শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

কোরআনের উপমায় অলঙ্কার ও জীবন বোধ

মনসুর আহমদ : সাহিত্যের মাধ্যমে সুন্দরের প্রকাশ ঘটে, সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সাহিত্যের জন্য বিষয়বস্তু যেমন গুরুত্বপূর্ণ, প্রকাশ ভঙ্গিও তার জন্য কম গুরুত্বের নয়। বলা চলে সাহিত্য যেন একটি মানুষ। বিষয়টি তার ভঙ্গি ও জীবন। যার কোন ভঙ্গি নেই, তার জীবনও নেই। তার পোশাক, হাটা চলা, হাসি কান্না তার প্রতি আমাদের আকর্ষণ সৃষ্টি করে অথবা ঘৃণার উদ্রেক করে। পোশাক যথা স্থানে হওয়া চাই, যথাযথ হওয়া চাই; নইলে বিপত্তি ঘটে। শাখা মৃগের দেহে যদি মার্জিত পোশাক পরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়, তা হল পোশাকের অপমান হয়। 
তাই যে বিষয় নিয়ে সাহিত্য আলোচনা করে তার উপযোগী পোশাক দেহে ধারণ করেই সাহিত্য পথচলে গুরুগম্ভীর পদভারে অথবা চটুল নৃত্যের ছন্দে। উপযুক্ত পোশাক পরানোর দায়িত্ব সাহিত্যিকের। সাহিত্যিকই সাহিত্যে সৃষ্টি করবে  বর্ণনার নৃত্য ছন্দ, গগনের উদারতা, বারিধির গভীরতা, হিমাদ্রির দৃঢ়তা ও গভীর যামিনীর নীরবতা। সাহিত্যের অমৃতভাব ও চিন্তাকে পাঠকের সামনে মূর্ত করার জন্য  সাহিত্যিক চয়ন করেন প্রচুর উপমা । তবে যারা উপমাকে অযথা অবস্থানে সাহিত্যে টেনে আনেন তারা সার্থক রচনাকার নন।  যদি উপমা প্রকাশ ভঙ্গির সহজ ধর্মরূপে রচনায় স্থান পায় তখনই উপমা ও রচনা উভয়ই সার্থক হয় সুন্দর হয়। উপমা রচনার অর্থবোধকে সুস্পষ্ট করে তোলে, অর্থকে গভীর থেকে গভীরতর করে তোলে । তাই বলা চলে উপমা সাহিত্যের অলঙ্কার ও জীবন। 
কবি সাহিত্যিকগণ যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন উপমা টেনে এনেছেন তাঁদের কাব্যে, সাহিত্যে ও রচনায়। লেখকের রুচিবোধ ও বিষয়বস্তুর বিভিন্নতায় উপমা ও উপমানের প্রয়োগ বিভিন্ন হয়ে থাকে।  এক ধরনের উপমায় থাকে শুধু অলঙ্কার, আবার কোন কোন উপমায় থাকে শুধু জীবন বোধ।  কোন কোন  উপমায় অলঙ্কার ও জীবন বোধ ঊভয়ই বয়ে বেড়ায়। কল্পনা আশ্রয়ী  উপমা শুধু অলঙ্কার ও মধুর রস সঞ্চার করে থাকে। যেমন-
“কাজল ছিলগো জল ছিল না ও উজল আঁখির তীরে।
সেদিনো চলিতে ছলনা বাজেনি ও চরণ-মঞ্জীরে।” (ভীরু- নজরুল ইসলাম।)    অথবা
“ধান ভানে বৌ, দু’লে দু’লে ওঠে রূপ তরঙ্গে বান
বধূর পায়ের পরশ পেয়েছে কাঠের ঢেঁকিও প্রাণ।” (অগ্রাণের সওগাত- নজরুল ইসলাম)
এই যে ‘আঁখির তীর’ , ‘চরণ মঞ্জীর’ও ‘রূপ তরঙ্গ’এ গুলোর মাঝে অলঙ্কার ও সাহিত্যরস প্রচুর।  টেনিসনের ‘I will drink life to the lees’ এতে জীবনের শেষ বিন্দু  প্রাণের কথা বলা হয়েছে, এগুলোতে রূপক ও অলঙ্কার ধর্মী মূল্য প্রচুর।
