রবিবার ২৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ডাকঘর : ব্যক্তিক চিন্তার নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশ

আখতার হামিদ খান : নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির এক বছর আগে (১৯১২) রচিত ‘ডাকঘর’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিসাগরে এক মুল্যবান মুক্তো হিসেবে বিবেচিত। এর রচনাকাল সম্পর্কে সুকুমার সেন বলেছেন যে, ‘গীতাঞ্জলির শেষ গান লেখা হয় ৩০ শ্রাবণ ১৩১৭, গীতিমাল্যের প্রথম গান ১৫ চৈত্র ১৩১৮। গীতিকাব্য-পালর এই ফাঁকের মধ্যে রাজা, অচলায়তন ও ডাকঘর এই তিনখানি ভাবনাট্য রচিত।’ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রথম বিশ^যুদ্ধ-পূর্ব মনীষীদের চিন্তা-সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রভাবনা এখানে প্রকাশিত। ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে/ সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে’ বলে ‘গীতাঞ্জলি’তে যেমন সহনশীলতা ও বিনয়ের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শিত হয়েছে, তেমনি ওই গ্রন্থেই আছে সুকৃতির সন্ধান ও মরণের মধ্যেও অমর হবার আকাঙ্খা: ‘রূপ-সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ-রতন আশা করি:/ ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।/ সময় যেন হয় রে এবার ঢেউ-খাওয়া সব চুকিয়ে দেবার, / সুধায় এবার তলিয়ে গিয়ে অমর হয়ে রব মরি।’ ‘ডাকঘর’ এর অল্প কিছু দিন পরে রচিত। নাটকটি রচনা প্রসঙ্গে ১৩২২ বঙ্গাব্দের ৪ঠা পৌষ শান্তিনিকেতনে এক বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন: 

‘ডাকঘর যখন লিখি তখন হঠাৎ আমার অন্তরের মধ্যে আবেগের তরঙ্গ জেগে উঠেছিল।....প্রবল একটা আবেগ এসেছিল ভিতরে: চলো চলো বাইরে, যাবার আগে তোমাকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে হবে, সেখানকার মানুষের সুখদুঃখের উচ্ছ্বাসের পরিচয় পেতে হবে। সে সময় বিদ্যালয়ের কাজে বেশ ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কী হল, রাত দুটো-তিনটের সময় অন্ধকার ছাদে এসে মনটা পাখা বিস্তার। করল।...আমার মনে হচ্ছিল একটা কিছু ঘটবে, হয়তো মৃত্যু। স্টেশনে যেন তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠতে হবে সেই রকমের একটা আনন্দ আমার মনে জাগছিল। যেন এখান হতে যাচ্ছি। বেঁচে গেলুম। এমন করে যখন ডাকছেন তখন আমার দায় নেই। কোথাও যাবার ডাক ও মৃত্যুর কথা উভয় মিলে, খুব একটা আবেগে সেই চঞ্চলতাকে ভাষাতে ডাকঘরে কলম চালিয়ে প্রকাশ করলুম।’

অতএব, বোঝাই যাচ্ছে, ‘ডাকঘর’-এ আছে সুদূরে আহ্বান, মানুষের ছোট-বড় কীর্তির মধ্য দিয়ে যা অনন্তে পরিব্যাপ্ত। সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘ডাকঘর নাটকে কবি মানবমনের সুদূরের জন্য আকাক্সক্ষার ও তাহার মুক্তির চিত্র আঁকিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত একটি বোধ, অভিজ্ঞতা ও সুতীব্র অনুভূতি কিভাবে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে, ‘ডাকঘর’-এ সে প্রমাণ মেলে। একজন শক্তিশালী লেখক এভাবেই এক থেকে বহুজনের অন্তরে চিন্তায় সঞ্চরণ ঘটান। ‘ডাকঘর’ বাংলার লোকজীবন অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন অতি পরিচিত পরিবেশ অবলম্বনে রচিত নাটক। কিন্তু এখানে লোকজ সরল কোন বক্তব্য নেই; আছে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের প্রতি আসক্তি, ভালবাসার অন্তঃস্থিত বেদনার রাগিনি, বিচ্ছেদের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মোহময় অখ-নীয় আকর্ষণ। ‘ডাকঘর’ সমকালে রচিত অন্য রবীন্দ্রনাট্যসমূহ থেকে এই নাটক পৃথক এ-কারণে যে, এখানে আছে মৃত্যুকে অবলম্বন করে অমৃতলোকের সন্ধান, তবে পৃথিবীর প্রতি আকর্ষণকে গৌণ করে নয়। অমল গুপ্ত নামের এক কিশোর এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। অমল যদিও একটি ব্যক্তিনাম, আসলে তা একটি বোধের প্রতীক। এই অমল আসলেই প্রকাশ্য নয়, ‘গুপ্ত’। মানুষের মনে নাটিকা আধারে ব্যক্ত করেছেন। নাটকে অমলের কোন বাস্থান নেই, সে ত্রিলোকচারী। ধরালোক, স্মৃতিলোক, আত্মিকলোক-এই তিনলোকের সমন্বয়ে অমলের বাসস্থান গড়ে উঠেছে; যেমন গড়ে ওঠে কোন মানুষের চিন্তনরাজ্য।

