শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
Online Edition

গড়ে তোলা হচ্ছে এশিয়ার বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল মিরসরাইয়ের ইছাখালী চরে

গড়ে তোলা হবে এশিয়ার বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল। মিরসরাইয়ে ইছাখালী চরে চলছে মহাকর্মযজ্ঞ -সংগ্রাম

 

চট্টগ্রাম অফিস ও মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা : পৌষ-মাঘ-ফাল্গুন এই শুষ্ক মওসুমেই প্রকল্পের রাস্তা ও মাটি ভরাটসহ দৃশ্যমান নির্মাণ কাজ শেষ করতে দ্রুত চলছে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ। বর্ষা আসার আগেই প্রস্তুত হতে এখন জোর প্রস্তুতি চলছে প্রকল্পে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (স্পেশাল ইকোনমিক জোন) প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু থেকে কাজের অগ্রগতির সাথে পাল্টাতে শুরু করেছে মিরসরাই উপজেলার ইছাখালি চরাঞ্চলের দৃশ্যপট। নদীর জেগে ঊঠা নিঝুম চর, এখন ব্যস্ত রুমঝুম শহর। চিরচেনা জনপদ যেন বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন। জনপদের সাধারণ মানুষ, কৃষক, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিরাও যেন পালাবদলের হাওয়ায় বদলে যাচ্ছে। শত শত শ্রমিক ও উৎসুক মানুষের কোলাহলে এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুখর চরাঞ্চল। রাতদিন শোনা যায় স্কেভেটর আর ট্রাকের আওয়াজ। শ্রমিকদেরও কর্মব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যাচ্ছে সেখানে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা পেতে যাওয়া দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পজোনের কারণে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। জানা যায়, আগামী ১৫ বছরে যেখানে কর্মসংস্থান হবে ৩০ লাখ মানুষের। বর্তমান সরকারের নেয়া পদক্ষেপে সাগর পাড়ের ধু ধু চর এখন পরিণত হতে যাচ্ছে দেশের বৃহৎ শিল্প নগরীতে। ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে বড় মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্বোধন করেন। 

সম্প্রতি চীনা কোম্পানী জিনডোন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) কর্তৃপক্ষের সাথে (এমওইউ) চুক্তি হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিনিয়োগ ও উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী সদস্য আবদুস সামাদ ও চীনা কেম্পানির চেয়ারম্যান জিয়ানচেন জু। 

চুক্তিতে চীনা কোম্পানির ২.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার কথা রয়েছে। এখন জিনডোন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) পরিবেশসহ প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র নিয়ে দ্রুত কাজ শুরু করবে বলে জানা গেছে। এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০৫৫ একর জমি চেয়ে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে। জানা গেছে, তাদের সেখানে জমি দেয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে এ নিয়ে চুক্তি হতে পারে। গত ২০ নবেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেয়। চিঠি বেজাকে পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়,২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরকালে তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। পরে গত মে মাসে দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, মিরসরাই তৃতীয় স্থান হতে পারে। এর পরিপেক্ষিতে গত অক্টোবর মাসে মিরসরাইয়ের সম্ভাব্য জমিটি যৌথ পরিদর্শন করা হয়। সর্বশেষ ২২ জানুয়ারি ভারত একটি চিঠিতে মিরসরাইতে সম্ভাব্য জমিও চিহ্নিত করেছে বলে জানায়। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি দেশীয় বড় বড় কোম্পানি আশেপাশে জমি কিনছে। জমির দাম যেমন চড়া হচ্ছে, এলাকার জমির মালিক,মিডিয়ার (মধ্যস্থতাকারী) পকেটও এখন গরম যাচ্ছে। চরের বাতাসে এখন টাকা উড়ছে। এখানে কয়েকটি ধাপে প্রতিষ্ঠা পাবে ৫০টি বিশেষায়িত উপ-অর্থনৈতিক অঞ্চল।