আবার কোন কোন উপমায় শুধুমাত্র জীবনবোধ আছে কিন্তু অলঙ্কার বা ছন্দরসের কোন উপস্থিতি নেই। যেমন গীতার একটি উপমা-
“যদা সংহরতে চায়ং কুর্মোহঙ্গানীব সর্বশ:
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থে ভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা” (সাংখ্য যোগ- শ্লোক নং- ৫৮)
“কচ্ছপ যেমন কর-চরণাদি অঙ্গ সকল সংকুচিত করে রাখে, তেমনি যিনি রূপরসাদি ইন্দ্রিয়ের বিষয় হইতে ইন্দ্রিয় সকল সংহরণ করিয়া লন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।”
এই উপমাতে শুধুমাত্র জীবনবোধের ইঙ্গিত ইন্দ্রিয় সংযমই কর্তব্য ধ্বংস বিশেষ নয় ফুটে উঠেছে, কিন্তু কোন অলংকার নেই। 
তবে উত্তম উপমা তো তাই যাতে একাধারে ছন্দ, অলঙ্কার ও জীবনবোধ বর্তমান। এ ধরনের উপমাই উচ্চতর কাব্য-সাহিত্য সৃষ্টিতে সহায়তা করে, সাহিত্যে প্রাণরস সঞ্চার করে। এ ধরনের একটি উপমা- “আলামতারা জারাবাল্লাহু মাছালান কালিমাতান তাইয়েবাতান কাশাজারাতিন তাইয়েবাতিন আছলুহা ছাবেতুন ওয়া ফারউহা ফিস সামায়ে।”- তুমি কি লক্ষ্য কর না আল্লাহ তায়ালা কেমন উপমা বর্ণনা করেছেন : পবিত্র বাক্য হল পবিত্র বৃক্ষের মত। তার শিকড় মজবুত (মাটির গভীরে) এবং শাখা প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত। -(সুরা ইবরাহিম-আয়াত নং ২৪)
ছন্দ ও অলঙ্কারের  দিক দিয়ে  এ উপমাটি যেমন উঁচু স্তরের, তেমনি জীবনবোধের দিক দিয়েও অদৃষ্টপূর্ব। বিপদের কোন ঝড়ঝঞ্ঝা মুমিনকে টলাতে পারে না । ঈমান তার অন্তরের গভীরতম স্থানে শিকড় গেড়ে বসে, আবার তার গতি ঊর্ধ্বমুখী। আকাশকে সে ঘিরে রাখতে চায়। এমন উপমা মানব রচিত সাহিত্যে বিরল। ঈমানের রয়েছে স্রষ্টার হাসিতে হাসি মিলানোর বাসনা। ভূমার প্রেম মানবের কামনার বিষয়। এ কামনার গতি ঊর্ধ্বমুখী। রবীন্দ্রনাথ পবিত্র বৃক্ষের কাছা কাছি একটি উপমা প্রদানের চেষ্টা করেছেন তাঁর কাব্যে। যেমন-
‘শিখর গগন লীন দুর্গম জনহীন
বাসনা বিহগ একলা সেথায় - ধাইতেছে নিশিদিন।’
ঝঞ্ঝার বিরুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষমতা বিহগের নেই, কিন্তু বিটপীর সেই ক্ষমতা  আছে বিধায় বিটপীর উপমা শ্রেষ্ঠতর।  
জীবন রসিক সাহিত্য সাধকগণ উপমা খুঁজে পান সীমানাহীন প্রকৃতির মাঝে।
তাঁদের ভাবনা জগতের সীমানা ছাড়িয়ে ছুটে চলে যেতে চায় অনেক ঊর্ধ্বে। কিন্তু তারা তা  ধরে রাখে মানুষের বোধগম্যতার সীমানায়। তাই দেখা যায় একই উপমার মাঝে নানা জন নানা ভাবে তাদের রহস্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনার সুর। ইংরেজ কবি ব্রাউনিং মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিরহের শাশ্বত সুর শুনতে পেয়েছেন বাঁশীর কান্নার সুরে।  যে বাঁশের ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে বাঁশী তৈরী করা হল সেই ঝাড়েই সে কেঁদে কেঁদে ফিরে যেতে চায়। ব্রাউনিং বলেছেন, বাঁশী কাঁদে ফিরতে না পারার বেদনায়। আত্মার সাথে এই যে বাঁশীর তুলনা, এই তুলনাই করেছেন কবি ব্রাউনিং-এর বেশ আগে মওলানা রূমী।  তিনি বলেছেন- 