ইতঃপূর্বে উল্লেখিত রবীন্দ্র-ভাষ্যে বোঝা যায় যে, ‘কোথাও যাবার ডাক’ বা সুদূরের জন্য ব্যাকুলতাই ‘ডাকঘর’ রচনার মুলে। নিঃসন্তান মাধব দত্ত পোষ্যপুত্র অমলের অসুস্থতার জন্য কবিরাজের পরামর্শে তাকে গৃহবন্দি করে রাখে। কিন্তু অমল আধখোলা গবাক্ষ পাশে বসে বাইরের চঞ্চল জগতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে চান, ছটফট করে বইরে বের হবার জন্য। সুকুমার সেন এ প্রসঙ্গটি দুটি সাদৃশ্য, দুটি লেখক- অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন:

‘দোতলার গৃহকোণাবদ্ধ শিশু রবীন্দ্রনাথ গবাক্ষপথে বহিঃপ্রকৃতির রূপরস পান করিয়া কল্পানাকে নিরুদ্দেশে ছাড়িয়া দিতেন। তাহারি

পটভূমিকায় প্রৌঢ় কবি তাঁহার অধ্যাত্মরসকল্পনা অধিক্ষেপ করিয়া

অমলের ভূমিকা সৃষ্টি করিলেন। মুমূর্ষু মধ্যম কন্যার ক্ষীণছায়াও 

বোধ করি স্থানে স্থানে পড়িয়াছে।’

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্র-জীবনী’তে মন্তব্য করেছেন যে, লেখকের বাল্যকালের রুদ্ধ জীবনের ছায়া অমল চরিত্রে পড়েছে।

সুকুমার সেন যে মধ্যম কন্যার কথা বলেছেন, তার নাম রেণুকা আমাদের মনে হয়, অমল সৃষ্টির পেছনে লেখকমনে কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু খানিকটা হলেও প্রভাব ফেলেছে। অমলের সঙ্গে মেলান যায় রবীন্দ্র-ছোটগল্পের ‘গৃহ-প্রবেশ’ এর যতীন, ‘অতিথির’ তারপদ, ‘ছুটি’র ফটিককে, বিরূপ পরিপাশের্^ যারা অ্িস্থর হয়ে উঠেছিল। তাদের এই অস্থিরতা সমস্ত পৃথিবী পর্যবেক্ষণের জন্য্ রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছেন:

‘আমার মন এই কথা বলছে যে, যে পৃথিবীতে জন্মেছি সেইপৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে নিয়ে তবে তার কছ থেকে

বিদায় নেব। এরপরে আর ত সময় হবে না। সমস্ত পৃথিবীল

নদীগিরিসমুদ্র এবং লোকালয় আমাকে ডাক দিচ্ছে- আমার চারদিকে ক্ষুদ্র পরিবেষ্টনের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়বার জন্যে চান

উৎসুক হয়ে পড়েছে।....আমাদের কর্ম ও সংস্কারের আবর্জনা দিনে দিনে জমে উঠে চার দিকে একটা বেড়ে তৈরি করে তোলে।

আমরা চির জীবন আমাদের নিজের সেই বেড়ার মধ্যেই থাকি,জগতের মধ্যে থাকি নে। অন্তত মাঝে মাঝে সেই বেড়া ভেঙে

