রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ সমস্যা ও সমাধান

সামিউল বিল্লাহ সোহান : মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) রাজ্য মুসলিমরা প্রায় আটশ’ বছর শাসন করার পর ১৭৮৪ সালে মগদের দখলে আসে। পরবর্তীতে রাজ্যটিকে আরাকান নামের পরিবর্তে রাখাইন নামকরণ করা হয়। কারণ আরাকান নামটির উৎপত্তি করেছিল রাজ্যের তদানীন্তন ক্ষমতাসীন মুসলিম শাসকগণ। মুসলিমরা আরাকান রাজ্য প্রায় আট’শ বছর শাসন করা সত্বেও আরাকানের (রাখাইন) মুসলিমদের আজও মাথা গোঁজার ঠাঁই হচ্ছে না মাতৃ ভূ-খন্ডে। বারবার অবহেলিত হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে খুঁজে নিতে হচ্ছে ধার্মিক রক্তে গড়া প্রতিবেশি ভাইয়ের ঠিকানা।
২৫শে আগস্ট ২০১৭ থেকে অগ্নি রাজ্যে পরিণত হয়েছে মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন)। রাখাইন রোহিঙ্গাদের উপর পৈচাসিক নির্যাতন ও অমানবিক কর্মকান্ড প্রতিনিয়তই মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানাচ্ছে। প্রথমত ধারণা করা হয়েছিল শুধু রোহিঙ্গা মুলমানদের উপর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিত ভাবে হামলা চালাচ্ছে অথচ বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে শুধু রোহিঙ্গা মুসলিম নয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথে সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ ও গণহত্যা কান্ড পরিচালিত হচ্ছে। সেই সাথে নারী ধর্ষণ ও লুটপাট থেমে নেই। মিয়ানমার সরকারের সূত্র মতে জানা যায় রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৩০ ভাগ রোহিঙ্গা গ্রামই এখন জনশূন্য (১৬-০৯-১৭ দৈনিক প্রবর্তন, ১ম পৃষ্ঠা)। আরাকানের (রাখাইন) ঘরবাড়ি গুলো কঠিন ভষ্ম হওয়ার সাথে সাথে গুড়িয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রতিপালিত স্বপ্ন। ইতোমধ্যে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখনো সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে দমন ও উৎপীড়িত সহস্রাধিক রোহিঙ্গা। পূর্বে যে রোহিঙ্গা শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অবস্থান করেছে প্রতিকূল পরিবেশে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে ও অকাতরে প্রাণ স্বপ্নের মাতম তান্ডবে মেতে আছে। অনেকেই দগ্ধ ও গুলিবিদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে জনসংখ্যা অনুযায়ী পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় খোলা স্থানে মলত্যাগ বা জনপরিস্থিতির অসহিংসু পরিবেশে ছড়াচ্ছে বিভিন্ন রোগ ব্যাধি।
বিশ্ব মানবতার জন্য মানবিক কারণে যে কোন দুস্থ মানুষ গুলোকে আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের মৌলিক দায়িত্ব। এটা বাংলাদেশের সংবিধানে পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ আছে (০৯-০৯-১৭ দৈনিক প্রবর্তন, ২য় পৃষ্ঠা)। অথচ বিভিন্ন বৈদেশিক মানবতাবাদী সমাজ ও সংগঠন থেকে বিপুল পরিমাণ ত্রাণ আসলে ও তা দু-তিন অংশ যাচ্ছে সেবক নামে মুখোশধারী চেয়ারে বসা মানুষের পেটে। আর ত্রাণের এক ভাগ পেয়ে না খেয়ে পরিস্থিতি কাটাতে বাধ্য হচ্ছে ঘরছাড়া মানুষ গুলো (আরটিভি সংবাদ)।
একজন বিশিষ্ট মহাদয় বলেছিলেন কোন রোহিঙ্গা না খেয়ে মরবে না, ত্রাণ দেওয়া অব্যাহত থাকবে (২৩-০৯-১৭ দৈনিক প্রবর্তন,১ পৃষ্ঠা)। সমকালিন রোহিঙ্গা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে এ মতামতটি জন সম্মুখে ন্যস্ত করা হলো। বাংলাদেশের কিছু কিছু পৈশাচিক মানবতাবিরোধী ব্যক্তিবর্গ শরণার্থী রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের লালসা দেখিয়ে জোরপূর্বক তাদের নিকট থেকে বিপুল অর্থ ও সম্পদ কেড়ে নেওয়া এবং অর্থ দিতে অস্বীকার করলে মারপিট ও ঘরে বন্দি করে রাখার মতো ঘৃণিত কর্মকান্ডও ঘটেছে।
১৯৮৯ সালে বিবেক আলোড়িত কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ সুনিদিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে তদানিন্তন বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা এবং কুটনৈতিক তৎপরতায় মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের আরাকান (রাখাইন) রাজ্যে ফেরত পাঠাতে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করেছিল। পরবর্তিতে ১৯৯২ সালে একই ভাবে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হয় (০৯-০৯-১৭ দৈনিক প্রবর্তন, ২য় পৃষ্ঠা)।