‘বিশনু আজ নায় চু হেকায়েত মি কুনাম,
আজ জুদায়া হা শেকায়েত মি কুনাম।’
বাঁশরী কাঁদিয়া বলে যায় শোন  পাতিয়া মনের কান,
করুণ সুরেতে সারাটি জীবন বিরহ ব্যথার গান।
বাঙ্গালী কবি রবীন্দ্রনাথ বাঁশীর সুর শুনতে পেয়েছেন বজ্রের গুরুগম্ভীর নাদে । সেই সুরে কবি জেগে উঠবেন, পাবেন বিশ্ব নিয়ন্তার প্রশংসা গীতি ঐ বাঁশীর সুরে। কবি লিখেছেন - বজ্রে তোমার বাজে বাঁশী
সে কি সহজ গান।
সেই সুরেতে জাগা থাকি
দাও মোরে সেই কান। (গীতাঞ্জলী)
কবির কন্ঠে শুনতে পাই কোরআনের সুর। কোরআনে বলা হয়েছে: “ইউ সাব্বেহুর রায়দু বি হামদিহী” -তার প্রশংসা পাঠ করে বজ্র। (রায়াদ) 
এভাবে বাঁশীর সুর যখন শুনতে পান বিভিন্ন কবির বিরহ ও তাসবিহ’র সুরে  সে সময় নজরুল খুঁজে পান বাঁশীর সুরে মানব মনের অপূর্ব ভাবের সুর মুর্চ্ছনা জাগ্রতকারী  এক মোহিনী শক্তি। তিনি লিখলেন :-
‘কে বিদেশী মন উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে
সুর সোহাগে তন্দ্রা লাগে কুসুম বাগে গুল বদনে।’
এ ভাবে দেখা যায় কেউ শুনতে পান বাঁশীর সুরে সুরে আত্মার ক্রন্দন ধ্বণি, আবার কেউ শুনতে পান ভূমার প্রশংসা গীতি। কাব্যে এ উপমা মানুষের মনে চিরকাল এ ভাবে ভাবের হিল্লোল উদ্বেলিত করতে থাকবে অবিশ্রান্ত ভাবে। 
এই ভাবে জীবনের উপমা খুঁজে পেয়েছেন মওলানা রমিী, রামকৃষ্ণ পরম হংসদেব জলে ভাসমান তরণীর মাঝে। জলের উপরে তরী ভাসে কিন্তু তরীতে জল প্রবেশ করলে আর তা ভেসে থাকতে পারে না। বাঁচার জন্য পৃথিবীর উপাদান প্রয়োজন ,কিন্ত জীবনের মাঝে যখন এই বাঁচার উপাদান গুলিই স্থান পায় তখন জীবন ধ্বংস হয়। একই কথা দুই জীবন রসিক বলেছেন  দুই দেশে থেকে দুই কালে। মওলানা রূমী তার অমর কাব্য মসনবীতে বলেছেন :
আব দর ঝিরে কিশতি পশতি আস্ত,
আব আন্দর কিশতি হালাক কিশতি আস্ত।
-তরণীর তলে জলধারা চলে তাই তরী ভেসে চলে,
তরী তল ফেটে যবে জল ওঠে তখন সে ডোবে জলে।
এই একই কথা বলেছেন রামকৃষ্ণ- তুমি সংসারে থাক তাহাতে দোষ নাই, সংসার তোমাতে না থাকিলেই হয়। জলের উপর নৌকা থাকিতে পারে, কিন্তু নৌকায় জল উঠিলেই ডুবিয়া যায়।
যারা মানব জীবনের রহস্য খুঁজে বেড়িয়েছেন তারাই জীবনের সুর ও কর্মময়তার উপমা খুঁজে পেয়েছেন বাঁশী ও তরীর মাঝে। জীবন সাধনা ও সাহিত্য সাধনা যেখানে এক দেহ ধারণ করে সে সব স্থানেই এসব উপমা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