বৃহৎ জগতটাতে দেখে এলে বুঝতে পারি আমাদের জন্মভূমিটি কত বড়-বুঝতে পারি জেলখানাতেই আমাদের জন্ম নয়। তাই

আমার সকলের চেয়ে বড় যাত্রার পূর্বে এই একটি ছোট যাত্রাদিয়ে তার ভূমিকা করতে চাচ্চি- এখন থেকে একটি একটি করে

বেড়ি ভাঙতে হবে তারই আয়োজন।

রবীন্দ্রনাথ চিঠিটি লিখেছিলেন ‘ডাকঘর’ রচনার সমকালে, ২২ শে আশি^ন, ১৩১৮ বঙ্গাব্দে। এই চিঠিতে তিনি ‘পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে’ আসার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। চার বছর পরে, ১৩২২ বঙ্গাব্দের ৪ঠা পৌষ ‘ডাকঘর’ নাটক সম্পর্কে আলোচনাকালেও তিনি বলেছেন, ‘যাবার আগে তোমাকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে হবে’। অর্থাৎ ‘ডাকঘর’ রচনাকালে পৃথিবীর প্রতি আকর্ষণ ছিল রবীন্দ্রমনের প্রধান আকুতি। মৃত্যুকে অবজ্ঞা তিনি করেননি, কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য জেনেও পৃথিবীর প্রতি যে মমত্ববোধ এখানে প্রকাশিত তার মূল্য অনেক। নাটকে অমল গৃহে বন্দি, তার পৃথিবীও জানালা দিয়ে লেখা। কিন্তু তা কোনভাবেই খ-িত- এ কথা ভাববার কারণে নেই।

অমল সমস্ত পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছে অন্য চরিত্রগুলোকে অবলম্বন করে। লেখক- কল্পনা ও নাট্যরচনায় এ এক উৎকৃষ্ট কৌশল। প্রহরী, দইওয়ালা, সুধা, ছেলের দল- এরা সবাই চলতি পথের পথিক। পৃথিবীর প্রতি আকর্ষণ তীব্র ছিল বলে অমল এই সব গৃহীত অথচ মুক্ত পৃথিবীতে স্বচ্ছন্দ বিচরণশীল মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের নিবিড়তা গড়তে চেয়েছে। আর উল্লিখিত চরিত্রসমূহ অমলের নির্মল প্রাণে বহির্জগতের বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণের প্রতিবিম্ব ও প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এ কাজ করার জন্য তারা বক্তব্যে কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও ছলের আশ্রয় নিয়েছে।  অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে অমলের এই সখ্য ভাব কবিরাজ ও মাধব দত্ত সহ্য করতে পারে না। মাধব দত্ত অমলকে বলেছে:

‘সেখানে বসে বসে তুমি এই শহরের যত রাজ্যের ছেলেবুড়ো

সকলের সঙ্গেই ভাব করে নিয়েছ- আমার দরজার কাছে রোজ

যেন একটা মস্ত মেলা এসে যায়- এতেও কি কখনো শরীর

টেঁকে! দেখো দেখি, তোমার মুখখানা কি রকম ফ্যাকাশে হয়ে

গেছে!’

আর কবিরাজ মাধব দত্তকে উদ্দেশ্য করে বলেছে:

‘ও দরজাটা বেশ ভালো করে তালাচাবি-বন্ধ করে দাও। নাহয়

দিন দুই-তিন তোমাদের এখানে লোক আনাগোনা বন্ধই থাক

না।’

মাধব দত্ত ও কবিরাজের এই নিষেধ অমলের বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের আগ্রহকে ছিন্ন করে। তারপরও সে এসব বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করতে চায়। অমল যেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই নিরুদ্দেশ মেঘ, যা পশ্চাতের শক্ত বাধা ছিন্ন করে সুদূরের আহ্বানে সাড়া দিতে চায়। ঠিক যেন:

‘পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;

তরুশ্রেণী চাহে পাশা মেলি

মাটির বন্ধন ফেলি

ওই শব্দরেখা ধরে চকিতে হইতে দিশাহারা,

আকাশের খুঁজিতে কিনারা।’