 রোহিঙ্গা মুসলিমরা শুধু সামরিক নির্যাতিত নয়। ক্ষমতাহীন ও সত্যের সম্মুখ যাত্রা এবং সংখ্যা লঘু হয়ার কারণে বারবার নৃশংসভাবে নির্যাতন হচ্ছে। তাহলে বিশ্ব বিবেক আজও কেন নিশ্চুপ? তবে কি বিশ্ব মুসলিম সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করুক আজকে মানবতা অন্ধ ? রোহিঙ্গা মুসলিমদের পবিত্র রক্ত দেশ-বিদেশের প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধন ও মিছিলের মধ্যেই কি সীমাবন্ধ ? সূত্র মতে জানা যায়, মিয়ানমারের সাথে পাশ্চাত্যের মুসলিম দেশগুলো বাণিজ্যিক বিনিয়োগ ক্ষুন্ন করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ তারা মিয়ানমারের সামরিক অস্থিতিশীলতায় আর্থিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনায় চুক্তি ফিরিয়ে নিচ্ছে (২৩-০৯-১৭ দৈনিক প্রবর্তন, ১ম পৃষ্ঠা)। আমার প্রশ্ন-মানবতা কি বাণিজ্যিক তৎপরতার মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকবে।
প্রতিবেদন অনুসারে, মিয়ানমার সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য করে থাকে চীনের সঙ্গে (এনটিভি সংবাদ)। চীন, ভারত এবং রাশিয়ার লোভনীয় মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সম্পদের পরিপূর্ণ মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) রাজ্যের দিকে। সেখানে গ্যাস, কয়লা উত্তোলন, সমুদ্র বন্দর ও বিদ্যুৎ খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করায় তারা মানবতার পক্ষে কথা বলার মানবিক শক্তি হারিয়েছে এবং সুযোগে রয়েছে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ ভেটো দেয়ার অপেক্ষায়।
 রোহিঙ্গা মুসলিমরা আরাকানের (রাখাইন) সম্পদ চালিত বহিরাগত রাষ্ট্রের লালিস্য গোপন হাতে বাধা দেয়ায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠির কয়েক’শ সদস্যকে দমনের নামে প্রতিরক্ষা বাহিনী দ্বারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা, বাড়ি-ঘর পুড়ানো, ধর্ষণ ও লুটপাট মেনে নেয়ার অযোগ্য। সুচির বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে- জীব হত্যা মহাপাপ। তবে সুচির নিকট প্রশ্ন- রোহিঙ্গাদের কে মানুষ হিসাবে নাহি ভাবলাম। কারণ তোমরা ওদের কে মানুষ হিসাবে গন্য করো না। ওরা কি জীবও নয় ?
ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেছেন। তুরস্কেও র্ফাস্ট লেডি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির ঘুরে দেখেছেন এবং প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাহয়িফ এরদোয়ান রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। ইউরোপিয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য পরিস্থিতিকে অত্যন্ত ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে মিয়ানমারকে পরামর্শ দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি এসিসটেন্ট সেক্রেটারী বলেন, এই সংহিংসতা বন্ধে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে, মানবতার কার্যক্রমে ত¦রান্বিত করতে হবে, উত্তেজনা ও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা গুলো সমাধানে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এক বিবৃতিতে জাতি সংঘের মহাসচিব বলেছেন- রোহিঙ্গা পরিস্থিও উপর নজর রাখা হয়েছে। তিনি নিরাপত্তা পরিষদেও সভাপতির নিকট লেখা এক চিঠিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করে। আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন (০৯-০৯-১৭ দৈনিক প্রবর্তন ১মপৃষ্ঠা)
তবে বিশ্ব বিবেকের নিকট প্রশ্ন, সামরিক আলোচনা ও বক্তব্য মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে রোহিঙ্গাদের পবিত্র রক্ত, স্বাধীন ভাবে বাচার স্বপ্ন ও নাগরিকত্ব ?
আমি বিশ্ব মুসলিম সমাজকে প্রশ্ন বিদ্ধ করবো, জাতিসংঘ কি আদৌ কোন সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে ? আমার জানা নেই। জাতিসংঘ হলো সকল জাতির ঐক্য গড়া ফিরিয়ে আনার বিশ্ব সংগঠন। অন্য ধর্ম-বর্ণের মানুষকে যদিও শান্তি ফিরিয়ে দিক আজও মুসলমানদের ঘরেঘরে শান্তির প্রদীপ জলেনি ? বিশ্ব মুসলিম সমাজ কি জাতিসংঘ থেকে কি আলাদা ? যদি আলাদা না হয় তবে বিশ্ব মুসলিম কেন আজও নিষ্পেষিত ? আমরা বিশ্ব মুসলিম সমাজ কি পারি না জাতিসংঘকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে একটি মুসলিম জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে। তাহলে সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তীন, চেচনিয়া, বসনিয়ার মতো মুসলিম রাষ্ট্রগুলো পরমাণুর বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হতো না। অমীমাংসীত থাকতো না সাদা চামড়ার মস্তিষ্কে ভেটো লাগানো ক্ষণবিরতি যুদ্ধাস্ত্র ভারতের কাশ্মির রাজ্যটি। ইতিহাস সৃষ্টি হতো না রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