মৃত্যুর উপমাও বেশ গভীর জীবনের মত। মৃত্যুর অনুভূতি বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন সময় আলাদা  ভাবে ধরা দিয়েছে। কেউ জীবন ও মৃত্যুর মাঝে কোন তফাৎ খুঁজে পাননি। তাই তারা মৃত্যুকে আহ্বান করতে ভয় পাননি। তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথের কাছে তাই মৃত্যু শ্যামের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তিনি বলেছেন :-
‘মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান।’
কিন্তু জীবনবাদের পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে শ্যাম আর মৃত্যুর প্রতীক থাকেনি। তা রূপ ধারণ করেছে শুভ্রকান্তি মহাদেবের। কবি লিখলেন :-
যবে বিবাহে চলিলা বিলোচন,
ওগো মরণ হে মোর মরণ,
তাঁর কতো মতো ছিল আয়োজন,
ছিল কত শত উপকরণ।’
রবীন্দ্রনাথ যখন মরণকে একবার শ্যাম, একবার বিলোচন ভেবেছেন তখন নজরুল মরণকে মরণ হিসেবেই ভীতুজাতির জন্য আহ্বান করেছেন। কবি বিপ্লবী সৈনিক হিসেবেই মরণের মাঝে একটি জাতির জীবন খুঁজে পেয়েছেন। তিনি লিখেছেন- ‘এস এস ওগো মরণ
এই মরণভীত মানুষের ভয়    করগো হরণ।’
মরণইযে মানুষকে অনন্ত জীবনের পথ দেখায় এ কথাটাই জন ডান তঁর ‘ডেথ’ কবিতায় বলেছেন। জন ডান ও নজরুলের এখানে মিল ঘটেছে। জন ডান লিখেছেন :-
One short sleep past, we make eternally,
And death shall be no more; Deat thou shalt die.
কিন্তু ওমর খইয়াম মৃত্যুকে নিষ্ঠুর ও চূড়ান্ত ভেবেছেন। তিনি লিখেছেন :-
‘না গাহে মনাদী বর আইয়াদ যে কমীন
কায় বেখবরীঁ, রাহনা আনাস্ত ও নাইঁ।’
কেহ বা ব্যাকুল আজিকার লয়ে, কারো লক্ষ্য দূর ঐ পরপার,
নিষ্ঠুর মরণ কাহিছে ফুকারি’- কোথাও কিছু নাহিক আর।
মরণকে চির অবলুপ্তি মনে না করাতেই মানবের মঙ্গল নিহিত। মরণ নিদ্রার ভাই। নিদ্রার পর মানুষ অবার জেগে ওঠে। মরণের পরেও মানুষ পুনরায় জেগে ঊঠবে, মেতে থাকবে জান্নাতি সুখে, নয়ত ভুগতে থাকবে জাহান্নামের আজাবে। তাই মৃত্যুর সুন্দর উপমা নিদ্রা বা নিদ্রার উপযুক্ত উপমা মৃত্যু। ইংরেজী সাহিত্যে valentinian নাটকে নিদ্রাকে তুলনা করা হয়েছে মৃত্যুর ভাই হিসেবে। বলা হয়েছে :-
Care- charming sleep, thou easer of all woes
Brother to death, sweetly thou self dispose On this aflicated prince .. .
মরমী কবি জন ডানও মৃত্যুকে ভয়ের মনে করেননি। তিনি মৃত্যুকে নিদ্রার ভাই মনে করেন  বলেই লিখেছেন :-
Death, be not proud, though some have called thee
Mighty and and dreadful , for thou art not so;
From rest and sleep, which but thy  picture be.
