রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

স্বপ্ন নিয়ে সামনে এগুচ্ছে মহিলা ফুটবল

নাজমুল ইসলাম জুয়েল : মেয়েরা ফুটবল খেলবে- এটা যেন কল্পনা থেকেও বেশিকিছু ছিল বাংলাদেশে। এখন সেটাই বাস্তব। দেশের ফুটবলে এখন সুখবর বলতে তেমন কিছুই নেই। বিশেষত পুরুষ ফুটবল দলের জন্য বছরের পর বছর ধরেই হতাশাই টেনে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে মহিলা ফুটবল দলকে। দিনে দিনে উন্নতি করা জাতীয় মহিলা ফুটবল দল এবার অল্পের জন্য সাফ ফুটবলের শিরোপা জয় করতে পারেনি। প্রথমবারের মতো ফাইনালে পৌঁছে গেলে শিরোপা ছুয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। এবারের এই সাফল্যকে বলা হচ্ছে, মহিলা ফুটবলে প্রাপ্তি ধারাবাহিকতার ফল! এএফসি’র অনূর্ধ্ব-১৪ দল টানা দ্বিতীয়বার আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন, অনূর্ধ্ব-১৬ দল চূড়ান্ত পর্বে। এবার মহিলা সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ। ফাইনাল মঞ্চে সোনালী ট্রফি ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে না পারলেও নতুন দিনের পতাকা ওড়াচ্ছেন সাবিনা, মাইনু মারমা, কৃষ্ণা রানী, সানজিদা, মৌসুমীরা। সাফ মিশন শেষ করে এরেইমধ্যে ঢাকা ফিরেছে জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। বিমানবন্দরে তাদের ফুল দিয়ে বরণ করেন বাফুফে কর্তারা। অতৃপ্তি শিরোপা মঞ্চে ৩-১ গোলে হার; ২০ জনের ১৫ জন অনূর্ধ্ব-১৬ দলের; ৫ জন জাতীয় দলেই আনকোরা।
তারপরও প্রাপ্তি হিসেবে শিলিগুড়ি সাফ লাল-সবুজ মেয়েদের মুঠোভরে দিয়েছে। ফাইনাল হতাশার চেয়ে প্রাপ্তির পাল্লাই ভারি সাবিনাদের! নেপালের পর বাংলাদেশের বিপক্ষেও ভুল বাঁশি বাজিয়েছেন রেফারি, দুইটিতেই অ্যাডভান্টেজ ভারতের। ফাইনাল শেষে ক্ষোভ জানান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন, ‘সমান তালে খেললেও ভুটানি রেফারি প্রেমা তিসেওয়াং খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। ৬২ মিনিটের পেনাল্টি গোলে মেয়েরা ভেঙে পড়ে। আমি মনে করি না, ওটা পেনাল্টি ছিল, জিরো অ্যাঙ্গেলে বল ছিল, বালার পা থেকে বল সরে যাওয়ার পর ডিফেন্ডার নার্গিস শুধু তার কাছে গেছে।’ শিউলী আজিম, শামসুন্নাহারের ভুলে ভারত এগিয়ে যায়, সিরাত জাহান স্বপ্না ১-১ করলেও ‘ভুল’ পেনাল্টি ফের পিছিয়ে দেশ বাংলাদেশকে। গোলরক্ষক সাবিনা আক্তারের ভুলে ৩-১। ফাইনালের মঞ্চে উঠে শিরোপা ছুঁতে না পারার হতাশা থাকলেও স্বপ্না-কৃষ্ণাদের হাত ধরে লাল-সবুজ নারী ফুটবল এগিয়ে যাবে, বিশ্বাস কোচের। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশে ম্যাচ বাই ম্যাচ খেলেছে। ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বে ড্র করেছিলাম, ওরা শক্তিশালী দল। লাল-সবুজ মেয়েরা মাত্র বেড়ে উঠছে, প্রতি ম্যাচে উন্নতি করেছে। আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, ভারতের বিপক্ষে খেলার অভিজ্ঞতা সেপ্টেম্বরে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের মূল পর্বে কাজে লাগবে বলেই মনে করা হচ্ছে। আফগানদের ৬-০ গোলে হারিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু সাবিনাদের; ইসলামাবাদে আফগানদের ৬-১ গোলে হারানো সেরা শুরু, ২০১০ সালে শ্রীলঙ্কাকে ২-০ হারিয়ে, ২০১২-তে ভারতের কাছে ৩-০ গোলে হারে সূচনা ম্যাচে। আফগান ম্যাচে স্ট্রাইকার সাবিনা একাই করেন ৫ গোল; বড় জয়ে শেষ চারের টিকিট নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের, ভারতের বিপক্ষে নতুন দিনের প্রত্যয়। আগের ৬ ম্যাচের সবক’টিতে হারলেও গোলরক্ষক সাবিনার দুরন্ত নৈপুণ্যে গোলশূন্য ড্র। শিউলী-শামসুন্নাহার-নার্গিসদের দুর্ভেদ্য রক্ষণ দেয়াল। ড্রয়ে প্রথমবার ভারতকে রুখে, প্রথমবার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ চারে। সেখানে সিরাত জাহান স্বপ্নার হ্যাটট্রিক মালদ্বীপকে ৬-০ বিধ্বস্ত করে প্রথমবার শিরোপা মঞ্চে। গোল হজম না করে ফাইনালে ওঠার রেকর্ড ছিল ভারতের (২০১০ ও ২০১২) ও নেপালের (২০১০ ও ২০১৪)। ওই রেকর্ডে ভাগ বসাল বাংলাদেশ; শিলিগুড়িতে ১২ গোল করলেও প্রতিপক্ষকে দিতে দেয়নি। ২০১৪ সাফে ভারতের গোল না খেয়ে ফাইনালে ওঠা হয়নি বাংলাদেশের কারণে। ভারত শিরোপা জিতলেও গ্রুপ পর্বে সাবিনা করেছিলেন একটা গোল। রক্ষণ, মাঝমাঠ ও আক্রমণÑ তিন বিভাগেই বাংলাদেশ ছিল গত তিন আসরের চেয়ে জমাট। এবার বাংলাদেশ দিয়েছে সবচেয়ে বেশি ১৩ গোল, হজম করেছে ৩টি; সবক’টি তো ফাইনালে।
চার সাফে ১৫ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় ও হার ৭টি করে, ড্র শিলিগুড়িতে ভারতের সঙ্গে ০-০; ৩৬ গোল করেছে, হজম ২৫টি। শীর্ষে ৪ ট্রফি জেতা ভারত, ১৯ ম্যাচে ১৮টি জয়, ড্র বাংলাদেশের বিপক্ষে, গোল ১২০/৫। তিনবার রানার্সআপ নেপালিরা ১৯ ম্যাচে হেরেছে ৪টি, গোল ৯১/১৪। এখনও জয়হীন ১২ ম্যাচ খেলা ভুটান। ২০১০ থেকে ২০১৬; চার সাফে সাবিনার গোল ১৩টি, হ্যাটট্রিক ৩টি; নেপালি সাবিত্রি ভান্ডারির ১৩টি। শীর্ষে ভারতের বালা দেবি (১৬)। ফাইনালে স্বপ্ন ভাঙলেও বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলের সুন্দর আগামীর সম্ভাবনা ডালপালা মেলেছে সাফে। এটাকে এখন ধরে রাখার কঠিন মিশনেই নামতে হচ্ছে প্রমীলা টাইগারদের।
কাছে গিয়ে শিরোপা জিততে না পারার হতাশা
