রবিবার ২৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

আরাকানের ভাগ্য বিড়ম্বনা ও দোদুল্যমান মুসলিম নেতৃত্ব

মনছুরুল আলম মজুমদার : আরাকান বিশ্ব মানচিত্রে আঁচড় কাটা একটি মৃত্যুপুরীর নাম। যেখানে গড়ে উঠেছিলো সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শনসমূহ। তৈরি হয়েছিলো আরেকটি প্রেমময় নতুন সভ্যতার। যাদের মাধ্যমে প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়েছিলো বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে, এমনকি বিকশিত হয়েছিলো প্রতিটি জনপদে। আজ তারাই নিগৃহীত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত। তাদের জন্য আজ নেই প্রেম আর ভালোবাসা। কি অপরাধ তাদের?
তারা কি অন্য কোনো সভ্যতার ভিতের ওপর কোনো চূড়া গড়তে চেয়েছিলো?
নাকি তারা ওই জনপদের মানুষের ওপর পশুত্বের মতো ছোবল মারতে চেয়েছিলো?
আসল কথা এসবের কিছুই নয়। তাদের অপরাধ তারা মুসলিম...!
যে জাতি শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও মৌলিক অধিকারসহ সকল ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। এমনকি চিরায়ত ও জন্মগতভাবেই আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার-লিঙ্গাধিকার থেকেও বঞ্চিত প্রায়। বলা চলে এমন একটি জনপদের মানুষের ভাগ্য বিড়ম্বনা এর চাইতে আর কি হতে পারে ...?
দুঃখ প্রকাশের ভাষাই বা কি হতে পারে ভাগ্য বিড়ম্বিত এই মানুষগুলোর জন্য...?
৮শ শতক থেকে যারা বসবাস করছিলো এই আরাকানেই। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েও যারা আজ নিজেদের বাসস্থানের জায়গাটুকু নিয়ে স্বাভাবিকভাবে বসবাস করতে পারছে না সেখানে ইহুদী হওয়ায় বীরদর্পে ফিলিস্তিনী মাটির উপর নিজেদের শৌর্য-বীর্য আর পৈশাচিকতা নিয়ে দেদীপ্যমান এই নর-পশুরা। বিশ্ব ভূম-লের মানচিত্রে যেখানে কোনো আঁচড় দেখতে পাওয়া যায়নি তারাই আজ নিজ হাতে যেন রংতুলি দিয়ে এঁকে নিলো ইসরাঈল নামে একটি দেশের।
অনেক নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা সইতে হয়েছে দীর্ঘ প্রায় ১২০০ বছর আরাকানের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। এই দীর্ঘ সময়ে নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও মাটি গেড়ে নিজ মাতৃভূমিকে ধরে রাখতে/পরিচয় দিয়ে শান্তি পায় এই জনগোষ্ঠীরা। জাতিসংঘ ঘোষিত সভ্যতা বিনির্মাণের এক নম্বর হাতিয়ার শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত এ জাতি ধর্মীয় শিক্ষাকেই তাদের শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে চাওয়াও যেন তাদের অপরাধ। মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের কথা দেশে বিদেশে কত শুনেছি যা সত্যিই স্বার্থপর ও বাতুলতা মাত্র।
ইসলামী নেতৃত্ব ও মুসলিম অধ্যুষিত জনপদের নেতৃত্বের দোদুল্যতাও এর জন্য দায়ী কম নয়। সভ্যতা বিনির্মাণের কথা যদি বলতে হয় তবে আরব্য সভ্যতাকেই বর্তমান সভ্যতার সূতিকাগার বলতে পারি। আরবরা  এই উপমহাদেশে এসে অসভ্য মানুষকে সভ্য জাতি হিসেবে গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। শ্বাসত গ্রন্থ আল কোরআনের প্রথম নাযিলকৃত আয়াতে বলা হয়েছে- “পড়! তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন”
রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেছিলেন-
“তোমারা আমার একটি বাণীও যদি শুনে থাক তবে তা অন্যদের নিকট পৌঁছে দাও।” এই পৌঁছানোর দায়িত্ব মাথায় রেখে বিশ্ব ভ্রহ্মান্ডের আনাচে-কানাচে চড়িয়ে পড়েছিলো মুসলিম এবং ইসলামী নেতৃত্ব। ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বাণি, আলোকিত করেছিলেন প্রতিটি জনপদ। কিন্তু আফসোস এটি যে, সেই শ্বাসত গ্রন্থ আজ মসজিদে আর বাসার শো-কেসে কাপড় মোড়ানো। হয়ে পড়েছি আমরা ইসলামী সভ্যতা বিবর্জিত পুঁজিবাদি/বস্তুবাদী সভ্যতার ক্রিড়নকে।
আইয়্যামে জাহেলিয়াতকেও হার মানানো যে নিষ্ঠুরতা সেই মিয়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্মমতার বিরুদ্ধে আমরা দেখতে পাইনি মুসলিম নেতৃত্বের কার্যকরী পদক্ষেপ, না সৌদি আরব, না ওআইসি। কোথায় মুসলিম নেতৃত্বের   দৈণ্যতা বা ঐক্যবদ্ধতা। যেখানে কোরান বলছে-
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো, তোমরা কেন আল্লাহর রাস্তায় অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়াই করছ না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে? আর ফরিয়াদ করে বলছে, হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নাও এবং আমাদের জন্য প্রেরণ কর একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক।
৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও, বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে বরাবরের মতোই। অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ সহ্য করেও এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী একটি স্বাধীন/স্বায়ত্ত শাসিত দেশ/রাজ্যে বসবাসের প্রত্যাশায় আরাকানকেই মাতৃভূমি মনে করে।
মুসলিম শাসনামলে তথা ১৪৩০-১৪৩৪ শতকের দিকে বার্মিজ রাজা নারামেখলার মুসলিম সুলতানের সামরিক সহযোগিতায় পুনরায় শাসনভার ফিরে পাওয়ার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোহিঙ্গাদের বসবাসের পাশাপাশি রাখাইনে তথা আরাকানে মুদ্রা প্রথারও চালু করা হয়েছিল। ১৪৩৩ সালে সুলতান জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহের মৃত্যু হলে সম্রাট নারামেখলার উত্তরাধিকারীরা তা আর বজায় রাখেনি। শুরু হয় পুনরায় অত্যাচার ও নির্যাতন। রোহিঙ্গারা আলাদা জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বর্মায় বাস করেছে। এই জাতিসত্ত্বা তাদের লড়াই করে আসতে হয়েছে। বৃটিশরা অন্যায়ভাবে তাদের বার্মার অংশে পরিণত করে। ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার বার্মায় ক্ষমতা পেলে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার বেড়ে যায়। ১৯৭৮ আর ১৯৯২ সালে দুইবার তাদের উপর সামরিক অভিযান চালানো হলে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ৭২ তম সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহিংসতা, হত্যা, নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কিন্তু তার পূর্বেই হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়।
সুলতানি আমল, পাকিস্তানী আমল আর বর্তমান বাংলাদেশের শাসনামল এই তিন শাসনামলে রোহিঙ্গাদের অত্যাচার পরবর্তী সহযোগিতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তেমন কোনো বাস্তব পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি, যদিও সহযোগিতা ছিলো সকল শাসনামলেই। কিন্তু সর্বশেষ গত ২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করে মিয়ানমারের রাখাইন/আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার যে সুপারিশ করেছে তাতে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে উক্ত কমিশন রিপোর্টের বাস্তবায়ন সময়োপযোগী বলে মনে করছেন অধিকাং বিশ্ব নেতৃবৃন্দ।
তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতিসংঘের ৭২তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেছেন।
প্রথমত, অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা;
দ্বিতীয়ত, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা;
তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় (safe zones) গড়ে তোলা;
চতুর্থত, রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা;
পঞ্চমত, কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
অত্যাচার ও নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়েই একদিন রোহিঙ্গারা ইসলামের শান্তি-ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরাকান দখল করলে তখনও এটি পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। ১৯৩৯ সালে, রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যকার দীর্ঘ শত্রুতার অবসানের জন্য বৃটিশ প্রশাসন একটি অনুসন্ধানী কমিশন গঠন করে। কিন্তু ২য় বিশ্ব যুদ্ধের ফলে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। জাপানীদের কাছে বৃটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে আরাকান ছাড়তে বাদ্য হয়। জাপানীদের হাতেও রোহিঙ্গা নির্যাতন কম হয়নি।
বর্তমান আধুনিক মানব সভ্যাতার যুগে এমন ধ্বংসযজ্ঞ বা গণহত্যার মতো নিষ্ঠুরতা পৃথিবীর মানুষ প্রত্যাশা করে না। মানুষ চায় নিরাপত্তা আর বেঁচে থাকার অধিকার। ঘৃণ্য এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হোক, ফিরে পাক মানুষ তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার, হোক সেটি আরাকানে বা পৃথিবীর অন্য যেকোনো প্রান্তে। জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনতিবিলম্বে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে এর স্থায়ী সমাধান।
লেখক : সাংবাদিক, [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