অমল সুদূরের হাতছানি পায় দইওয়ালা, প্রহরী, সুধা প্রমুখের কাছে, যরা ক্ষণিক কথা বলেই দূর দেশের পথ-নির্দেশ করে চলে যায়। নাটকে দেখা যায়, পাহাড়ের চূড়া থেকে রাঙামাটির পথ দিগন্তে মিশে যায়, হীরা গলানো, ঝর্ণাধারা অমলের হৃদয়ে ডাক দিয়ে যায় অজানা আনন্দের। ‘ডাকঘর’ রচনার সময় রবীন্দ্র-মানসে যে বিশ^বীক্ষা কার্যকর ছিল তাতে দেখা যায়, ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের আহ্বান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ধর্মের অর্থ’ প্রবন্ধেও এই কথাগুলো বলেছেন। তার বন্ধু এন্ড্রুজকে এক চিঠিতে লিখেছেন:

‘ও ৎবসবসনবৎ, ধঃ ঃযব ঃরসব যিবহ ও ৎিড়ঃব রঃ [ঞযব ঢ়ড়ংঃ ঙভভরপব], সু ড়হি ভববষরহম যিরপয রহংঢ়রৎবফ সব ঃড় ৎিরঃব রঃ. অসধষ ৎবঢ়ৎবংবহঃং ঃযব সধহ যিড়ংব ংড়ঁষ যধং ৎবপবরাবফ ঃযব পধষষ ড়ভ ঃযব ৎড়ধফ- যব ংববশং ভৎববফড়স ভৎড়স ঃযব বহপষড়ংঁৎব ড়ভ যধনরঃং ংধহপঃরড়হবফ নু ঃযব ঢ়ৎঁফবহঃ ধহফ ভৎড়স ধিষষং ড়ভ ৎরমরফ ড়ঢ়রহরড়হ নঁরষঃ ভড়ৎ যরস নু ঃযব ৎবংঢ়বপঃধনষব.

এই রবীন্দ্র-বক্তব্যের মত অমলের সুদূরচারী মনোভাব পাঠকের মনেও দূরের আহ্বান জানায়। আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত, যা ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ‘বিচিত্র’ ভবনে ‘ডাকঘর’ অভিনয়কালে গীত হয়েছিল:

‘আমি উন্মনা হে,

সে সূদুর, আমি উদাসী॥

রৌদ্র-মাখানো অলস বেলায়    তরুমর্মরে ছায়ার খেলায়

কী মুরতি তব নীল-আকাশে নয়নে উঠে গো আভাসি।

হে সুদূর, আমি উদাসী।’

‘আমি চঞ্চল হে/ আমি সুদূরের পিয়াসি’ বলে যে সঙ্গীতের সূচনা, সেই গানেই ব্যক্ত হয়েছে এই উদাস হবার কথা। অমলের এই উদাস হওয়া বা সুদূরচারী মনোভাব ধরালোক, স্মৃতিলোক ও আত্মিকলোককে অবলম্বন করে প্রকাশিত হলেও এর কেন্দ্র ধরালোকে। পৃথিবীর রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ সে উপভোগ করতে চাইলে তাকে বাধা দেয়া হয়। কাঠবেড়ালির খুদ খাওয়া দেখে অমল সেখানে যেতে চায়, কিন্তু পারে না। এখানে ধরালোকেরা প্রতি অমল সেখানে যেতে চায়, কিন্তু পারে না। এখানে ধরালোকের প্রতি তার আকুতি প্রকাশিত। তাছাড়া পৃথিবীর সবার প্রতি অমলের সম্পর্কের কথা ব্যক্ত হয়েছে এভাবে:

‘কত বাঁকা বাঁকা ঝর্ণার জলে আমি পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে পার হতে

হতে চলে যাব- দুপুর বেলায় সবাই যখন ঘরে দরজা বন্ধ করে

শুয়ে আছে তখন আমি কোথায় কত দূরে কেবল কাজ খুঁজে খুঁজে

বেড়াতে বেড়াতে চলে যাব।’

