শনিবার ১৮ মে ২০২৪
Online Edition

খালেদার মুক্তি অনিশ্চিত : বিরোধী দলের ঐক্যের পরিধি বিস্তারের চেষ্টা

বিলম্বিত হলেও এখন সম্ভবত অনেকেরই বোধোদয় হয়েছে যে, বেগম খালেদা জিয়া এই ঈদের মধ্যেও জেল থেকে বের হতে পারছেন না তো বটেই, এমনকি আগামী ইলেকশনের আগে বের হতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। দেশের আইন-আদালত সমূহের আচার আচরণ দেখে এখন বিএনপির শীর্ষ নেতারাও এই আশংকা প্রকাশ করছেন। এই ধরনের আশংকা প্রকাশ করলে সেটি আবার আদালত অবমাননা হয় কিনা সে বিষয়েও তারা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রশ্ন করছেন। তাই গত ১লা জুন শুক্রবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে ভাসানী ভবনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে রচিত ‘রণধ্বনি’ গানের সিডির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বলেন, এখন সময় শেষ। আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশনেত্রীকে যেভাবে আটক রাখা হয়েছে, তা একেবারেই বেআইনি। হাইকোর্ট বেইল (জামিন) দিয়েছেন। এর পরও নানা কৌশলে মাসের পর মাস খালেদা জিয়াকে আটক রেখেছে। উচ্চতর আদালত ছুটির কথা বলে তার মুক্তি প্রলম্বিত করছে।
এসব কথা বলার পর কিছুটা সময় চুপ থেকে মির্জা ফখরুল বলেন, এসব বললে আদালত অবমাননা হয় কিনা; হলেও কিছু যায় আসে না। এখন তো আর আমাদের হারানোর কিছু নেই।
তিনি বলেন, ‘আমরা বহুবার আলোচনা করার জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু সরকার আমাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। তারা বলে, সংবিধান অনুযায়ী সব করবে, যে সংবিধান তারা কেটেকুটে নিজেদের মতো করে নিয়েছে। অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির মহাসচিব বলেন, আমাদের দেশ রক্ষায় নামতে হবে। খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের প্রতীক। গায়ের জোরে তাকে আটক রাখার মানে হল- গণতন্ত্র পুরোপুরি ধ্বংস করা। মানুষের অধিকার ও মানুষের ভোটাধিকার নষ্ট করে এক ব্যক্তির শাসন নিশ্চিত করা। এ সরকার জোর করে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতার চেতনা হত্যা করেছে। সময়টা এতই খারাপ, আজকাল বাসায়ও জড়ো হয়ে কথা বলতে পারে না মানুষ। আমরা পাকিস্তানের আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, এরশাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। কিন্তু তখন আজকের মতো এত ভয়াবহ সময় ছিল না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, অত্যাচার-নির্যাতনের দিক থেকে এ সরকার অতীতের সব স্বৈরশাসককে হার মানিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে। এ দানবকে প্রতিহত করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। একটি অর্থবহ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে জনগণকে সাথে নিয়ে রাজপথে নামতে হবে, এমন কথা প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদও স্বীকার করেছেন। গত শুক্রবার প্রেস ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যরিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, রাজপথ ছাড়া আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি আসবে না । তিনি বলেন, আমরা আইন প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু পেরে উঠছি না। আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাবো কিন্তু তার মাধ্যমে বেগম জিয়ার মুক্তি আসবে না। তার মুক্তি আসবে একমাত্র রাস্তায়। এজন্য আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
বিএনপির অনেক বড় বড় নেতা, যারা দুদিন আগেও বলছিলেন যে, আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বেগম জিয়াকে কারাগার থেকে বের করে আনবেন তাদেরও মনে হচ্ছে, এখন মোহ ভঙ্গ হতে শুরু করেছে। তাই স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন এবং নজরুল ইসলাম খানের মুখেও একই ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। তারাও এখন বলতে শুরু করেছেন যে আইনি পথে বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে গেলে সেটি নির্ভর করবে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। দেশে যদি আইনের শাসন থাকতো তাহলে বেগম জিয়া ন্যায়বিচার পেতেন এবং যেহেতু অভিযোগ মোতাবেক তিনি কোনো অর্থ আত্মসাৎ করেন নাই, তাই তিনি বেকসুর খালাস পেতেন। এখন ন্যায়বিচারের মাধ্যমে তাকে খালাস দেয়া তো দূরের কথা, এই সরকার তার খেয়াল-খুশি উচ্চ আদালতের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে এবং একটি না একটি বাহানায় তার জামিন বিলম্বিত করা হচ্ছে।
