রবিবার ১২ মে ২০২৪
Online Edition

নারায়ণগঞ্জবাসীকে অতীতের ঘটনাগুলো মনে রাখতে হবে

[চার] 

জিবলু রহমান : এ ছাড়া র‌্যাব-১১-এর অপর দুই সাবেক কর্মকর্তা মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প অধিনায়ক লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানা জিজ্ঞাসাবাদের সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বলেছেন, যেখান থেকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে বলে বলা হচ্ছে, সেই এলাকা তাঁদের কর্ম এলাকার মধ্যে পড়ে না। তাই তাঁদের সম্পৃক্ত থাকার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।

২২ মে ২০১৪ পুলিশের পক্ষ থেকে কোর্ট দারোগা (সিএসআই) আশরাফ উজ জামান আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলেছিলেন, র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তারা এই অপহরণ ও হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তা ছাড়া তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, অপহরণ ও হত্যায় র‌্যাবের অন্তত ১৮ জন সদস্য অংশ নিয়েছেন। তাঁদের পুলিশ চিহ্নিত করতে পেরেছে। 

জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারেক সাঈদের কাছে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানতে চেয়েছিলেন, তিনি (তারেক) কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন নূর হোসেন ও শামীম ওসমান এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, নারায়ণগঞ্জে অপহরণ ও খুনের মতো কিছু ঘটনায় নূর হোসেন জড়িত ছিলেন বলে তিনি তাঁর দায়িত্বকালে জানতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী এবি সিদ্দিক অপহরণের সঙ্গেও নূর হোসেন জড়িত ছিলেন বলে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন। আর শামীম ওসমানের ছত্রচ্ছায়ায় নারায়ণগঞ্জে নূর হোসেন অপকর্ম চালিয়েছেন। নূর হোসেন শামীম ওসমানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত ছিলেন। তা ছাড়া নিহত নজরুল ইসলামের সঙ্গে নূর হোসেনের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক শক্রতা ছিল। এঁরা দুজনেই ছিলেন শামীম ওসমানের সহযোগী।

তারেক সাঈদ জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, র‌্যাব-১১-এ দায়িত্ব পালনকালেই তিনি এই ঘটনায় নূর হোসেন জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিলেন। আর হত্যাকারী ও হত্যার শিকার দুই ব্যক্তি শামীম ওসমানের লোক হওয়ায় এ বিষয়ে তাঁর কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকাটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন তারেক। তা ছাড়া নূর হোসেন এবং আবু সুফিয়ান নামে একজন ঠিকাদারি ব্যবসায়ীর ফোনালাপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ওই আলাপে মনে হয়েছে, নূর হোসেন শিগগিরই কোনো একটি হত্যাকাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছেন। নজরুলসহ সাতজনের হত্যার ঘটনা এর পরেই হয়েছিল৷ (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ২৪ মে ২০১৪)

২৫ মে ২০১৪ যশোরে স্থানীয় যুবলীগের সভাপতি আলমগীর হোসেনকে হত্যা করা হয়। এর পেছনে জেলা সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আলমগীরের স্বজনরা।

২৬ মে ২০১৪ রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর ঘটনায় সবাই বিব্রত। এসব গুম-খুন সবই অপরাজনীতি ও দুঃশাসনের ফল। এ থেকে বের হতে হলে সরকারকে দলনির্ভর হতে হবে। আমলাতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কাটিয়ে দেশে আওয়ামী লীগের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য তৃণমূল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে দলকে সুসংগঠিত করতে হবে। কারণ সুসংগঠিত দল ও সুশৃংখল রাজনীতি এ সরকারকে ৫ বছর ক্ষমতায় রাখতে পারবে।

রাষ্ট্রযন্ত্র কাউকে দিয়ে একটি অপরাধ করালে সে নিজের লাভের জন্য আরও ১০টি অপরাধ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, সেই অস্থিরতারই সুযোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে কোনো বাহিনীর নাম করে অপরাধ করা হলে সেই বাহিনীর দায়িত্ব বিষয়টি পরিষ্কার করা। তা না হলে মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়াবে।

শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ভাটির দিকে গেলে ধলেশ্বরী নদী। ২০১১ ও ২০১২ সালে এই এলাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী থেকে ৩০টির মতো লাশ উদ্ধার হয়েছে। এঁদের বেশির ভাগেরই হাত-পা বাঁধা ছিল। কয়েকজনকে গুলি করে খুন করা হয়েছে। তখন মুন্সীগঞ্জের পুলিশ জানিয়েছিল, ঢাকার কেরানীগঞ্জ বা নারায়ণগঞ্জের কোনো এলাকা থেকে হত্যা করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই লাশগুলোর বেশির ভাগের শরীরে ইট বাঁধা ছিল। নারায়ণগঞ্জের সাত লাশের সঙ্গেও একইভাবে ইট বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।

