রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

রাজনীতির পূর্ণগ্রাস বনাম রাজনৈতিক পরিণতি

এম. কে. দোলন বিশ্বাস : আজকের নিবন্ধটি নিতান্তই বাস্তবভিত্তিক একটি ব্যতিক্রম প্রকাশনা। যে কোনো বিষয় পূর্ণগ্রাস হলে তার শেষ অবধি পরিণতি বা ফলাফল কী বা হতে পারে, আজকের নিবন্ধে তারই যৎসামান্য আলোকপাত। শেষ পরিণতির বিষয়ে বাংলায় নতুন কিছু প্রবাদ সংযোজন করা যেতে পারে। যেমন- ‘যে খেলে তাস; তার গলায় বাঁশ’, ‘যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকে’; ‘লজ্জা-শরম নেই যার; সে তো নয় ঈমানদার’, ‘লাজ-শরম যার বালাইহীন; আসবেই তার দুর্দিন’, ‘কাজে কেল্লাফতে; কথায় নয়’, ‘তুই দিলে তো মুই দিমু; একা একা কতো দিমু’।
পূর্ণগ্রাস : রাজনীতিতে পূর্ণগ্রাসের কী যে নিদারুণ প্রাপ্তি তা বিস্তর বর্ণনা আজকের নিবন্ধে না করলেও পাঠকদের উদ্দেশে দায়সারা যৎসামান্য আলোকপাত না করলেই নয়। বিশেষ করে ভূরাজনীতির ডামাঢোলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতান্ধ রাজনৈতিকরা বাংলা রাজনীতিতে গণতন্ত্রকে একেবারে পূর্ণগ্রাস করে ছেড়েছে। কেন না, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিতদের তথাকতিথ জয়জকারের ফলাফল দেখে ভাতীয় চরিত্র টেনিদা এর নির্ঘাত জীবনের সেই আশ্চর্য ফুটবল ম্যাচখানি আবার স্মরণ করা যেতে পারে। ওই ফুটবল ম্যাচে আমন্ত্রিত খেলোয়াড় হিসেবে বর্ষাকালে গ্রামের মাঠে নেমে ছিলেন ভারতের পটলডাঙার ভজহরি মুখোপাধ্যায়। এসময় বৃষ্টি ঝরছিল মুষলধারে। যার ফলে অচিরেই পাশের পুকুর পানিতে ভাসল। খেলার বিপরীতি অন্য মষ্কে দুই দলের সব খেলোয়াড় মাছ ধরতে রওনা হল। কিন্তু রেফারি নিয়মনিষ্ঠ, খেলা বন্ধ করবেন না, অতএব তাঁর নির্দেশে টেনিদা ফাঁকা গোলে একের পর এক শট নিয়ে চললেন। বত্রিশ গোল করে তবে নিস্তার মিলল।
একাত্তরের সোনার বাংলার বিপরীতে আজ ডিজিটাল বাংলায়ও এ ধরনের রাজনৈতিক উদ্ভট খেলার মরশুমে মনে হয় যেনো জনপ্রিয়তার অতিবর্ষণ চলতেছে, তবে মা মাটি ও মানুষের দল প্রকৃতির সাহায্যের তোয়াক্কা করে না। বরং সবকিছুতেই দলীয় সর্বাধিনায়িকার আশীর্বাদের ক্যারিশমাই যথেষ্ট।
যার ফলে ১৪ জানুয়ারি মার্কায় অনুষ্ঠিত দশম সংসদের নির্বাচনে দলীয় নেত্রীর প্রসংশা কুড়াতে ভোটের মাঠে বাংলার দলকানা ইমামদের ‘নির্লজ্জ ইমামতি’ দেখার বির্হিবিশ্ব এক বিশাল অভিজ্ঞতা অর্জন করল। এ যাত্রায় বাংলার কতিপয় ‘স্বল্প ঈমান’ ওয়ালাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়লেও তাদের কুলমানের বালাই নেই। কারণ তারা স্বার্থান্ধ ছাড়াও একেবারে দলকানা।
সুতরাং ৩শত সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৪ টিতেই ঘাসফুল ফুঁটেছে, বাকী ১৪৬টি আসন হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে আওয়ামীযুক্ত অনুব্রত দলকানারা ক্ষমতার মসনদ স্থায়ীকরণের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক সহশিল্পীবৃন্দের নিয়ে নানাবিধ ফিকির-ফন্দি আঁটতে অন্ত নেই। জানুয়ারি মার্কা ওই নির্বাচন বয়কট করার অপরাধে আর হীন উদ্দেশ্য হাসিল করতে পল্লীবন্ধু খ্যাত একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানকে অসুস্থ্যতার ধোঁয়াতোলে চিকিৎসার নামে মাসির চেয়ে পিসির দরদ দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তি নাটক মঞ্চায়ন করে লীগবাদীরা।
হয়তো বা ভর্ৎসনার আশঙ্কা অন্তরে প্রবল ভাবে ভিড় করা থেকেই এমন উদ্ভট রাজনৈতিক নাটকের মঞ্চায়ন করা হয়েছে। ৩শ আসনে যদি ৩শতই না পাওয়ার ব্যর্থতায় দলীয় নেত্রী না জানি কী বলবেন!