গত ১লা মার্চ সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, ইছাখালী চরে নদীর পাড়ে চরাঞ্চলে এখন চলছে বিশাল কর্মকাণ্ড। কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে শত শত শ্রমিক। এস্কেভেটর দিয়ে মাটির কাজ করা হচ্ছে। ৫৫০ একর জমিতে এখন চলছে ভূমি উন্নয়ন, এলাকায় যাওয়ার জন্য সড়ক নির্মাণ, সুপেয় পানির সরবরাহ ও বাঁধ নির্মাণেরি কাজ। বাঁধ নির্মাণের কাজে ১৫ থেকে ২০টি স্কেভেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মঘাদিয়া থেকে প্রকল্প এলাকায় যাওয়ার জন্য ৬ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণের কাজও প্রায় শেষের দিকে। চারলেন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কাজও এগিয়ে চলছে। এছাড়া চর জেগে ওঠার কারণে সেখানকার জমি অনেক নিচু। তাই ভূমি উঁচু করতে এখন সেখানে ফেলা হচ্ছে মাটি। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ছুটে যাচ্ছেন। অবহেলিত সমুদ্র চরে যেন স্বপ্নদুয়ার খুলে গেছে। 

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গভর্নিং বোর্ডের সভায় মিরসরাইয়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এখানে মোট সাত হাজার একর জমির ওপর গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক অঞ্চল। সরকারের ভরাটকৃত জমিতে প্লট নির্মাণ, সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ গ্যাস ও বর্জ্য নিরসনের ব্যবস্থা করবে ডেভেলপার। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) কর্তৃপক্ষ ৫০ বছরের জন্য প্রাইভেট ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে জমি লিজ দিবে । জমি লিজ নেওয়ার পর ওই অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী শিল্পোদ্যোক্তা আনবে নির্বাচিত ডেভেলপার। প্রাথমিকভাবে ৫৫০ একর জমির ওপর অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনটি টেন্ডারের মাধ্যমে সেখানে যোগাযোগের জন্য পাকা সড়ক নির্মাণ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মাটি ভরাটের কাজ শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। ভবিষ্যতে যাতে পানির কারণে ইকোনমিক জোন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য চলছে বাঁধ নির্মাণের কাজ। বাঁধে থাকছে স্লুইস গেট কাম সেতু। এই কাজের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২২ কোটি ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩শ’ ১টাকা। এ ছাড়া অর্থনৈতিক জোনের অধিভুক্ত জায়গায় মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। ২২ কোটি ৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ওই মাটি ফেলা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, ডিএফআইডি ও সরকারি অর্থায়নে এসব কাজ করছে মেসার্স আতাউর রহমান খান নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

মিরসরাই অর্থনৈতিক জোনে ১৫ হাজার একর খাস জমিতে ৫০টি উপ-অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বেজার। ইতোমধ্যে ৬ হাজার ৩৯০ একর বেজার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি নয় হাজার একর জমি আগামী ২ বছরের মধ্যে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। হস্তান্তর করা ৬ হাজার ৩৯০ একর জমির মধ্যে পীরের চরের ১৩৯০ দশমিক ৩১৬ একর, সাধুর চরের ১৬৪৪ দশমিক ১০৩৯ একর, শিল্প চরের ১৮৫২ দশমিক ৫৩৮৫ একর এবং চর মোশারফের ১৫০৪ দশমিক ২৯৩০ একর জমি সর্বমোট ছয় হাজার ৩৯০ একর জমি প্রথম ধাপের কর্মপরিকল্পনায় রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে মিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজি উপজেলার ৩০ হাজার একর জায়গাকে অর্থনৈতিক জোনে মিলিত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের পশ্চিমে জেগে উঠা নাছরিন চরকে খুঁটির বাইরে রাখা হয়েছে। যেটি ফেনীর অর্থনৈতিক জোনের আওতায় রেখে মিরসরাই অর্থনৈতিক জোনের সাথে মিলিত করা হবে। 