ধলেশ্বরী নদীতে ৩০টি লাশ কীভাবে এল, এখনো তার কোনো কিনারা হয়নি। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে, তারা একে অন্যের ওপর দোষ চাপান। অনেক পুলিশ কর্মকর্তাই মনে করেন, এর সঙ্গে অন্য বাহিনীর হাত আছে। এ কারণে কোনো তদন্ত হয় না। সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত বিষয়গুলো জানে। কিন্তু প্রশাসনের সব অংশকে খুশি রাখতে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।  (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ৪ মে ২০১৪)

ধলেশ্বরী থেকে পাওয়া সেই ৩০ লাশের ব্যাপারে কথা উঠেছিল, এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একটি বাহিনীর কিছু সদস্যের হাত আছে। একইভাবে নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে যেভাবে অপহরণ ও খুন করা হয়েছে, তার ধরণ দেখে সন্দেহ করা হচ্ছে এর সঙ্গে একই বাহিনীর একটি অংশের হাত থাকতে পারে।

পুলিশ বাহিনীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, দেশের অপরাধ পরিস্থিতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে অপহরণ বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। ২০১১ সালে দেশে অপহরণ ছিল ৭৯২ জন, ২০১২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮৫০; আর ২০১৩ সালে হয়েছে ৮৭৯। ২০১৪ সালের তিন মাসেই অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১৯৬টি। তুলনা করলে দেখা যাবে, ২০১৩ সালের প্রথম তিন মাসে অপহরণ ছিল ১৬৮টি।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত মোট ২৬৮ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয় ২৪ জনকে। পরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় ১৪ জনকে। কিন্তু ১৮৭ জনের এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজই মেলেনি। আসক এ তথ্য সংগ্রহ করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে। তবে অনেক ঘটনা সংবাদপত্রে আসেনি, সেগুলো আসকের হিসাবে নেই।

আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৩৯ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের চারজন, ছাত্রদলের তিনজন, জামায়াত-শিবিরের দু’জন, বিএনপির ১১, তিনজন ব্যবসায়ী, চারজন চাকরিজীবী ও ১১ জন সাধারণ নাগরিক রয়েছেন। এই ৩৯ জনের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীসহ চারজনকে। কিন্তু বাকি ২৩ জনের এখনো কোনো খোঁজই নেই।

র‌্যাব আইন ও জনসংযোগ শাখা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত র‌্যাবের কাছে দুই হাজার ৬৪১ জনকে অপহরণের অভিযোগ আসে। এর মধ্যে এক হাজার ৮৭ জনকে র‌্যাব উদ্ধার করে। অন্যদের অবস্থা কী হয়েছে, তা র‌্যাব জানে না। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ এপ্রিল চার মাসে ৭৭ জন অপহৃতকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব।

কমিশনার নজরুলসহ ৭ হত্যাকাণ্ডে আলোচনায় ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ ট্রাক স্ট্যান্ডে অবস্থিত মন্ত্রী মফাজ্জল হোসেন মায়ার পুত্র দীপু চৌধুরীর রিনালয় সিএনজি স্টেশন। এখানে বসেই পরিকল্পনা হতো নানা ঘটনা, দুর্ঘটনার। সিদ্ধিরগঞ্জ, শিমরাইলসহ আশপাশের সব অপকর্মের হোতা নূর হোসেন এ সিএনজি স্টেশনে বসাতেন নানা পার্টি। পানীয়ের আসর বসতো নিয়মিত। এসব আসরে মন্ত্রীপুত্রের সঙ্গে আরও যোগ দিতেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। স্থানীয় সন্ত্রাসীরা তো থাকতোই নিয়মিত। আর পিতা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হওয়ায় তার প্রভাবও ছিল ব্যাপক। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর পিতা মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেলে তার প্রভাব বেড়ে যায় বহুগুণে। এ প্রভাবে সিএনজি স্টেশনের গ্যাসের বিল দেয়া বন্ধ করে দেন তিনি। রাজধানীর টিকাটুলী তিতাস গ্যাস অফিসের নিয়ন্ত্রণাধীন রিনালয় সিএনজি স্টেশনে এক বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকার গ্যাস বিল বকেয়া পড়ে যায়। এ সময়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ একাধিকবার নোটিশ দিয়েও বকেয়া বিল আদায়ে ব্যর্থ হয়। কমিশনার নজরুল হত্যার পর আলোচনায় উঠে আসে মন্ত্রীপুত্র দীপু চৌধুরী। 

খোদ নজরুলের পরিবার থেকেই বলা হয়, র‌্যাবের সঙ্গে খুনের চুক্তি করেন মন্ত্রীপুত্র। এই যখন অবস্থা তখন নড়েচড়ে বসে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। তারা সুযোগকে কাজে লাগাতে ৮ মে ২০১৪ রিনালয় সিএনজি স্টেশনে অভিযান চালায়। তিতাস কর্তৃপক্ষ রিনালয়ের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে তাদের বাধা দেয়া হয়। মন্ত্রীর হুমকি দেয়া হয়। একপর্যায়ে তাদের ওপর হামলা চালাতে উদ্যত হয় সন্ত্রাসীরা। এ অবস্থায় অভিযানে যাওয়া তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ফিরে আসেন। তারা এব্যাপারে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় জিডি করেন।   [চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