একই ভাবে কবি নজরুল ইসলাম মৃত্যুকে নিদ্রার সাথে তুলনা করে তার গানে লিখেছেন :-
ঘুমিয়ে গেছে ক্লান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি,
করুণ চোখে তাকিয়ে আছে সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি।
আবার কোথাও নীরব নিস্তব্ধতাকে জীবনের পূর্ণতা প্রাপ্তিকে ঘুম বলেছেন তাঁর গানে। যেমন :-
বাগিচার বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে
দিসনে আজি দোল,
আজো হায় ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি
তন্দ্রাতে বিভোর।
এইযে ঘুম আর মরণের উপমা শুধু কবিদের কাব্যেই নয়, নবীদের বাণীতেও  এ উপমা বিদ্যমান। পবিত্র কোরআনে নিদ্রাকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে-“ওয়া হুয়াল্লাজি ইয়া তাওফ্ফাকুম বিল লাইলে ওয়া ইয়া’লামু মা জারাহ্তুম বিন নাহার।” (আনয়াম)-তিনি রাতের বেলা তোমাদেরকে মৃত্যু দেন এবং যা কিছু তোমরা দিনের বেলায় কর তা তিনি জানেন। এখানে নিদ্রাকে আল্লাহ মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন।
এ তুলনা করেছেন আল্লাহর প্রিয় হাবিব (স:)। তিরি রাতের বেলা নিদ্রা যাওয়ার প্রাক্কালে আল্লাহর প্রশংসায় পড়তেন-‘আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আহ্ ইয়ানা বায়্দা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর।’-সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি মরণের পর অমাদেরকে জীবিত করেছেন এবং তাঁর নিকটেই ফিরে যেতে হবে।
আল্লাহ ও রসুলের বাণীতে যে উপমা ছড়িয়ে আছে সে সব উপমা বিভিন্ন কাব্যে, সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়ে সাহিত্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে, করেছে সাহিত্যে জীবনবোধ ও মূল্যবোধের সৃষ্টি। উদাহরণ তুলে ধরে লেখার কলেবর না বাড়িয়ে নমুনা হিসেবে কিছু তুলে ধরা হল বোদ্ধা পাঠককুলের সামনে।
কোরআন পাকে আল্লাহ তাঁর রসুলকে পাহাড়ের সাথে তুলনা করেছেন। পাহাড় ঝড় ঝঞ্ঝায় উপড়ে পড়ে না , রসূলও বিপদে ভেঙ্গে পড়েন না। কোরআনে বলা হয়েছে- “ওয়া ইন কানা মাকরুহুম লি তাঝুলা মিনহুল জিবাল।”- তাদের কৌশল পাহাড় টলিয়ে দেবার মত হবে না। (ইবরাহীম-৪৬)
গুলিস্তাঁ কাব্যে সেখ সাদী পাহাড়ের ন্যায় দৃঢ়তাকেই সম্মানের চূড়ান্তে পৌঁছার উপায় মনে করে লিখেছেন :-
আগার পায়ে দর দামান আরি চু কোহ্,
ছারাত যে আসমান বগুজারাদ দরশে কোহ।
তুমি যদি পাহাড়ের ন্যায় তোমার পা অটল রাখতে পার তবে তোমার সম্মান আসমানের ঊর্ধ্বে পৌঁছবে।
ভ্রুকুটি পাহাড়কে টলাতে অক্ষম।  রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাজপুতনা’ কবিতায় পাহাড়ের উপমা দিয়েছেন এ ভাবে- ‘ঐ তার গিরিদূর্গে অবরুদ্ধ নিরর্থ ভ্রুকুটি।’  আবার কবি ইকবাল পর্বতকে তাঁর কবিতায় অনন্ত যৌবনের উপমা হিসেবে টেনে এনেছেন। যে যৌবনের প্রচ-তা বয়স বা দিবা রাত্রির আবর্তনে হ্রাস পায় না। তিনি লিখেছেন :-
তুজ মে কুচ পয়দা নেহি দেরীনাহ্ রোযী নিশাঁ
তু জোঁয়া হে পরদিলে সাম ও সেহের কি দরমিয়াঁ।
কাল একে দেয় নাই তব বয়সের জ্বরা,
দিবা রাত্রি চক্রাবর্তে আজো তুমি যৌবন শিহরা।