দক্ষিণ এশিয়ার মহিলা ফুটবলে ভারত অন্য দলগুলোর চেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবেই পরিচিত। বিশেষ করে তাদের সাফল্যই পরিসংখ্যানের পক্ষে কথা বলছে। সে কারণেই গ্রুপ পর্বে ভারতকে রুখে দেয়া বাংলাদেশ কুলিয়ে উঠতে পারেনি ফাইনালে। এর আগে প্রথমবারের মতো মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠে ইতিহাস গড়েছিলেন সাবিনা-স্বপ্নারা। কিন্তু সেই ইতিহাসকে আরও রাঙাতে পারল না বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। ফাইনালে আগের তিন আসরের চ্যাম্পিয়ন ভারতের বিপক্ষে ৩-১ গোলে হেরে রানার্সআপ হয়েই ফিরতে হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েদের। টুর্নামেন্টে কোনো গোল হজম না করার তৃপ্তি নিয়েই স্বপ্নের ফাইনাল শুরু করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দর্শক সমর্থন নিয়ে শুরু থেকেই আগ্রাসী ফুটবলে নিজেদের মেলে ধরে স্বাগতিক ভারত। দ্বিতীয় মিনিটে অল্পের জন্য গোলহজম থেকে বেঁচে যায় লাল-সবুজ দল। ডি-বক্সের একটু ওপর থেকে সাসমিতা মালিকের ফ্রি-কিক দ্বিতীয় পোস্টঘেঁষে বেরিয়ে যায়। তবে বাংলাদেশের গোলমুখ খুলতে বেশি সময় নেননি স্বাগতিকরা। গ্রুপ পর্বে রক্ষণাত্মক কৌশলে ভারতকে আটকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই রক্ষণের ভুলেই পিছিয়ে পড়েন সাবিনারা। ১২ মিনিটে শিউলী আজিমের কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে বাঁ-দিক থেকে সাসমিতার বাড়ানো ক্রসে প্লেসিং শটে জাল কাঁপান দাঙ্গমেই গ্রেসি। ৩৯তম মিনিটে পাল্টা আক্রমণ থেকে সমতায় ফেরে বাংলাদেশ। এরপর দুই গোল হজম করে আর খেলায় ফিরতে পারেনি গোলাম রব্বানী ছোটনের শীষ্যরা।
মেয়েদের সাফ ফুটবলে কখনোই ফাইনাল খেলতে পারেনি বাংলাদেশ। সে কারণেই ফাইনালে উঠাটা যেমন ইতিহাস ছিল ঠিক তেমনি ছিল চ্যাম্পিয়ন হয়ে নতুন ইতিহাস গড়াও। ছেলেদের ফুটবল যখন রসাতলে, তখন ইতিহাসটা গড়ে ফেলল দেশের নারী ফুটবলাররা। মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হলে দেশের নারী ফুটবলের ইতিহাসে যেটি হতো এক নতুন মাইলফলক। গোটা বাংলাদেশ দলের সঙ্গে কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনও শিরোপার স্বপ্নই দেখছেন। ভারত কখনই সহজ প্রতিপক্ষ ছিল না বাংলাদেশের জন্য। মুখোমুখি লড়াইয়ে পরিসংখ্যানে এগিয়ে ছিল ভারত। এর আগে ছয়বার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ-ভারত। এর কোনোটিতেই জয় দেখেনি বাংলাদেশ, এবারের সাফের গ্রুপপর্বের ড্রটাই সর্বোচ্চ অর্জন। জুনিয়র পর্যায়ে অবশ্য দুবার ভারতকে হারানোর সুখস্মৃতি আছে।
সেই সাফল্যের কারিগর কৃষ্ণা রানী সরকার আছেন এই বাংলাদেশ দলেও। মেয়েদের সাফে ২০১০ সালে ৬-০, ২০১২ সালে ৩-০, ২০১৪ আসরে ৫-১ গোলে ভারতের কাছে হেরেছে মেয়েদের জাতীয় দল। এসএ গেমস ফুটবলে ২০১০ আসরে ৭-০ এবং ২০১৬ আসরে ৫-১ গোলের হার পরাজয় দু’টো আজও বড় ক্ষত হয়ে আছে। এবার দিনবদলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গ্রুপ পর্বে এই ভারতকে রুখে দিয়েই গ্রুপসেরা হয়েছিল বাংলাদেশ।
সাফল্যের অংশীদার হননি কাজী সালাউদ্দিন!
