সোমবার ১৩ মে ২০২৪
Online Edition

ইতিহাস গড়া হলো না ভারতের মেয়েদের

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : বিরাট কোহলিদের পথেই হাঁটলো মিতালীরা। তাই ভারতীয়দের ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ক্ষতের চিহ্নটা যেন আর বাড়লো। তবে দু’টির ক্ষেত্রে পার্থক্য হচ্ছে, মিতালিরা হেরেছে দুর্দান্ত দাপট দেখিয়ে। জয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেই যেন তরি ডুবলো। অন্যদিকে নতি শিকার করেছিল কোহলিরা। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফির ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে বাজেভাবে হারার পর ভারতীয়রা অপেক্ষায় ছিল মেয়েদের বিশ্বকাপের দিকে। যদিও মেয়েরা তাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফাইনালে মাত্র ৯ রানের হার নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে তাদের। অন্যদিকে কোহলিদের হারটা ছিল ১৮০ রানের।
ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তীরে এসে তরি ডুবার কারণে ইতিহাস গড়া হলোনা ভারতের মহিলা দলের মেয়েদের। দুর্দান্ত দাপটে একের পর এক দুর্ধর্ষ সব প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে বিদায় করে ফাইনালে উঠেও ইংল্যান্ডের কাছে ৯ রানে হেরে গেল মিতালি রাজের দল। নিশ্বাস ছোঁয়া দূরত্বে এসে স্বপ্নভঙ্গ শচীন টেন্ডুলকর, বিরাট কোহলির দেশের ক্রিকেটকন্যাদের। অন্তিম লড়াইটা জিতলেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেতেন মিতালি-ঝুলন গোস্বামীরা। ঐতিহাসিক লর্ডসে ইতিহাসের হাতছানি দেয়া দ্বৈরথে এক পর্যায়ে পিছিয়ে পড়েও দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ভারত। আয়োজকদের ২২৮/৭Ñএর জবাবে ১ ওভার ২ বল আগে ২০৯ রানে অলআউট হয় মিতালিরা। ক্যারিয়ারসেরা বোলিংয়ের পথে ৬ উইকেট নিয়ে ফাইনালে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ ইংলিশ পেসার এনা সুরবসোল। আসরজুড়ে ধারাবাহিক ব্যাটিংশৈলী উপহার দিয়ে ‘ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট’ সতীর্থ টেমি বেমন্ট। মেয়েদের বিশ্বকাপে কুলিন ইংল্যান্ডের এটি চতুর্থবারের মতো শিরোপা জয়। অল্পের জন্য ইতিহাস গড়তে না পারলেও নিজেদের খেলা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভারতীয় ক্রিকেটে ‘মেয়েদের শচীন’ খ্যাত অধিনায়ক মিতালি। লর্ডসে শুরুতে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে স্কোরবোর্ডে প্রত্যাশিত সংগ্রহ দাঁড় করাতে পারেননি ইংল্যান্ড ব্যাটাররা। সারা টেলরের ৪৫, নাটালি স্কিভারের ৫১ ও শেষদিকে ক্যাথরিন ব্রান্টের ৩৪ ও জিনি গুনের ২৫ রানের ইনিংসে ভর করে ইংল্যান্ডের স্কোরবোর্ডে জমা হয়েছিল ২২৮ রান। ভারত এই রান সহজেই তাড়া করে জয় পাবে, এমনটাই হয়ত ধরে নিয়েছিলেন অনেকে। ৮৬ রানের ইনিংস খেলে ভারতের শুরুটাও ভালভাবেই করেছিলেন ওপেনার পুনম রাউত।
 অস্ট্রেলিয়াকে বিদায় করে দেয়া সেমিফাইনালে অপরাজিত ১৭১ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলা হারমানপ্রিত কাউর করেছিলেন ৫১ রান। বেদা কৃষ্ণমূর্তিও ৩৫ রানের ইনিংস খেলে দলকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যায়ের ব্যাটিং ব্যর্থতায় হতাশ হতে হয়েছে ভারতকে। ৪৩ থেকে ৪৯Ñ এই সাত ওভারে মাত্র ২৮ রান তুলতেই ভারত হারিয়েছে ৭ উইকেট। ফলে শেষ পর্যন্ত ব্যাটিংও করতে পারেননি ভারতের ব্যাটাররা। ৪৮.৪ ওভার ব্যাটিং করেই ২১৯ রানে গুটিয়ে গেছে ইনিংস। পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করতে পারলে পারলেও হয়ত প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের স্বাদ পেতেন ভারতের মেয়েরা। প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচটিতে দারুণ বোলিং করে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে গেছেন ইংল্যান্ডের ডানহাতি পেসার এনা সুরবসোল। ৯.