এই যে পাহাড়ের উপমা বিভিন্ন জনে টানল বিভিন্ন ভাবে, কিন্তু সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নবীর সাথে পাহাড়ের উপমা। এ উপমাটিতে যেমন রয়েছে শব্দের ঝংকার, তেমনি রয়েছে ভাবের গভীরতা। সব দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠতম উপমা কোরআনের উপমা। কোরআনের উপমা মানুষকে সত্যের সন্ধান দেয়, হৃদয়ের চোখ খুলে দেয়; অন্তরে চমকাতে থাকে নূরের রোশনাই। কোরআনে মানুষের অন্তরকে তুলনা করা হয়েছে ভূমির সাথে। বলা হয়েছে, “আল বালাদুদ তাইয়েবু ইয়াখরুজু নাবাতাহু বি ইজনি রব্বিহী, আল্লিাজী খাবুছা লা ইয়াখরুজু ইল্লা নাকিদা”-ভাল জমি আল্লাহর অনুমতিক্রমে উত্তম ফসল উৎপন্ন করে। পক্ষান্তরে খারাপ জমিতে সামান্যই ফসল জন্মে। (আরাফ-৫৮)।
কোরআনের একটি তুলনা বিহীন উপমা অপরিচ্ছন্ন অন্তরের সাথে মসৃণ পাথর। অন্তরের গভীরে যদি ভালবাসার রস না থাকে তবে সে সে অন্তর মহৎ কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজের দান-খয়রাত বরবাদ কর  না, সে ব্যক্তির মত যে নিজের ধন সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে  ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস  রাখে না, অতএব এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মত যার উপরে কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর উপরে বৃষ্টি বর্ষিত হল, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিস্কার করে দিল।”(বাকারা -২৬৪) 
কোরআনে ইমান বিহীন হৃদয়ের উপমা মসৃণ পাথর। কবি একটু পরিবর্তন করে রসহীন হৃদয়ের উপমা টেনেছেন জড়পিন্ডের সাথে। “মানুষের মধ্যেও যখন রসের আবির্ভাব না থাকে, তখনই সে জড়পিণ্ড। তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভয় ভাবনাই তাকে ঠেলে ঠেলে কাজ করায়, সে কাজে পদে পদে ভার ও ক্লান্তি। (রবীন্দ্র রচনাবলী-পঞ্চম খণ্ড)  
কোরআনের সৌন্দর্য ভরা উপমা আমাদেরকে চির সুন্দরের কাছে টেনে নিয়ে যায়। সকাল সন্ধ্যায় জীবজন্তুর বিচরণ শুধু মাত্র বিচরণ নয়। এ গুলি স্মরণ করিয়ে দেয় প্রভুর নিদর্শন-বোদ্ধাদেরকে প্রতিপালকের দিকে ফিরে যাবার কথা। বলা হয়েছে- “ওয়া ফীহা জামালুন হিনা তুরিহিনা ওয়া হিনা তাসরাহুন।” -আর তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের সৌন্দর্য যখন প্রভাতে সেগুলি নিয়ে চল বিচরণের জন্য আবার গোধূলি বেলায় নিয়ে আস ফিরায়ে। নিঝুম সন্ধ্যায় ফাগ রাগ রঞ্জিত গগনকোলে পাখির কুলায় প্রত্যাবর্তন, পশুর ধীর শান্ত বিচরণে যে অনন্ত সৌন্দর্য রয়েছে তা দেখতে পারে যাদের আছে অন্তর্চক্ষু যা থাকে সদা উন্মিলিত। এ আয়াত পড়ার সথে সাথে মনে পড়ে Charles Kingsley এর।
O Marry, go and call the catle home,
And call the catle home
কবি কত সুন্দর ছবি এঁকেছেন পশুর ঘরে ফেরা নিয়ে। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার দৃশ্য কবি মনে দোলা দেয়। কবি গেয়ে ওঠেন-
ওরা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যায় কূলের কূলায় বাসী,
আঁচল ভরিয়া কুড়ায়ে আমার কাঁদায়- ছিটানো হাঁসি। (পথচারী নজরুল ইসলাম)
