংলা করতে হবে। এরপর থেকে তিনি ধনবাড়ীতে ১ বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন করেন এবং তা আজও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। তিনিই প্রথম মুসলমান যিনি বলেন যে, ‘বাংলা ভাষা বাঙ্গালী মুসলমানদের মাতৃভাষা, এ ভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা।’ সেই জমানায় কোনো অভিজাত বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের আর কেউ বাংলা ভাষার জন্য এমন জোরালো কণ্ঠে কথা বলেননি।
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ১৮৯৬ সালে খান বাহাদুর, ১৯১১ সালে নওয়াব, ১৯১৩ সালে সিআইই এবং ১৯২৪ সালে নবাব বাহাদুর উপাধি লাভ করেন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) তাঁর দৌহিত্র ছিলেন।
নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২৯ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলা ১৩৩৬ সালের ১ বৈশাখ দার্জিলিং-এর ইডেন ক্যাসেলে ইন্তেকাল করেন। দার্জিলিং থেকে কলিকাতা হয়ে তাঁর লাশ ধনবাড়ীতে আনা হয় এবং ৪ বৈশাখ দাফন করা হয়।
নওয়াব আলী চৌধুরী সারাজীবন শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চাৎপদ বাঙ্গালী মুসলমানদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার অনবদ্য প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ জাতির সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করে রেখেছিলেন। তাঁর সে অনবদ্য প্রচেষ্টার ফলে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর নামে একটি হলের নামকরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও ব্যর্থ হয়েছে অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পদার্পণ করারও যাদের সামান্য সৌভাগ্য হয়নি তাদের অনেকের নামে বিশ্ববিদ্যালয় হলের নামকরণ করা হচ্ছে। তিনি শিক্ষার ব্যাপারে তিনি এতোটাই আন্তরিক ছিলেন যে, তার সেই অভিজ্ঞতা ও মেধা কাজে লাগানোর জন্য যখন তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম মন্ত্রী হন, সে সময় তাকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ১৯২৯ সালের ১৭ এপ্রিল ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
নওয়াব আলী চৌধুরী পূর্ব বাংলার মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন শিক্ষার অভাবকে। শিক্ষা সমস্যার সমাধান ও সে ব্যাপারে স্বধর্মের মানুষদের সচেতন এবং সঙ্গবদ্ধ করার জন্য তার সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার কথা ইতিহাস হয়ে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ইতিহাসের আলোকে তার অবদানের মূল্যায়ন করা হয় না। যার কর্মময় জীবনের কীর্তি স্বধর্মের মানুষের শিক্ষা ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে প্রসারিত ছিল, তিনি আজ আমাদের স্মৃতিতে ও চেতনায় অবহেলিত, উপেক্ষিত। ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০০২ জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে ভাষা আন্দোলনের স্থপতি প্রতিষ্ঠান তমদ্দুন মজলিস অন্যান্য একুশজনের সাথে নওয়াব আলি চৌধুরীকে ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘মাতৃভাষা পদক ২০০২’ (মরণোত্তর) প্রদান করে ও তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা হলের নামকরণের জোর দাবী উত্থাপন করে এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে উক্ত সভায় গৃহীত হয়। বর্তমানে সরকারের কাছে সুধী সমাজের দাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম চিরঞ্জীব পুরুষ নওয়াব আলী চৌধুরীর নামে নামকরণ করা হোক। এতে এতদিন পরে হলেও জাতি তাঁর ঋণ থেকে কিছু দায়মুক্ত হতে পারে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