৪ ওভার বোলিং করে ৪৬ রানের বিনিময়ে তিনি নিয়েছেন ৬ উইকেট। বলা বাহুল্য, স্মরণীয় নৈপুণ্যের পর ম্যাচসেরার পুরস্কারও উঠেছে তারই হাতে। এ যেন ২০০৫ সালের এ্যাকশন রিপ্লে। সেবারের মতো একইভাবে প্রত্যাশার পারদ তুঙ্গে তুলে ফাইনালে পৌঁছেছিলেন ঝুলন, মিতালিরা। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। যেভাবে শুরুটা হয়েছিল সেভাবে শেষ হলো না। লীগ পর্বে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারের পর যেভাবে সেমিফাইনালে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তা থেকে যেন জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করে দিয়েছিল আপামর ভারতবাসী। কিন্তু শেষ বেলায় সব প্রত্যাশায় জল ঢেলে খালি হাতেই ফিরতে হলো। ঝুলন, মিতালিদের হয়ত এটাই শেষ বিশ্বকাপ। ক্যারিয়ারের শো-কেসে বিশ্বকাপ রাখা হলো না বিশ্ব মহিলা ক্রিকেটের সফলতম এক ব্যাটার ও বোলারের। একরাশ হতাশা নিয়েই থামতে হলো তাদের। শেষ বেলায় আর উত্তেজনা ধরে রাখতে পারেনি ভারতের মেয়েরা। কিছুটা টেনশনেই উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসেন তারা। যার ফল হার। আবারও খালি হাতে বিশ্বকাপের আসর থেকে ফেরা। এত ভাল ক্রিকেট খেলার পরও।
এই আফসোস হয়ত কখনই যাবে না ভারতীয় ক্রিকেটের। ঠিক যে ভাবে ২০০৩ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে শেষ হয়েছিল দাদাবাবু সৌরভ গাঙ্গুলীদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। মিতালির ভাগ্যটাও যেন দাদার পরিণতি বরণ করল।
কষ্ট বুকে চেপে ভারত অধিনায়ক মিতালি রাজ বলেন, আমরা ফাইনালে খুবই ভাল খেলেছি। শক্তিশালী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সমানে সমানে লড়াই করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাপটা নিতে পারিনি। অযথা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আউট হয়েছি। হারলেও সাবেক অধিনায়ক ঝুলন গোস্বামীর প্রশংসাও শোনা যায় মিতালির গলায়। বাংলার সর্বকালের সেরা মহিলা পেসার সম্পর্কে মিতালি বলেন, ‘ঝুলন একজন ক্লাস বোলার। এটা বহুবার প্রমাণ করেছে ও। ফাইনালের ম্যাচেও ইংল্যান্ডকে এত কম রানে আটকে রাখার অন্যতম কারণ ওর বোলিং। দীর্ঘ ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অনেক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ঝুলন। তরুণ ক্রিকেটারদের কাছে ও আদর্শ।’ তবে পরের বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে তাকে যে আর দেখা যাবে না সেটাও এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন মিতালি। তিনি বলেন, ‘আরও দুই বছর আমি হয়ত ভারতের হয়ে খেলার চেষ্টা করব, তবে পরের বিশ্বকাপে আমার খেলার কোন সম্ভাবনাই নেই।’
মেয়েদের ওয়ানডে (৫০ ওভারের) বিশ্বকাপে জয়ের পাল্লাটা ইংলিশদেরই ভারি ছিল। এবারের আগে বিশ্ব ইভেন্টে এ পর্যন্ত ছয়বার মোকাবেলা করে ভারতকে চার বারই হারিয়েছে ইংল্যান্ড। তবে অত্যন্ত চাপের মধ্যেও ভারতীয় দলের ফল বের করে আনার সক্ষমতাটা অন্তত ইংলিশদের জানা ছিল। কেননা এই ভারতের কাছে টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে ৩৫ রানে হেরে গিয়েছিল স্বাগতিকরা।
