সোমবার ০৬ মে ২০২৪
Online Edition

এনকাউন্টারে নিহত আট ছাত্রের কী অপরাধ?

জি. কে সাদিক : ভারতের ভুপালে গত ৩০ অক্টোবর রাতে ৮ জন মুসলিম ছাত্র ভুপালের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কেন্দ্রীয় কারাগারে এক কারারক্ষীকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। তারা ছিলেন ভারতের নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া (এসআইএমআই বা সিমি)‘র আট সদস্য। তাদের পালিয়ে যাওয়ার ১০ ঘন্টা পরে তথা সোমবার দিন সকালে ভুপালের অদূরে ইতখেড়ি গ্রামের কাছে মালিখেড়ায় পুলিশ ও এন্টিটেরোরিজম স্কোয়াডের (এটিএস)’র সাথে বন্দুকযুদ্ধে ওই বন্দীরা নিহত হয় বলে পুলিশ দাবি করে। পুলিশের দাবি পলাতক আট জন তারা পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধ করেছে। আর পুলিশ এই হত্যাকে এনকাউন্টার বলে দাবি করেছে। আর তারপর থেকেই শুরু হয় তাদের এই কথিত এনকাউন্টার নিয়ে মিডিয়াতে জল্পনা-কল্পনা।
ভুপালের পুলিশের নির্দেশেই করা হয়েছে এই হত্যাকাণ্ড বলেও দাবি করা হচ্ছে। সম্প্রতি ভুপালের পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে ফাঁস হওয়া এক অডিও রেকর্ডের ভিত্তিতে এমন দাবিই করা হচ্ছে। ‘দৈনিক নয়া দিগন্ত ৫ নভেম্বরে’ ৫ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এমন তথ্যই উঠে এসেছে। যেখানে সরাসরি ৮ জন পলাতক ছাত্রদের গুলী করে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয় পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে। কথিত ওই বন্দুক যুদ্ধের ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও প্রকাশ করে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো। যেখানে নিহতদের লাশ পড়ে আছে। আর তাদের খুব কাছ থেকেই গুলী করছেন এক পুলিশ সদস্য। কিন্তু তাদের হাতে কোন অস্ত্র দেখা যায়নি। এক পুলিশ (এটিএস) সদস্যকে দেখা যায়, এক লাশের প্যান্টের পকেট থেকে ছুরির মত কিছু একটা বের করতে। তবে তাদের কাছে কোন আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়নি। উল্লেখ্য গুলী করার সময়্ ওই ছাত্রনেতারা নিরস্ত্র ছিলেন বলে জানিয়েছেন মধ্যপ্রদেশের এটিএসের প্রধান সঞ্জিব শামি। শামি ০২,১১,১৬(বুধবার) দাবি করেন, ‘আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে, কখন পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে এবং কখন হত্যা করতে পারবে। আমি মনে করি, নিহতরা ছিল ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। আইন অনুসারে, পুলিশ যদি দেখে তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাহলে তারা সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করতে পারবে।’ শামি আরো দাবি করে, ‘পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলী ছোঁড়া না হলেও শক্তি প্রয়োগ করা যায়।’
কথিত এই বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়াসহ তাদের বিরোধীদলীয় নেতারা জোর আপত্তি তুলেছেন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোও মধ্যপ্রদেশের সরকারের কাছে ঠা-া মাথায় আট মুসলিম ছাত্রের খুনের ব্যাখ্যা দাবি করেছে। তবে এ বিষয়ে ভুপালের পুলিশসহ মধ্যপ্রদেশের সরকার নীরব ভূমিকা পালন করছে। স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এর নিন্দা জানিয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এ ধরনের এনকাউন্টারের বেশির ভাগই ভুয়া। এছাড়া পুলিশবাহিনীর মধ্যে প্রবল রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় এনকাউন্টার, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নিরাপত্তাবাহিনীর অপরাধে জড়িয়ে পড়া বৈধতা পাচ্ছে, তাদের দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। যে আটজন মুসলিম ছাত্র এনকাউন্টারে মারা গেছে তারা ভারতের নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়ার (এসআইএমআই বা সিমি) সদস্য ছিলেন। উক্ত সংগঠনটি ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের বিরুদ্ধে নাশকতার মদদ দেয়ার অভিযোগ এনে ২০০১ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারতের তৎকালীন সরকার। তবে এখনো ওই সংগঠনটির কোনও সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