কোরঅনের উপমায় সাহিত্য রস ও সত্যের সন্ধান রয়েছে এক দেহে মিশে। একটি বিভ্রান্ত ও পথ হারা জাতির পরিণতির উপমা দিতে গিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে- ‘তাদের জন্য ক্রন্দন করেনি আকাশ ও পৃথিবী এবং তারা অবকাশও পায়নি।’ (দোখান)
আকাশ ও পৃথিবীর কান্না দেখতে হলে যে চোখের প্রয়োজন তা কি মানুষের আছে? নেই, কিন্তু তা মানুষ অনুভব করতে পারে হৃদয় দিয়ে। আকাশ ও পৃথিবীর ক্রন্দনের উপমায় যেমনি রয়েছে ভাবের অতুলনীয় গভীরতা, তেমনি রয়েছে সুচারু শিল্পরূপ। আকাশ ও পৃথিবীর ক্রন্দন শুধু ক্রন্দনই নয় ,এ ক্রন্দন বলে দেয় বিশ্বচরাচরে অবাধ্যদের জন্য বয়ে চলা সদা দুঃখের ও হতাশার হুতাশন মিশ্রিত নিশ্বাস। নজরুল তাঁর লেখায় আকাশ- বাতাস ও ধরণীর ক্রন্দন ধ্বনি বাজিয়েছেন এভাবে-
‘খুঁজে ফিরি কোথা হ’তে এই ব্যথা -ভরাতুর মদ গন্ধ আসে -
আকাশ বাতাস ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে মোর ঘন দীর্ঘশ্বাসে।
কেঁদে ওঠে লতা পাতা             ফুল পাখি নদী-জল
মেঘ বায়ু কাঁদে সবি অবিরল,
কাঁদে বুকে উগ্র সুখে যৌবন- জ্বালায় জাগা অতৃপ্ত বিধাতা। (পূজারিণী- নজরুল ইসলাম)
মানুষের বুকে অতৃপ্ত বাসনা কেঁদে বেড়ায় তার পরম প্রিয়ার সন্ধানে। এ কান্না যুগযুগান্তরে পরম প্রিয়তম মানুষকে বলে দিয়েছে অব্যক্ত বেদনার শেষ পরিণতি কোথায় মিলিছে। ইবরাহীম (আ:)-এর প্রশ্ন কে তাঁর প্রভু?  এর জবাব খুঁজে ফিরেছেন তিনি মহাকাশেরে দিকে চেয়ে চেয়ে। “অনন্তর যখন রজনীর অন্ধকার তাঁর উপর সমাচ্ছন্ন হল, তখন সে একটি তারকা দেখতে পেল। বলল, এই আমার প্রতিপালক। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হল, তখন বলল, আমি অস্তগামীদেরকে ভাল বাসি না। অতঃপর যখন চন্দ্রকে ঝলমল করতে দেখল, বলল, এটি আমার প্রতিপালক। অনন্তর যখন তা অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন বলল:  যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন, তবে অবশ্যই আমি বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। অতঃপর সূর্যকে যখন চক চক করতে দেখতে পেল, বলল, এটি আমার পালনকর্তা, এটি  বৃহত্তর। অতঃপর যখন তা ডুবে গেল, তখন বলল, হে আমার সম্প্রদায় - তোমরা যে সব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত।” (আনয়াম-৭৬-৭৮)
এইযে অনন্ত রহস্যের সন্ধানে রসুলের ব্যস্ততা ও প্রশ্ন এর জবাব তিনি খুঁজে পেলেন তাঁর জীবন প্রভাতেই বিশ্ব চরাচরে আঁখি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লান্ত হয়ে তাঁর অন্তর মাঝে। এ সুন্দর উপমাকেই গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন সায়াহ্নে মরণের বিছানায় শুয়ে শুয়ে।  তিনি লিখলেন :
“প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নতুন আবির্ভাবে
কে তুমি-
মেলেনি উত্তর ।   
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগর তীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,
কে তুমি-
পেল না উত্তর।”
কবির এ কবিতা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে অমীয় চক্রবর্তী বলেছেন,‘পৃথিবীর সাহিত্যে এর তুলনা সম্বন্ধে কিছু বলা বৃথা। ’