ভোট গ্রহণের আগেই ৫৪ শতাংশ সংসদীয় আসনে জয়ী হয়েও লীগবাদীদের বুক ঢিপঢিপ। দুর্জনে বলে, এ কালের নামী-দামি কলেজের মতো গণতন্ত্রের রাজপুত্র ভারতের কালীঘাটেও নাকি ‘কাট-অফ’ ১০০ শতাংশ।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একশোয় একশো পেতে হবে এমন কথা গণতন্ত্রের কিতাবে এখনো লিপিবদ্ধ হয়নি। বরং গণতন্ত্রে বিরোধী দলের উপকারিতা নিয়ে শিক্ষার্থীরা রচনা লিখে থাকে। কিন্তু সর্বশক্তিমান হবার সাধনায় ওইসব কথা ভাবতে বসলে চলে না, সর্বগ্রাসী ক্ষমতার ক্ষুধাই ওই সাধনার দস্তুর।
পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতিতে তাবৎ ব্যাধির মতো এ সর্বগ্রাসিতার ব্যাধিটিও বামফ্রন্টের অবদান। তেমনই ভারতীয় চাবিতে এগিয়ে যাওয়া স্লোগানের এ বাংলায় অনুষ্ঠিত দশম সংসদের যাত্রীরাও ক্ষমতান্ধে চরম আক্রান্ত।
ক্ষমতার স্বর্ণযুগে ‘বিরোধীদের একটিও ভোট দিবেন না’ কথাটি তারা শুধু মুখে বলে বা দেওয়ালে লিখেও ক্ষান্ত হয়নি। প্রবল বিক্রমে কাজেও পরিণত করতে তৎপর হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদ হয়ে শেষ অবধি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামীবাদীদের গণতন্ত্র হত্যার বিজয়গাথা বিশ্ব ইতিহাসে অবিস্মরণীয়।
লক্ষণীয়, অঘোষিত ‘বিরোধীমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়বার প্রত্যয়েই যেনো আওয়ামী মহাজোট ও তাঁর পারিষদবর্গ বুঝাতে চাইছেন, ক্ষমতার ব্যাধি তাঁদের ভারতীয় মজ্জাগত।
কারণ ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়বার স্লোগান শানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর পারিষদবর্গ বুঝায়ে দিয়েছেন, বিজয়ের ব্যাধি তাঁদের একান্তই মজ্জাগত। বলা যেতে পারে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিআইএমের তীব্র বিরোধিতা করে ক্ষমতায় এসেছেন এবং ক্ষমতায় এসে বিজেপির তীব্র বিরোধিতা করতেছেন। একই সাথে তৃণমূল কংগ্রেসের সবই স্বচ্ছ, সবই নিরাবরণ এই দলের রথী মহারথী আধারথী সিকিরথীরা কোনো প্রকার রাখঢাক না করে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আপন প্রার্থীদের ‘জিতায়ে এনেছেন’। সবার উপরে অনুব্রত মন্ডল সত্য, তাঁর উপরে নেই, অতএব দুইটি ওয়ার্ড হারিয়ে তিনি সাফ ঘোষণা করেছেন; ওই দুই ওয়ার্ডে কোনো উন্নয়ন হবে না। অপরাধ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে!
