মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪
Online Edition

ঢাকায় পানিবদ্ধতা

গত বছরের ২৬ জুলাই মাত্র কয়েক ঘণ্টার অঝোর বৃষ্টির ফলে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যেদিকে দু’চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। মহানগরীর অনেক সড়কে যানবাহন পানিতে আটক হয়ে পড়ে। ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে ঐ দিনই আওয়ামী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ওয়াদা করেছিলেন, আগামী বছর (২০১৮) এমন অবস্থা আর থাকবে না। মন্ত্রীর এই ওয়াদা অনুসারে ঢাকা ওয়াসা তড়িঘড়ি করে খাল পরিষ্কার করার জন্য ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ চায় পরে কাটছাঁট করে বরাদ্দ কমিয়ে ৪০ কোটি টাকা করা হলেও তা এখনো পাওয়া যায়নি। অপরদিকে ওয়াসা কিছুটা তৎপর হয়ে বিভিন্ন ড্রেন পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয়। তারপর তা ঝিমিয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এলজিআরডি মন্ত্রী রাজধানবাসীকে যে ওয়াদা করেছিলেন তা আদৌ পূরণ হবে কি? কারণ পানিবদ্ধতা নিরসন করার জন্য যে বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন ছিল তার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, রাজধানীবাসীকে এ বছর আরো বড় ধরনের পানিবদ্ধতার দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হবে। ইতিমধ্যেই রাজধানীতে গত বছরের চেয়ে খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।  
আওয়ামী সরকার উন্নয়ন নিয়ে জোর গলায় অনেক কথা বলছে। দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিচ্ছে। রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে যে বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতে নদ-নদীর জোয়ার বয়ে যায়, নগরবাসী চরম দুর্ভোগে পড়ে এবং রাজধানী ঢাকা ডুবন্ত নগরীতে পরিণত হয়- এ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালক সরকারের আদৌ মাথা ব্যথা আছে বলে আমাদের মনে হয় না। ঢাকা যে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী, বর্ষায়-বৃষ্টিতে পানিবদ্ধ অবস্থায় এর দৃশ্য দেখলে তা বিশ্বাস করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কোনো উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী বর্ষায়-বৃষ্টির পানিতে ময়লা-আবর্জনায় ডুবে থাকবে, পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে, মানুষের বসবাসের অযোগ্য হবে, অসভ্য নগরী হিসেবে কুখ্যাতি হবে- তা তার স্ট্যাটাসের সাথে যায় না। উন্নয়নশীল দেশের রাজধানীর চেহারাও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে এবং তা নাগরিকদের বাসযোগ্য হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ কী শুকনো মওসুম, কী বর্ষা মওসুম- কোনো সময়ই রাজধানী নগরীকে সভ্য ও উন্নত নগরী বলে মনে হয় না। চলতি বর্ষায় কী ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা এখনই টের পাওয়া যাচ্ছে। বর্ষার শুরুতে সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তায়, অলিগলিতে পানি জমে যাচ্ছে। যখন একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা বা তিন-চার দিনব্যাপী বৃষ্টি শুরু হয়, তখন রাজধানী ঢাকা মহানগরীর অবস্থা কী হবে তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। কেন ও কী কারণে রাজধানীতে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তা কারো অজানা থাকার কথা নয়। এ নিয়ে দৈনিক সংগ্রামসহ অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। ঢাকার হারিয়ে যাওয়া খাল ও বর্তমান খাল নিয়ে দৈনিক সংগ্রামে অসংখ্য প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো একে অপরকে দোষারোপের কারণে বছরের পর বছর ধরে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর পানিবদ্ধতা সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। রাজধানী ঢাকা মহানগরীর হারিয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বার বার তাগাদা দিয়েছেন। তার এ তাগাদাতেও আজ পর্যন্ত কোনো কাজ হচ্ছে না। তাহলে কার কথায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে? ওয়াসা নগরীর পানিবদ্ধতা নিরসনে প্রতিবছর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতেই আগ্রহী বেশি। এর কারণে এতে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া সহজ হয়ে যায়। বর্ষার কারণে সময় বেশি লেগে যাচ্ছে, সময় আরো বাড়াতে হবে- এ ধরনের নানা বাহানা দিয়ে দুর্নীতির পথ খোলা হয়। এর ফলে ঠিক বর্ষা শুরু হওয়ার আগে আগে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কসহ অলিগলি খুঁড়ে যেন মরণ ফাঁদ তৈরি করা হয়। তবে ওয়াসার এ খোঁড়াখুঁড়ি কর্মযজ্ঞ দেখলে মনে হবে এবার আর পানিবদ্ধতা থাকবে না। অথচ বর্ষা শুরু হলে যেই সেই অবস্থা দেখা যায়। উল্টো রাস্তা ও অলিগলি খুঁড়ে ফেলে রেখে দেয়ায় তাতে বৃষ্টির পানি জমে গিয়ে মরণ ফাঁদে পরিণত হয়। যানবাহন, পথচারী এসব গভীর গর্তে পড়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়।
রাজধানীর পুরো ড্রেনেজ সিস্টেম যে অচল হয়ে পড়েছে তা নতুন করে বলার কিছু নেই। ওয়াসার ৪০০ বর্গকিলোমিটার সার্ভিস এরিয়ার মধ্যে ড্রেনেজ সিস্টেম রয়েছে ৩৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে যেটুকু ড্রেনেজ সিস্টেম রয়েছে তা দিয়ে পুরো আয়তনের মাত্র এক পঞ্চমাংশ এলাকা নিষ্কাশন করা যায়। এ চিত্র থেকে বুঝা যায় ওয়াসার ড্রেনেজ সিস্টেম কতটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এ থেকে উত্তরণে সরকারের কোন উদ্যোগও নেই। রাজধানীতে যে ২৬টি খাল বিভিন্নভাবে দখল হয়ে আছে তা খালগুলো উদ্ধারেও সরকারের কার্যকর কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খাল যেমন হাজারীবাগ, বাইশটেকি, সাংবাদিক কলোনী, বেগুনবাড়ি এবং মান্ডা খাল খননের জন্য অর্থ বরাদ্দের কথা জানা যায়। তবে এসব খাল কবে খনন করা হবে তার কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা জানা যায়নি। রাজধানী ঢাকা মহানগরীর সার্বিক চিত্র পর্যালোচনায় বুঝা যাচ্ছে এলজিআরডি মন্ত্রী এক বছরের মধ্যে পানিবদ্ধতা নিরসনের যে ওয়াদা করেছিলেন তা তো বাস্তবায়ন হবেই না বরং আরো কত বছর লাগবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। অপরদিকে সরকারেরও যেন এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। রাজধানী যে দিন দিন অচল ও পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে সেটি আমলেই নিচ্ছে না। রাজধানীতে বসেই সরকার দেশ পরিচালনা করছে, উন্নয়নের কথা বলছে। এ নিয়ে জনগণ সরকারের তীব্র সমালোচনাও করছে। আমরা মনে করি রাজধানী ঢাকা মহানগরীর পানিবদ্ধতা ও যানজটসহ সার্বিক সমস্যা নিরসনে সরকারকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে রাজধানীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