এ কবিতা প্রসঙ্গে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, “শান্তি ও সমাহিত উচ্চারণে তিনি সূর্যের কথা বলেছেন যে সূর্যকে তিনি প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করেছিলেন প্রথম জীবনেও ও শেষ মুহূর্তেও ,যে সূর্য শুধু অস্তিত্বকে জ্ঞাত করে, কিন্তু কোন প্রশ্নের উত্তর দেয় না।”(কবিতায় অঙ্গীকার ও আশ্বাস)
সূর্য উত্তর দিতে পরে না কিন্তু জীবন রসিক বোদ্ধাজন সূর্যের অস্তিতের মাঝে  খুঁজে পান  অন্তকালের জীবন জিজ্ঞাসার জবাব। কোরআন ইঙ্গিত দেয় উন্মুক্ত  কিতাব মহা বিশ্ব থেকে সবক গ্রহণ করতে। যারা জ্ঞানী তারাই খোলা কিতাব থেকে জ্ঞান ও শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনকে সার্থক করেন।
মোনাফেকদের উপমা দেয়া  হয়েছে দেয়ালের ঠেকানো কাঠের স্তম্ভের সাথে। “তুমি যখন তাদের দিকে তাকাও তাদের দেহাকৃতি তোমার নিকট প্রীতিকর মনে হয় এবং উহারা যখন কথা বলে তখন তুমি আগ্রহ ভরে তাদের কথা শুনতে থাক যদিও তারা দেয়ালে ঠেকানো কাঠের স্তম্ভ অনুরূপ। যে কোন শোরগোল শুনলেই তারা মনে করে তা তাদেরই বিরুদ্ধে ।”(মুনাফিকুন)
অবার আল্লাহর আয়াত অস্বীকারকারীদের উপমা দেয়া হয়েছে পুস্তকবাহী গাধার সাথে। “যাদেরকে তওরাতের বিধান দেয়া হলে তারা তা অনুসরণ  করে নাই। তাদের দৃষ্টান্ত পুস্তক বহনকরী গাধা । কতই না নিকৃষ্ট সে সম্প্রদায়ের লোকজন যারা আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা মনে করে। (জুমুয়া)
যারা কোরআনের অনুসরণকে ভয় পায় তাদের তুলনা ভীত সন্ত্রস্ত গাধা। উপমাটি অলঙ্কার ও তাৎপর্য উভয় দিক দিয়েই চমৎকার। বল হয়েছে-
‘উহারা যেন ভীত ত্রস্ত গাথা, যারা সিংহের সম্মুখে পলায়নপর।”(জুমুয়া)
নবীর সাথে হঠকারী জাতির চরম পরিণতি সম্পর্কে যে উপমা দেয়া হয়েছে তা হৃদয়ে ভয় ও ঘৃণা সঞ্চার করে। বলা হয়েছে, “আমি তাদেরকে আঘাত হেনে ছিলাম এক মহানাদ দ্বারা, ফলে তারা হয়ে গেল ছাগল-ভেড়ার খোয়াড় প্রস্তুতকারী বিখণ্ডিত ,বিক্ষিপ্ত শুষ্ক শাখা পল্লবের ন্যায়।
আদ জাতির পরিণতির বিভীষিকাময় চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বিশ্ববাসীর সামনে অতি সুন্দর ভাষায়, সুন্দর উপমায়। তা ছাড়া আয়াতের  ছন্দে ছন্দে হৃদয় সামনে এগিয়ে যায়। কি সুন্দর শব্দাবলী -‘নাহসিমমুস্তাসির’, ‘নাখলিম মুনআকের!’ এ উপমায় বলা হয়েছে তাদের উপর আমি প্রেরণ করেছিলাম ঝঞ্ঝা বায়ু এক দুর্ভোগের দিনে। তা মানুষকে উৎখাত করেছিল উন্মূলিত খর্জুর কা-ের ন্যায়।” 
কোরআনের উপমায় যেমন রয়েছে অলঙ্কার তেমনি রয়েছে জীবন বোধের গভীরতা। কোরআনকে আলঙ্কারিক বিজ্ঞানের কোন শাখা থেকে আলাদা করা যায় না। এর আলঙ্কারিক উপমাগুলি সর্বদাই অরুচিকর স্পর্শ ও বিকৃত কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত থেকে এক  উন্নত সাহিত্যের আদর্শ হয়ে আছে বিশ্বজোড়া সাহিত্যের পরিম-লে। কোরআনের এ মূল্যবান রতœ রাজীর খোঁজ পেতে প্রয়োজন কোরআনের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও ভক্তি ভালবাসা পূর্ণ হৃদয়ের। যদি আধুনিক সাহিত্যসেবীগণ এ সব রতœরাজী দিয়ে সাহিত্য রচনা করেন তবে পাহলভী ভাষার কোরআন ‘মসনবীর’ মত অমর কাব্য-সাহিত্য রচনা করা এ যুগেও নিশ্চয় সম্ভব।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