আমরা বলতে চাই, রাজনীতির পরিসরকে বিরোধীশূন্য করবার প্রবল তাড়না গণতন্ত্রের স্বধর্ম নয়। যে ভাবে প্রশাসনযন্ত্র এবং দলতন্ত্রের অপব্যবহার করে স্বদলীয় তাড়নাকে রূপায়িত করা হচ্ছে, তা মোটেও গণতন্ত্রের নীতি নয়। তবে এ ঘোর কলিতে ধর্ম বা নীতির কথা বলা হয়তো অরণ্যে রোদনমাত্র, সুতরাং সে কথা থাকুক।
কিন্তু ক্ষমতাসীনরা একটি কথা ভেবে দেখতে পারেন। তা বাস্তববুদ্ধির বিষয়। নির্বাচনী রাজনীতির স্বাভাবিক চালটিকে বজায় রেখে চললে আখেরে তাঁদের দলেরই লাভ। যেন তেন প্রকারেণ তথা নির্বাচনে সব ভোট আপন ঝুলিতে পুরিতে ব্যগ্র হলে বিরোধী রাজনীতি তার স্বাভাবিক প্রকাশে ব্যর্থ হয়ে অস্বাভাবিক প্রকাশের পথ খুঁজবে। সেই সাথে বিরোধীরাও বেছে নিতে চাইবে তাদের চলার পথ। সেটা বাকা হোক কিংবা সরলপথই হোক কেনো। শেষ অবধি সেই অস্বাভাবিক প্রকাশের মোকাবিলা বহুগুণ কঠিন হতে বাধ্য। এমন সত্যের স্বরূপ বুঝবার জন্য অধিক দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতীয় চাবিতে দশম সংসদ নির্বাচনে খালি মাঠে নির্বাচনী গোল দিয়ে ম্যারোডনার কৃতিত্ব অর্জকারী লীগস্তবকরা আপন রাজনৈতিক সাফল্যের ইতিহাসের পাতা উল্টায়ে দেখলেই সত্য দেখতে পাবেন। মনে করতে পারেন, ভারতের নন্দরানি ডলেরা এখন কোথায়?
পরিণতি : পরবর্তীতিতে কী রূপে চলবে দেশের সংবিধান। এমন ভাবনা শুধুমাত্র বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা করতেন। এমন দাবি সর্বদাই কঠিন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানখানি যখন রচনা করা হয়, তখন বোধ করি সংবিধান প্রণেতা তিনিও জানতেন না, দেশের রাজনীতিকরা শাসনতন্ত্রের ফলিত রূপটির কী হাল করতে চাইবেন। যা আজ মঞ্চায়ন করে চলেছেন। এখন ওই ভাবনা আশাতুর, আবেগকম্পিত সূচনালগ্নের প্রায় সাড়ে চার দশক পরে বাংলার গণতন্ত্রের নিত্যকর্মপদ্ধতি দেখে খোদ সংবিধানপ্রণেতা স্বয়ংও নিশ্চয়ই হতবাক, যদি না তাঁর বাক্ ইতোমধ্যে হত হয়ে থাকে। আজাদি কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করার পর বাংলার আইনপ্রণেতারা জাতীয় সংসদ নামক ‘আইন কারখানা’ এর কক্ষটি নিয়ে বিস্তর ভেবে ছিলেন। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষ জনাদেশে নির্মিত আইনসভার পরে জনপ্রতিনিধিদের আরও একটি ম-লী কেনো সৃষ্টি করতে হবে, ওই প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজতে ছিলেন। উত্তরও ছিল একাধিক। এক দিকে সংসদে  দেশের জেলা থেকে শুরু করে তথা মফস্বল এলাকাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দানের মাধ্যমে উন্নয়ন স্বীকৃতি, অন্য দিকে আইনসভায় প্রণীত আইনগুলোকে জেলার ‘প্রবীণতর’ সদস্যদের বিবেচনার আঁচে এক বার ঝালিয়ে নেওয়া, এই দ্বিবিধ যুক্তিতেই সেদিন হয়তো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ধারণাটি গৃহীত হয়। এ ধারণার অনুষঙ্গেই ধরে নেওয়া হয়, স্থানীয় নির্বাচনের চরিত্রও হবে আইনসভা হতে স্বতন্ত্র শান্ত, নিন্তরঙ্গ ও নির্বিবাদ।
