শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪
Online Edition

সততা যেখানে লাঞ্ছিত অসহায়

সামাজিক অবক্ষয় ইংরেজি Social Erosion or Social Destruction. আরবিতে অবক্ষয় কে খুসরুন বলে, যার অর্থ ক্ষতি হওয়া, অর্থাৎ মুলধন বা পুঁজি কমে যাওয়া এবং লোকসান হওয়া। আবার কখনও লোকসান বা ক্ষতির সম্বন্ধ মানুষের দিকেও করা হয়, যেমন বলা হয়, অমুকের ক্ষতি হয়ে গেছে। কখনও কাজের দিকেও করা হয়। যেমন বলা হয়, তার ব্যবসা কমে গেছে। কখনও প্রচলিত জিনিসের দিকে করা হয়। যেমন, দুনিয়ার মাল ও সম্মান। আবার কখনও মূল্যবান ও অনেক সম্মানী নেয়ামতের দিকেও করা হয়। যেমন, সুস্থা, বৃদ্ধি, জ্ঞান, ঈমান, পুণ্য ইত্যাদি। অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’ অর্থাৎ জীবনকে সুন্দর এবং কল্যাণের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে মানব জীবনে যে সমস্ত গুণ থাকা প্রয়োজন, তা যখন লোপ পায় বা নষ্ট হয়ে যায় তখনই জীবনে অবক্ষয় আসে। সমাজের মানুষ অবক্ষয়ের শিকার হয় বিভিন্নভাবে যেমন, ‘নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়’। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের জীবনে অনুসরণযোগ্য এমন একটি আচরণ বিধি, যা মানুষের জীবন ব্যবস্থা ও জীবন পদ্ধতিকে করে তোলে সুন্দর , নির্মল ও রুচিস্নিগ্ধ। এর সঙ্গে জড়িয়ে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শ্রম, উত্তম চরিত্র, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, সর্বোপরি সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হওয়া ইত্যাদি বিশেষ কতকগুলো গুণ। নৈতিক মূল্যবোধ মানবচরিত্রকে করে তোলে সুষমাম-িত। তাই মানুষের আত্মিক, সামাজিক উৎকর্ষের জন্যে এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্যে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ লালন, চর্চা ও বিকাশের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই জন্যে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে মানবচিত্তে নৈতিক মূল্যবোধের উৎসারণ এবং তার মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজজীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে।
এ অবক্ষয় যুবসমাজকেও প্রভাবিত করছে, দোলা দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতাকে। আমাদের যুবসমাজের সামনে আজ কোনো আদর্শ নেই। নেই অনুপ্রাণিত করার মত কোনো মহৎ প্রাণ মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষত্বের দীনাতার চিত্র। বর্তমান ব্যবস্থায় বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার আশা করা যায় না। বড়রা শিক্ষা বলতে বোঝেন পরীক্ষা ও ডিগ্রি এবং জীবনে উন্নতি বলতে বোঝেন টাকা ও প্রতিপত্তি। ফলে শিক্ষার মধ্যে তরুন সমাজ খুঁজে পায় না মহত্তর কোনো জীবনবোধ। যুব সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতো কোনো পরিকল্পনা নেই। ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান। অর্থনৈতিক উন্নতিই শুধু উন্নয়ন নয়, সামাজিক অবক্ষয় রোধ এবং উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন মানুুষ গঠনও উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও সামাজিক অবক্ষয়ের আরেকটি অন্যতম কারণ। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ শিক্ষা জগতে নৈরাজ্য সমাজ সেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তরুন সমাজ অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করছে রাষ্ট্র সমাজ বিরোধীদের যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞানী, সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ। সততা সেখানে লাঞ্জিত অসহায়।
সামাজিক অবক্ষয়ের বীভৎস চিত্র যেমন পাওয়া যায় আরবের ইতিহাসের আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগ থেকে তেমনি অবস্থা আজ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের। অধিকাংশ মানুষই নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার। আমাদের দেশের গৌরবজনক মুক্তিযুদ্ধে হৃদয়ের অনুশীলন দেখেছি। মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল দুঃখে, ঘৃণায় ও প্রতিরোধে। তাদের অধিকাংশ ছিলেন মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী এবং যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁরা নিয়মিত নামাজ আদায়, কোরআন তিলাওয়াত ও রোজা রেখে বিজয়ের জন্য মহান আল্লাহর সাহায্য ভিক্ষা চেয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধে তথা কথিত বিষয়ের পর দেখা গেল বুদ্ধির তৎপরতা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেই বুদ্ধি ছিল স্বার্থের। স্বার্থ একাত্তোরেও ছিল, সবার স্বার্থ তখন এক ও অভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্য তখন একাটাই দেশকে শত্রুমুক্ত করা । কিন্তু শত্রু যেই পরাজিত হয়েছে এমনি সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ কর্তা হয়ে বসেছে; প্রত্যেকের স্বার্থ তখন ভিন্ন ভিন্ন, শুধু তাই নয় একের স্বার্থ অপরের জন্য ভয়ংকর প্রতিপক্ষ। শুরু হয়ে গেল আরেক যুদ্ধ একজনের বিরুদ্ধে আরেক জনের। ভূলুন্ঠিত হলো দেশপ্রেম। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ বা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে নয়, অধিকাংশ মুুক্তিযোদ্ধা নিজেদের ঈমান-আকিদা বিসর্জন দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি। যুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে, তাদের জ্বালাও- পোড়াও নীতি ও হত্যা-ধর্ষণের বিরুদ্ধে একটি শোষণমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবার পর তদানীন্তন শাসকবর্গ ভারত থেকে ধার করা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ এবং রাশিয়ার বস্তা পচা সমাজতন্ত্র সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৭১ থেকে ৭৫ পর্যন্ত জাতির ঘাড়ে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চাহিয়ে দিয়েছিলো। বর্তমানে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের ঘাড়ে চাহিয়ে দিয়েছে যা বাংলাদেশের সামাজিক অবক্ষয়ের একটি বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বস্তুবাদী ও ব্যক্তিস্বার্থে অন্ধ চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতাদর্শ এদেশে মুসলমান কোনো সময়ই মেনে নিবেনা, কারণ ওরা সামাজিক অবক্ষয়ই সৃষ্টি করবে। একবার নবী করীম (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “এমন এক সময় আসবে অন্ধকার রাতের মতো ফিত্না- ফাসাদ দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। একজন সাহাবী জানতে চাইলেন, হে আল্লাহ রাসূল (সাঃ) ! সে বিপদ থেকে বাঁচার উপায় কি? জবাবে নবী করীম (সাঃ) বললেন, “আল্লাহ্র কোরআনই বাঁচার একমাত্র পথ, এতে রয়েছে অতীত জাতিসমূহের ইতিহাস এবং ভবিষ্যৎ মানব গোষ্ঠীর ঘটনাবলীর ভবিষ্যদ্ববাণী এবং বর্তমানের প্রেক্ষিতে তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্কিয় আইন। বস্তুত কোরআন চূড়ান্ত বিধান, কোনো অবহেলার জিনিস নয়।” (তিরমিযী)
-আবু মুনীর

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