ঝর্নার জলে পা ডুবিয়েই নয়, খেপার মত ছাতু খাওয়ার ইচ্ছাও ব্যক্ত হয়েছে অমলের মুখ থেকে: ‘ঐ ঝর্নার ধারে গিয়ে একদিন আমি ছাতু খাব।’ এখানে ধরালোকে বিচরণ ও খাদ্যগ্রহণের আগ্রহের মধ্যে কিছুটা রোমিন্টকতাও প্রকাশিত। পৃথিবীর সৌন্দর্য ও প্রেমরূপী সুধার সঙ্গে অমলের সখ্যও গড়ে ওঠে এবং সে কারণে তার মনে জাগে বিচিত্র জীবনযাপনের সাধ।

ধরালোকের সঙ্গে সঙ্গে অমল হয়েছে স্মৃতিলোকের বাসিন্দাও। সে পৃথিবীকে সহজ-সরলভাবে দেখে তার মধ্য দিয়েই জীবনের কঠিনতম সত্য প্রকাশ করেছে। দইওয়ালার সঙ্গে কথা বলার সময় স্মৃতিময় দৃশ্যকল্পের সাহায্যে যা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে তা তার স্মৃতিলোককে প্রকাশ করে। তাই দইওয়ালার সঙ্গে কথা বলার সময় তার মনে হয়েছে যে, শ্যামলী নদীর তীরের গ্রামটাকে সে হয়ত চেনে। অমল বলছে; ‘না, কোনোদিন যাইনি। কিন্তু আমার মনে হয় যেন আমি দেখেছি।’ অমল এই নাটকে ‘যেন’, ‘মনে হয়’ ইত্যাদি সংশয়বাচক শব্দের ব্যবহার করে এমন একটি আবহ সৃষ্টি করেছেন, তাতে ‘সোনার তরী’র দেখে যেন মনে হয়’- এর সঙ্গেই শুধু এর সাদৃশ্য মেলে। রাজার চিঠি ডাকহরকরা পাহাড়ের উপর থেকে নেমে এসে বিলি করবে, অমলের বিশ^াস এই। স্মৃতিলোকে তাই সে দেখতে পায়, ‘আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই- মনে হয় আমি অনেকবার দেখেছি, সে অনেকদিন আগে, কত দিন তা মনে পড়ে না।’ এ-সব স্মৃতিনির্ভরতার মধ্যে দিয়ে অমল ঐতিহ্যলোকে বা পূর্বকালের বা পূর্বকালের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অভিলাষ ব্যক্ত করেছে। সুধার কাছে অমল বলেছে, ‘আমি সাত ভাই চম্পর খবর জানি। আমার মনে হয়, আমাকে যদি সবাই ছেড়ে দেয় তা হলে আমি চলে যেতে পারি- খুব ঘন বনের মধ্যে যেখানে রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না।’ এই যে অনন্তের পথে চলে যাওয়া, এর মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেয়েছে অমলের স্মৃতিলোক থেকে আত্মিকলোকে বিচরণের স্পৃহা। তাই রোগশয্যায় অমল ঠাকুরদার বোনঝিকে বিয়ের বিষয় স্মরণ করেও সাতভাই চম্পার কথা ভুলতে পারেনি, বলেছে তার পাশে বসে সাতভাই চম্পার গল্প বলতে। মূলত ধরালোক ও স্মৃতিলোক পরিভ্রমণ শেষ হলে শয্যাগত অমল আত্মিকলোকের জন্য মনোগত টান অনুভব করে। এ কারণে সাতভাই চম্পাকে সে ভুলতে পারে না। মৃত মা-বাবার কথাও অমল শুনতে পায় বলে বোধ করে। অতীন্দ্রয় রূপকল্পের মাধ্যমে অমল আত্মিকলোকের ভাবানুষঙ্গ সৃষ্টি করেছে, এ আসলে লেখকেরই কীর্তি; ‘আমি যেন অনেক দূরের কথাও শুনতে পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে, আমার মা, আমার বাবা যেন শিয়রের কাছে কথা কচ্ছেন।’ নাটকের শেষ পর্যায়ে অমল যখন ঘুমিয়ে যায় এবং এর পর আর জাগে না, তখন রাজকবিরাজ বলেছে: ‘আমি বালকের শিয়রের কাছে বসব- ওর ঘুম আসছে। প্রদীপের আলো নিবিয়ে দাও- এখন আকাশের তারাটি থেকে আলো আসুক, ওর ঘুম এসেছে।’ এ কথার মধ্যেও অমলের আত্মিকলোকে পরিভ্রমণের ব্যঞ্জনা লক্ষ্য করা যায়।