যাদের সন্ত্রাসবাদ বা নাশকতার সাথে জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না তাহলে তাদেরকে কোন আইনে কারাগারে রাখা হয়? এনকাউন্টারে নিহত ছাত্রদের কাছে কোনও অস্ত্র নেই তারপরও তাদের গুলী করে হত্যা করা এটা কোন ধরনের আইন? এটা কি ভারতের পুলিশ বাহিনীর তৈরি করা আইন? যা তার তাদের রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থে ব্যবহার করে? তবে যদি তাই হয় তাহলে ভারত সরকার আজ কাশ্মীরিদের সন্ত্রাসী বলার আগে কি তাদের নিজেদের অবস্থান একটু পরিষ্কার করবে? তবে কী ভারতে মুসলিমরা আজ সাম্প্রদায়িকতার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে? একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কি করে তার রাষ্ট্রে প্রমাণহীন নাশকতার জন্য একটা সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে? আর কি ভাবেই আবার সেই সংগঠনের কর্মীদের কারাগারে আটক করে রাখে?
ভারতের ভেতর-বাইরে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বারবার মিডিয়াতে অনেক প্রতিবেদন হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যা তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটা ডাল-ভাত ব্যাপার হয়ে পড়েছে। তার প্রমাণ ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের ভিতরে প্রায় ৩৫০০ টি ঘটনা। এমন আজব ইতিহাস পৃথিবীতে আর নেই।
ভারতে কথিত এনকাউন্টারে ১০ বছরে নিহত হয়েছে ১৬৫৪ জন। ভারতীয় পার্লামেন্টের নথি এবং দেশটির জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ২০০৪ থেকে ২০১৪ এই সময়ের মধ্যে এ ধরনের এনকাউন্টরে ১ হাজার ৬৫৪ জন নিহত হয়েছে। অর্থাৎ উল্লিখিত সময়ে প্রতি দুই দিনে একজন করে এনকাউন্টারে প্রাণ হারিয়েছে। ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ পর্যন্ত কোনও তথ্য পাওয়া না গেলেও লোকসভায় এক প্রশ্নোত্তরে জানা যায়, ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে কথিত এনকাউন্টারে আটজন নিহত হয়েছে।
পুলিশ হেফাজতে কারাবন্দীর এনকাউন্টারে নিহত হওয়ার মতোই পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়েছে ৪৭০ জন এবং পুলিশ নির্যাতনে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৩৫৮ জন। তবে এর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। কারণ সব অভিযোগ প্রকাশ পায় না, প্রশাসন চেপে যায় অথবা ভুক্তভোগীই তারা নিরাপত্তার স্বার্থে গোপন রাখে।
তা ছাড়া এই এনকাউন্টারে নিহতের সংখ্যার মধ্যে সেনাবাহিনী বা আধাসামরিক বাহিনীর হাতে নিহতদের সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আর জম্মু-কাশ্মির ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডগুলো কখনোই নিয়মিতভাবে সরকারি হিসাবে বা গণমাধ্যমে আসে না।  ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর হিসাব, ২০১৫ সালেই ভারত জুড়ে পুলিশের বিরুদ্ধে ৫৫ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে।
তাছাড়া ভারতের কারাগারগুলোতে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দী থাকার কারণে সেখানে আইন বহির্ভূত কর্মকান্ড ঘটার সুযোগ বেশি। জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর কারা পরিসংখান ২০১৫ অনুযায়ী, কারাকর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ৮০০ অভিযোগ করেছেন বন্দীরা। জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা এবং অন্যান্য বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার কাছে তারা এসব অভিযোগ করেন।
আমরা ভারতের কথিত এনকাউন্টারে হত্যার অতীত ইতিহাস থেকে এ কথা স্পষ্টভাবে বলতে পারি যে, অতীতের কথিত এনকাউন্টারের ইতিহাস বহির্ভূত কিছু ঘটেনি এই আট মুসলিম ছাত্রের এনকাউন্টারে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