॥দুই॥
অতীতেও আমি এই কলামে লিখেছি যে বেগম খালেদা জিয়া সহসা মুক্তি পাচ্ছেন না। কারণ মুক্তি দেয়ার জন্য তাকে মামলায় সাজা দেয়া হয়নি এবং জেল খানায় ঢুকানো হয়নি। বিএনপির শীর্ষ নেতারাই তো সব সময় বলেন যে, বেগম জিয়াকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার জন্যই তার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টসহ একের পর এক মামলা দেয়া হচ্ছে। তাকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্যেই একের পর এক গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে (শোন এ্যারেস্ট)। সেজন্যই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ থেকে জামিন পাওয়ার পরেও তিনি মুক্তি পাচ্ছেন না। এমনকি কুমিল্লার দুটি মামলায় হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয়ার পরেও সুপ্রিম কোর্ট সেটি স্টে (ঝঃধু) করেছে। এবং একদিন দুদিন নয়, প্রায় এক মাসের জন্য স্টে করেছে। আগামী ২৪ জুন জামিন মামলার শুনানি হবে। একই সাথে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকার পক্ষকে লিভ টু আপিল, অর্থাৎ ঐ মামলায় আপিল করার নির্দেশ দিয়েছে। পর্যবেক্ষক মহল ধারণা করছেন যে, ঐ মামলায় ২৪ জুন সরকার পক্ষ যদি হাইকোর্টে নিয়মিত আপিল করেন তাহলে ঐ মামলার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আপিল আরো পিছিয়ে যেতে পারে। ঐ দুটি মামলা ছাড়াও কুমিল্লার আরো একটি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা বিকৃতি, ভুয়া জন্ম দিবস পালন প্রভৃতি মামলা তো রয়েছেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ বলেন যে, এসব মামলা কোন মামলাই নয়। নেহায়েৎ বেগম জিয়াকে এবং সেই সুবাদে বিএনপিকে হয়রানি করা এবং কারাবাস দীর্ঘায়িত করার জন্যই যে এসব মামলা করা হচ্ছে সেটি যেকোন সাধারণ মানুষও এখন বুঝতে পারছেন।
বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার মিছিল অন্তহীন। মোট ৩৮টি মামলা। একটার পেছনে আর একটি আসছে। একটিতে জামিন মিললে আর একটি গ্রেফতারে খড়গ সামনে ঝুলছে। এই করতে করতেই ইলেকশন এসে যাবে। এবং এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত হবে। এই মামলাটিকে ফাইনালাইজ করার জন্য ৩১ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে। এখন এসব মামলার মেরিট যাই হোক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার সার্বক্ষণিকভাবে এই মামলায় হস্তক্ষেপ করছে এবং উচ্চ আদালতের ওপর প্রচন্ড চাপ অব্যাহত রেখেছে ততক্ষণ পর্যন্ত নিদোর্ষ হলেও বেগম জিয়া খালাস পাবেন না। সরকার যদি এখানে জনগণের চোখে ধোকা দেয়ার জন্য কিছু করতেও চায় তাহলে হয়তো পাঁচ বছরের সাজা কমিয়ে তিন বছর করা হবে। সেক্ষেত্রেও বেগম জিয়া নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষিত হবেন। ধারণা করা হচ্ছে যে, তফসিল ঘোষণার পূর্বেই সরকার এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করাবে। ফলে বেগম জিয়া আর নির্বাচন করতে পারবেন না।
॥তিন॥
আদালতের মামলার রায়ের ফলে বেগম জিয়া যদি নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষিত হন, তার পরেও কি বিএনপি ইলেকশনে যাবে? বেগম জিয়া অযোগ্য ঘোষিত হলে সেই একই রায়ে তারেক জিয়াও অযোগ্য ঘোষিত হবেন। তারেক জিয়ার স্ত্রী জোবায়দা রহমানও দেশে আসতে পারবেন না। কারণ রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার দরখাস্তের সাথে তার পাসপোর্টও ব্রিটেনের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া আছে। এর অর্থ এই দাঁড়ালো যে, শুধু মাত্র বেগম জিয়া নন, সমগ্র জিয়া পরিবার আগামী নির্বাচনে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হলেন।
এমন একটি ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। অথচ, এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপির রয়েছে আসাধারণ জনপ্রিয়তা। বিভিন্ন জেলা থেকে যে সমস্ত খবরা খবর আসছে সেসব খবর থেকে দেখা যায় যে, বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের জনপ্রিয়তা এখন ৯০ শতাংশ। এগুলোর সবই যে ইতিবাচক ভোট সেটি নয়। এর মধ্যে অনেক নেতিবাচক ভোটও রয়েছে। সমাজের বৃহত্তর অংশ আওয়ামী লীগের ওপর ত্যাক্তবিরক্ত। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেখানেই তারা শক্তিশালী প্রার্থী পাবে সেখানেই তারা ভোট দেবে। এভাবেও যদি ভোট হয় তাহলে আওয়ামী লীগ আগামী পার্লামেন্টে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হতে পারবে না। অর্থাৎ এই সরকারের পতন ঘটবে। কিন্তু সরকার কি বিরোধী দলকে ঐ পর্যন্ত যেতে দেবে?