তবে এটাও সত্য যে, ওইসব বিগত শতাব্দীর ভাবনা। বিগত যুগেরও বটে। উন্নতর একবিংশ শতাব্দীতে দশম সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় নির্বাচনের উদ্যোগপর্ব মহাবাংলাকেও হার মানাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি একাত্তরের আওয়ামীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে। ভোটদিবসের ঘটনাবলি মহাজোটের দলকানা ইমামদের ইমামতিতে সতত কুনাট্যময় বাংলার রাজনীতিতেও নতুন নজির রচনা হয়েছে। নীতি বা আদশ্যের কথা হয়তো বিশেষ করে বাংলার সমকালীন রাজনীতিতে অবান্তর, কিন্তু অন্তত আত্মসম্মান বা চক্ষুলজ্জার নিতান্ত দৈনন্দিন ধারণাগুলোও ওই রাজনীতির তাড়নায় কীরূপ অবান্তর হয়ে গেছে, তার এমন নির্মম গণতন্ত্র হনন আওয়ামী প্রদর্শনী বাস্তবিক পক্ষেই স্তম্ভিত করে দেয়।
অতিশক্তিশালী ও অতিসম্পন্ন বিরোধী দল পাছা ভাঙিয়ে নেওয়া, ওই ভয়ে বিধায়কদের দল বেঁধে ভিন্ন রাজ্যে ‘নজরবন্দি’ রাখা হচ্ছে, এমন ঘটনা অতিতে সংঘটিত হলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন মহাজোটের মহাক্ষমতা অপব্যবহারে রাজনৈতিক বিরোধীদের যেভাবে হাজত বাস থেকে শুরু করে গুম খুনের ভয়-ভিতিতে রাখা হচ্ছে, এ দেশে বিশেষ করে স্বাধীনতার তিন দশকে এমন বাক স্বাধীনতা হননের ঘটনা অল্প-স্বল্প ঘটলেও যুৎসই প্রমাণ মিলে না। কিন্তু তখন সংবাদমাধ্যমের এতো প্রসার ছিল না, ফলে রাজনীতির কুমিরডাঙা জনসমক্ষে এতটা প্রকট হয়নি। অথচ, এসব উৎকট দৃশ্যাবলি দেখেও নাগরিকরা বিশেষ চিন্তিত বলে মনে করবার কোনো কারণ নেই। তাঁরা ধরে নিয়েছেন এমনটাই বুঝি বাংলার গণতন্ত্র। এমন বুঝে নেওয়ার গভীর উদ্বেগের কারণ। সমাজ যখন অনাচারকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়, তখন অনাচার দূর করবার আর কোনো তাগিদ অবশিষ্ট থাকে না বলে অন্তত আমরা বিশ্বাস করতে পারি না।
বস্তুত, অনাচার তখন ক্রমে নতুনতর মাত্রা পরিগ্রহ করে। মঙ্গলবারের নির্বাচনে যেমন  অমঙ্গলের ছাপ দেখা গিয়েছে। তেমনই শনিবারের নির্বাচনেও অশনি সংকেত মিলেছে। নির্বাচন কমিশনের নিকট বিক্ষোব্ধ বিধায়করা যখন ভোট বাতিলের দাবি জানাইবার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন লীগস্তবকরা ওই দাবির প্রতিবাদে কমিশনে পাল্টা দরবার শুরু করে। আর নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন লীগবাদীদের দাবির সঙ্গে গলা মিলায়ে আওয়াজ তুলবে ‘নির্বাচন শতভাগ সুষ্টু হয়েছে’ এটাতো কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের চরিত্র হতে পারে না। যদিও দলীয় মার্কা নির্বাচন কমিশনের নিকট এমন নির্লজ্জ ‘ফতোয়া’ ব্যথিত ভালো কিছু আশা করাটাই বেমানানই বটে।
বাদপ্রতিবাদ গণতন্ত্রের স্বভাবধর্ম। সুতরাং নির্বাচন কমিশনে যে কেউ দাবি করতেই পারে। কিন্তু ওই প্রতিবাদ জানাতে মন্ত্রিসভার একটি বড় অংশের নির্বাচন কমিশনের সম্মুখে হাজির হবার কোনো স্বাভাবিক ব্যাখ্যা ছিল কী?