সাফ সভাপতি হিসেবে দারুণ সফল কাজী সালাউদ্দিন। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপকে নিয়মিত করেছেন। বয়সভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টও মাঠে নামিয়েছেন। মহিলা ফুটবল চালু হয়েছে তার মেয়াদে। চলতি বছর মাঠে গড়ানোর কথা রয়েছে সাফ ক্লাব কাপ চ্যাম্পিয়নশিপ। এতো কিছুর পরে ব্যক্তি সালাউদ্দিনের একটি অপূর্ণতা ছিল। সাফ সভাপতি হিসেবে দেশের হাতে ট্রফি তুলে দেয়ার। প্রায় এমন কথা বলতে শোনা গেছে তার মুখে। এবার সুযোগ ছিল মহিলা দলের হাতে ট্রফি তুলে দেয়ার। অথচ শিলিগুড়ির সাফ মহিলা ফুটবলের ফাইনালে অনুপস্থিত তিনি। বাংলাদেশ মহিলা দল দুর্দান্ত খেলে সাফের ফাইনালে। সাফ ও বাফুফে সভাপতি উভয় পদ থেকেই সাফ মহিলা ফুটবলের ফাইনাল মঞ্চে অনুপস্থিত থাকার কথা সালাউদ্দিনের। ফিফা-এএফসি’র বিভিন্ন সভা, সেমিনারে অহরহ যোগ দিলেও সাফের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি অধিকাংশ সময় অনুপস্থিত থাকেন।
২০১৪ সালে নেপাল সাফে ২০১৬ কেরালা সাফের ফাইনালে ছিলেন না তিনি। সাধারণত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোতে ফাইনালের দিন পুরস্কার প্রদান করে থাকেন সংস্থাগুলোর সভাপতি। এক্ষেত্রে সাফ একটু ব্যতিক্রমই। গত বছর ২০১৬ সাফ অনূর্ধ্ব ১৯ পুরুষ টুর্নামেন্টে নেপালে থেকেও ফাইনালে উপস্থিত হননি সাফ সভাপতি। ২০১৬ সালে কেরালায় সাফ ফাইনালের আগে নির্বাহী সভা হয়েছিল। ফাইনালে না আসায় সেই সভাতেও অনুপস্থিত ছিলেন। মামুনুলরা সালাহউদ্দিনের স্বপ্ন পূরণে তিনবার ব্যর্থ হলেও সাবিনা-স্বপ্নারা সফল। কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন ও ফুটবলারদের ইচ্ছা ছিল সালাউদ্দিনের হাত থেকে মেডেল ও ট্রফি নেয়ার। সেই ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি। শুধু সালাউদ্দিন নন বাফুফের অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ আসেননি।
তবুও অবহেলা করা হয়েছে মেয়েদের
যারা ভাল করবে তাদেরকে নিয়ে অবহেলা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এবার সেরকমই ঘটনা ঘটেছে সাফ নারী ফুটবলের শিরোপা জিতে আসার পর। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানো নারী ফুটবলাররা ঘরে ফিরলেন বাফুফের অবহেলায়। নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের রানার্সআপ ট্রফি নিয়ে গত ৫ জানুয়ারী রাত সাড়ে ১০টায় হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পা রাখেন সাবিনা-স্বপ্নারা। বাফুফে থেকে আগে জানানো হয়েছিল শীর্ষ কর্তারা মিষ্টি আর ফুল নিয়ে বিমানবন্দরে নারী ফুটবল দলকে অভ্যর্থনা জানাবেন। মিষ্টি আর ফুল ঠিকই গেছে বিমানবন্দরে, যাননি বাফুফের নির্বাহী কমিটির কোনো কর্মকর্তা। বাফুফের হেড অব মার্কেটিং সাঈদ আল ফাতাহ্, কয়েকজন এক্সিকিউটিভ বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন নারী ফুটবলারদের অভ্যর্থনা জানাতে। রাত ৯ টা ৫ মিনিটে কলকাতা থেকে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছানোর কথা কথা ছিল নারী ফুটবল দলের। তবে ফ্লাইট বিলম্ব হয়েছে এক ঘণ্টারও বেশি সময়। বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ জানিয়েছিলেন, বিমান বন্দরে নারী ফুটবল দলকে অভ্যর্থনা জানাতে সভাপতি কাজি সালাউদ্দিন উপস্থিত থাকবেন। নির্বাহী কমিটির সব কর্মকর্তাকে বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতেও অনুরোধ জনানো হয়েছে। মজার বিষয় হলো সাধারণ সম্পাদক নিজেও জাননি মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাতে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