জানা যায়, তৈরি পোশাক ও পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট শিল্প, মোটরবাই নির্মাণ ও অটো মোবাইল পার্টস, স্টিলসহ মেশিনারিজ নির্মাণের লক্ষ্যে মোট এক হাজার ২২২টি কারখানা স্থাপন করা হবে ইছাখালীর চরে। এছাড়াও পুরো শিল্পজনে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্ণাঙ্গ আবাসিক এলাকা, সমুদ্রবন্দর, কম্পোজিট প্ল্যান্ট, আইটি পার্ক, ট্যুরিজম পার্ক, বিকল্প পোর্ট কানেকটিং সড়ক, রেল লাইন নির্মাণ, ১০০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট, ৬৬০ মেগাওয়াটের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে চীনের জিজিয়ান জিনডোন হোল্ডিং গ্রুপের সঙ্গে বেজার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। জিনডোন গ্রুপ গত মাসে প্রকল্প এলাকা সার্ভে করে একটি রিপোর্ট প্রদান করেছে। 

মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সার্ভেয়ার নাজমুল হাসান বলেন, মিরসরাইয়ের চারটি চরের পাশাপাশি ফেনীর অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য চর নাছরিন নামে একটি চরকে চি‎হ্নিত করা হয়েছে। যা পরবর্তীতে মিরসরাই শিল্পজোনে যুক্ত হবে। সব মিলিয়ে ত্রিশ হাজার একর জায়গায় এ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি গড়ে উঠবে। 

মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আতাউর রহমান জানান, ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কারণে দেশের অর্থনীতিতে মিরসরাই অঞ্চল অবদান রাখবে পাশাপাশি এখানকার মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটবে। 

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, ‘মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কাছে। তাই এখানে বিনিয়োগ করতে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত আগ্রহী। এখানে শিল্প-কারখানা, স্কুল, আবাসিক ভবন, মসজিদ, হাসপাতালসহ সব ধরনের সুবিধা রাখা হবে।’

মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্বপ্নদ্রষ্টা গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি বলেন, ‘ইছাখালীতে জেগে উঠা চর দেখেই অর্থনৈতিক জোনের সম্ভাবনা মাথায় আসে। ২০১০ সালে মহামায়া সেচ প্রকল্প উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী মিরসরাইয়ে আসলে আমি ইছাখালী চরে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানাই।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, কিছু দিনের মধ্যে জমি বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে। বাজার মূল্যের চেয়ে জমির দাম ২৫ ভাগ কম রাখা হবে। নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। আমরা ১২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে আমাদের জোন ঘেঁষে যে সমুদ্র উপকূল আছে সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড, নেভি ও চায়না হারবারকে দিয়ে সাড়ে ১৮ কিলোমিটারের আরেকটি মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করছি। ২৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে এ বছর শুধুমাত্র এই ইকোনমিক জোনেই সবমিলিয়ে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার কাজ করবো।

এদিকে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো থেকে আশানুরূপ ফল পেতে হলে ব্যবসায়ীদের প্রণাদনা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

যোগাযোগ ব্যবস্থা : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়তাকিয়া বাজার থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে সমুদ্র তীরে শিল্পজোনটির অবস্থান। এ সড়কটি বেয়ে পশ্চিম দিকে গেলেই মোড়ে মোড়ে চোখে পড়বে এ্যারো চিহ্নিত ইকোনোমিক জোনের সাইনবোর্ড। আঁকাবাঁকা সড়ক বেয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলে পোঁছার আগেই উন্নয়নের চিত্র টের পাওয়া যায়। ফসলি জমির বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া পিচঢালা সড়কের দুই পাশেই পরিবর্তনের ছোঁয়া। বুঝাই যায়, ইকোনোমিক জোনের কারণেই এলাকার দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