বলা যেতে পারে, বাস্তবিক পক্ষেই সংসদের ক্ষমতা কব্জা করার হীনমানসে আওয়ামী মন্ত্রীদের অপক্ষমতার যুদ্ধকালীন তৎপরতা একটি সংশয়ই সৃষ্টি করে তাঁরা কমিশনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়ে ছিলেন। শেষ অবধি কমিশন লীগবাদীদের আবেদন মঞ্জুর করেছে। কমিশনের ওই কালো সিদ্ধান্তের কল্যাণে ১৫৪ আসনে নির্বাচনের আগেই মহাজোট গংরা জয়ী হয়েছে। এ সবই ঘটনামাত্র। আওয়ামী লীগবাদীদের এ জয়ে তাঁদের দলের অন্ধকার ভবিষ্যৎ ঈষৎ উজ্জ্বলতর হবে বলেও ভরসা হয় না, কিন্তু ওইসবল নিতান্ত গৌণ প্রশ্ন।
দশম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ক্রমানয়ে আওয়ামী রংগে জেলা পরিষদ, সিটি, উপজেলা, পৌরসহ একেবারে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফল যাই হোক, যে বস্তুটি চরম অপমানিত হয়েছে, তার নাম সুস্থ্য স্বাভাবিক ‘গণতন্ত্র’। আওয়ামী ক্ষমতার ক্যারিশমার অভিযান দেখে সংবিধান প্রণেতারা উদ্বেগ বোধ করতে পারেন, তবে কী গণতন্ত্রের বাংলাদেশ ছেড়ে যাবার সময় হল?
টেনিদা চরিত্র : টেনিদা সম্পর্কে একটুকু জেনে রাখা দরকারবোধ করছি। উইকিপিডিয়া মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে জানা যায়, টেনিদা মূলত উত্তর কলকাতার পটলডাঙায় বসবাসরত একটি স্থানীয় চরিত্র। টেনিদার প্রকৃত নাম ভজহরি মুখার্জি। পটলডাঙার আশেপাশে বসবাসরত চার তরুণ ছেলেদের একটি দলের নেতা টেনিদা পড়াশুনায় তেমন ভালো ছিলেন না। সাত বারের চেষ্টাতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে ছিলেন তিনি। টেনিদা বিখ্যাত ছিলেন তার খাঁড়ার মতো নাকের জন্যে, গড়ের মাঠে গোরা পেটানোর জন্যে। আর তার বিখ্যাত সংলাপ, ‘ডি-লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক’। টেনিদা সম্বন্ধে ভারতীয় গল্পলেখক প্যালারাম লিখেছেন, ‘টেনিদাকে নইলে আমাদের যে একটি দিনও চলে না। যেমন চওড়া বুক- তেমনি চওড়া মন।’
পাড়ার কারও বিপদ-আপদ হলে টেনিদাই গিয়ে দাঁড়িয়েছে সবার আগে। লোকের উপকারে এক মুহুর্তের জন্য তার ক্লান্তি নেই, মুখে হাসি তার লেগেই আছে। ফুটবলের মাঠে সেরা খেলোয়াড়, ক্রিকেটের ক্যাপ্টেন। আর গল্পের রাজা। এমন করে গল্প বলতে কেউ জানে না।
টেনিদা গল্প মূলত দুই ধরণের। যেমন- (১) টেনিদা তাঁর তথাকথিত বীরত্বের বানানো গল্প বর্ণনা করেন। (২) টেনিদা ও প্যালা বা চার তরুণ দলের অত্যধিক উল্লসিত অ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণীয় এবং শেষে রহস্যময় পরিস্থিতি মাধ্যমে সমাধানের গল্প বর্ণনা। এ ছাটগল্প ব্যাপকভাবে কলকাতার উপর ভিত্তি করে রচিত।
সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় টেনিদাকে বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও ছোট গল্প এবং একটি নাটকে উপস্থাপিত করেছেন। টেনিদাকে নিয়ে ‘চার মূর্তি’ নামে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম উপন্যাস লেখেন যা ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির’ থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। পরের উপন্যাস ‘চার মূর্তির অভিযান’ ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে টেনিদার আসল নাম যে ভজহরি মুখার্জি তা জানা যায়। এছাড়া তাঁর বিখ্যাত স্লোগান ‘ডি-লা-গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক্ ইয়াক্’ এ উপন্যাসেই প্রথম শুনা যায়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় টেনিদাকে নিয়ে যে সমস্ত উপন্যাস লিখেছেন। সেগুলো হল-১. চার মূর্তি, ২. চার মূর্তির অভিযান, ৩. কম্বল নিরুদ্দেশ, ৪. টেনিদা আর সিন্ধুঘোটক, ৫. ঝাউ-বাংলোর রহস্য। এছাড়াও নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী আশা দেবি কলম ধরে ছিলেন টেনিদা পাঠকদের অনুরোধে। তাঁর হাত দিয়ে ‘টেনিদার অজলাভ’ উপন্যাস ও কয়েকটি ছোটগল্পও বের হয়েছে। পটলা, মুসুরী ইত্যাদি চরিত্র সঙ্গ দিয়েছে  টেনিদাকে।
উপসংহার : আজকের নিবন্ধে দুই দুই বার ভারতীয় চরিত্র টেনিদাকে এ জন্যই উপস্থাপন করা হলো যে, টেনিদা চরিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিকদের চরিত্র হুবহুব মিলন ঘটেছে। যেমন আমাদের বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদের এমন অনেক আইনপ্রণেতা আছেন, দশম সংসদের আগে জনপ্রতিনিধির পরীক্ষায় আজীবন জামানত বাজেয়াপ্তের শিকার হয়েছেন। বিজয়ের যাত্রাই যদিও টেনিদা সাতবারের মাথায় মাধ্যমিক পাশ করতে সক্ষম হন। খাঁড়ার মতো নাক ও গড়ের মাঠে গোরা পেটানোর জন্যে টেনিদা যেমন বিখ্যাত ছিলেন। তেমনই দশম সংসদের এমন অনেক আইনপ্রণেতারাই নিত্যদিন রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর বিষ্ফোরক মন্তব্য ছুঁড়ে গণমাধ্যমে নিজেকে বিখ্যাত বানাতে মিছামিছি মাতামাতিতে ব্যধিব্যস্ত। সেই সঙ্গে বিরোধীদের পেটাতেও কয়েক দাফ এগিয়ে। টেনিদার বিখ্যাত সংলাপ, ‘ডি-লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক’। আর দশম সংসদের আইনপ্রণেতাদের জিগির গুলোর মধ্যে অন্যতম জিগির হলো- ‘আমার ভোট আমি দেবো, তোমার ভোটও আমি দেবো।’
পরিশেষে বলা যায়, স্বরণকালের তথাকতিথ বিনা নির্বাচনে ও নির্বাচনের নামে ক্ষমতার ক্যারিশমায় বাংলার দশম সংসদের বিজয়ের রেকর্ড ভঙ্গকারী আওয়ামী রাজনীতিতে টেনিদার চরিত্র মিশে একাকার হয়েছে। যা একান্তই একটি স্বাধীন দেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ।
লেখক দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক
[email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