এখন পর্যন্ত সরকার কঠোর হার্ড লাইনে স্টিক করছে। তার কারণ হলো বিএনপি তথা বিরোধী দল বিগত সাড়ে ৯ বছরে তাদের আন্দোলনের দক্ষতা এবং সাংগঠিনক শক্তি দেখাতে পারেনি। আর সেই সুযোগে সরকার মনে করেছে যে, বিএনপি একটি পেপার টাইগার। শুধু মুখে মুখে গরম গরম কথা বলে বেড়ানো। অথচ, বাস্তবে তার প্রয়োগ দেখাতে পারেনি।
এভাবে দিনের পর দিন প্রতিরোধ না করে শুধুমাত্র পড়ে পড়ে মার খাওয়ার ফলে এখন নেত্রী পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত একটি স্থবিরতা দলটির ওপর ভর করেছে। সুখের বিষয়, বেগম জিয়ার অব্যাহত কারাবাস তাদের ভেতরে নতুন বোধোদয়ের সৃষ্টি করেছে। তাই ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এখন বলছেন যে, আর বসে থাকা চলবে না। বিএনপিকে এখন ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তাদেরকে সরকারী জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হবে। এটা শুধুমাত্র বিএনপি শীর্ষ পর্যায়ের দুই একজনের কথা নয়। অনেকের মুখেই এখন রাজপথে নামার কথা শোনা যাচ্ছে।
তারা শুধুমাত্র রাজপথে নামার কথা বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। এজন্য তারা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও গ্রহণ করা শুরু করেছেন। তারা চেষ্টা করছেন বিরোধী দলসমূহের মধ্যে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার। ইতোমধ্যেই ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্ত ফ্রন্টের সাথে এব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছে। একই সাথে ড. কামাল হোসেনের সাথেও কথাবার্তা চলছে। কাদের সিদ্দিকীকেও ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হচ্ছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে যে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি, বাসদ প্রভৃতি বাম দলও যদি সরকার বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল হয় তাহলে তাদেরকেও সেই প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করা হবে।
এই বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ড. কামাল হোসেনের বিদেশ যাত্রার ফলে ঐক্য প্রক্রিয়ার একটি পর্যায় থেমে আছে। অন্যদিকে পবিত্র মাহে রমযানের কারণেও সেই প্রচেষ্টায় আপাতত ভাটা পড়েছে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর সেই প্রচেষ্টা আরো জোরদার হবে বলে জানা গেছে। আগামী জুলাই মাসে সরকার বিরোধী বৃহত্তর ঐক্যের একটি রূপ রেখা প্রণয়নের চেষ্টা চলছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রস্তাবিত বৃহত্তর ঐক্য হবে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। নির্বাচন বা আসন বন্টন নিয়ে যে সব মিডিয়ায় খবর বের হচ্ছে সেই সব খবরের কোনো ভিত্তি নাই বলে জানা গেছে। ঐক্য প্রচেষ্টা সফল হলে জুলাই মাসের পর যে কোনো সময় সন্মিলিত বিরোধী দল রাজপথে নেমে আসবে। আর যদি বৃহত্তর ঐক্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় তাহলেও ২০ দলকে সংগে নিয়ে বিএনপি রাজ পথে নেমে আসবে।
[email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