‘ডাকঘর’ নাটকের রচনাকুশলতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ চমৎকার কছু রূপকল্প সৃষ্টি করেছেন। তিনি জীবন প্রাচুর্য সম্ভাবনাময় অমলের ত্রিলোকচারিতা ফুটিয়ে তুলেছেন আপন অভিজ্ঞতা ও বোধের আলোকে। রীবন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ‘আমার মনের মধ্যে বিচ্ছেদের বেদনা ততটা ছিল না। চলে যাওয়ার মধ্যে যে বিচিত্র আনন্দ তা আমাকে ডাক দিয়েছিল।’ এই ‘বিচিত্র আনন্দ’ ও ‘ডাক’ উভয়ই রবীন্দ্র-বীক্ষাভুক্ত। এখানে অভিজ্ঞতা ও বোধ যে রূপকল্পে রূপায়িত হয়েছে, এর মধ্যেই রয়েছে অমলের পাখি হবার তাড়না। ‘আমি যদি পাখি হতুম তা হলে’- বলে অমলের পাখি হবার আকাক্সক্ষা, কখনও ডাকহরকরা হবার ইচ্ছাপোষণ- ‘বড়ো হলে আমি রাজার ডাকহরকরা হব’ ইত্যাদি অমলের সুদূরচারী মনোভাবের পরিচায়ক, সেটা রবীন্দ্রনাথেরও ‘বিচিত্র আনন্দের ডাক’। যে পাখি উড়ে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে, যে ডাকহরকরা চিঠি বিলি কর ‘ঘরে ঘরে, দেশে দেশে-’ এই সুদূরচারী অভিলাষেই অমল ত্রিলোক পরিভ্রমণ করেছে। এ-কারণে অমল বলেছে: আমার ভারি ইচ্ছে করছে, ঐ সময়ের সঙ্গে চলে যাই- যে দেশের কথা কেউ জানে না সেই অনেক দূরে।’ 

রবীন্দ্র-কবিতায় পর্বত যেখানে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ হতে চায়, সেখানে দূর দেশের ডাক, অমলের মত, প্রতিটি মানুষের মনেই প্রতিধ্বনিত হওয়া, সে তো স্বাভাবিক। তবে এখানেই নাটকটি সমাপ্ত নয়। শশী মালিনীর মেয়ে সুধা- যাকে রোজ এত এত ফুলের মালা গাঁথতে আরও গভীরতর সম্পর্ক স্থাপন করে, নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়ে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের পত্রে লেখা ‘পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে’ নেয়া। ‘ডাকঘর’-এ পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা গেছে সুধার নিবিড়তায় মধ্যে। ‘সুধা’ নামটিও এখানে খুব ব্যঞ্জনাবহ। মর্তের অমিয় সুধায় মনুষ্য প্রজাতি যেন সতত মূহ্যমান। নাটকের সমাপন সংলাপ: ‘বোলো যে সুধা তোমাকে ভোলেনি।’ এই না-ভোলাই মর্ত্যাকর্ষণ। ‘ডাকঘর’ এ ত্রিলোকচারিতার মধ্যে এই অনুভবই মুখ্য।

প্রথম বিশ^যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, সংশয় ধ্বংস-ভয় অমঙ্গল-বার্তা ইত্যাদি শ্রবণ করেও রবীন্দ্রনাথ পৃথিবী-বিমুখ ছিলেন না। ত্ইা বলে অমল কোন তত্ত্ব সংস্থাপনের পাত্রেও পরিণত হয়নি তবে তাকে কেন্দ্র করেই একটি ব্যক্তিগত বোধ, বিশেষ অভিজ্ঞতা ও সুতীব্র অনুভূতি যে কীভাবে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্পে রূপায়িত করে দিয়েছেন। তাঁর মত শক্তিশালী লেখক এভাবেই এক থেকে বহুজনের অন্তরে চিন্তার সঞ্চরণ ঘটাতে সক্ষম হন। এভাবেই ‘ডাকঘর’ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক চিন্তার নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