ওই পরাজয়ের পর টানা সাত ম্যাচ জিতে ফাইনালে উঠেছে ইংল্যান্ড। হেথার নাইট এবং ওপেনার ট্যামি বিউমন্ট টপঅর্ডারে ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। চার নম্বরে খেলা নাটালি শিভার একমাত্র ব্যাটার যিনি বিশ্বকাপে রেকর্ড দু’টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। পক্ষান্তরে মিতালি রাজের নেতৃত্বাধীন ভারত প্রথমবার শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল তাদের অলরাউন্ড পারফরমেন্স দিয়ে। নতুন ইতিহাস গড়ার সুযোগ ছিল মিতালিদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা পারেনিনি। লর্ডস বরাবরই সুখকর ছিল এই অঞ্চলের ক্রিকেটের জন্য। সেটি থেকে বাদ যায়নি ভারতও। এই লর্ডসেই ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ভারতকে প্রথম বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন কপিল দেব। ফাইনালে হারলেও প্রশংসায় ভাসছেন রেকর্ডগড়া হারমানপ্রিত। কোহলির টুইট, ‘আহ কী ইনিংস হারমানপ্রিতের! অসাধরণ! শাস্ত্রীর টুইট এমন, ‘হারমানপ্রিত, ইউ রকস্টার। দুর্ধর্ষ।
তোমার এই ইনিংস যেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপে গ্রেট কপিলের সেই ১৭৫-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। গো এ্যাহেড।’ শচীন টেন্ডুলকরের অনুভূতি, ‘হারমানপ্রিত, এক কথায় অসাধারণ। তোমাদের প্রতি আস্থা আছে। সঙ্গে আছি। গুড লাক।’ এক লহমায় অনেক রেকর্ড এলোমেলো করে দিয়েছেন হারমানপ্রিত কৌর। ইংল্যান্ডে চলমান মহিলা বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিতে ‘ডিফেন্ডিং’ চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে দেয়ার পথে ১১৫ বলে অপরাজিত ১৭১ রানের অবিশ্বাস্য এক সেঞ্চুরি ইনিংস উপহার দিয়েছেন ভারতীয় ব্যাটার। বিশ্বকাপ ইতিহাসের নকআউট পর্বে যা ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের নতুন কীর্তি। প্রশংসার বন্যায় ভাসছেন ২৮ বছর বয়সী ইন্ডিয়ান প্রমীলা ক্রিকেটার। গ্রেট শচীন টেন্ডুলকর, জাতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি, কে নেই সেই তালিকায়? বিরাটদের নতুন কোচ ও জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার রবি শাস্ত্রী ইনিংসটিকে ১৯৮৩ বিশ্বকাপের সেমিতে কপিল দেবের সেই ১৭৫*-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। আর হারমানপ্রিতের অনুভূতি, ‘নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল, আমি পারব।’ অসাধারণ, অবিশ্বাস্য কোন শব্দই যথেষ্ট নয়। ডার্বিশায়ার ক্রিকেট গ্রাউন্ডে রীতিমতো ঝড় তুলেছিলেন হারমানপ্রিত।
ছেলেদের ক্রিকেট নিয়ে মিডিয়ায় যেমন মাতামাতি হয়, মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে ততটা নয়। চলতি নারী বিশ্বকাপে পারফর্মেন্স দেখিয়ে মিডিয়ার দৃষ্টি ফেরাতে সফল হয়েছেন নারী ক্রিকেটাররা। তার মধ্যে একজন ভারতের নারী দলের অধিনায়ক মিতালি রাজ। মেয়েদের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়ে যিনি এখন ‘লেডি শচীন’ নামে পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক ফর্ম তাকে ইতিমধ্যেই ‘লেডি কোহলি’ তকমা এনে দিয়েছে! বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৪১ রান করার পরই প্রথম নারী হিসেবে ৬০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন মিতালি। সে দিনই ওয়ানডে ডে ক্রিকেটে সর্বাধিক রানের মালিক বনে যান ৩৪ বছরের হয়দরাবাদী। শেষ ১৩ ম্যাচে দাপুটে ব্যাটিং দেখিয়ে পুরুষ দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলির প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন মিতালি। সতীর্থদের কাছে তিনি এখন শুধু শচীন নন, এবার তিনি এখন ‘লেডি কোহলি’ও বটে! বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৮ বছর, সেই ১৯৯৯ থেকে। তবু রানের খিদে এতটুকু মরেনি। এতদিন সর্বোচ্চ রান ছিল প্রাক্তন ইংল্যান্ড তারকা শার্লট এডওয়ার্ডসের। ১৯১ ম্যাচে ৫৯৯২ রান তার। ৮ ম্যাচ কম খেলেই সেই রান টপকে গেছেন মিতালি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