বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪
Online Edition

স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জন বর্ণ ক্রস ফায়ার কোন্ বর্ণ

জিবলু রহমান : [ছয়]
জনগণ তাদেরকে হাতেনাতে ধরে দিলো। আর সেই লোকটা মারা গেল! এটা জনমনে সংশয় সৃষ্টি করছে এবং অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এর মাধ্যমে মূলত বিচার প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে। বরাবরই নাগরিক সমাজ সমালোচনা করে আসছিলেন এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের। কিন্তু, তাতে কোন কাজ হয়নি। বরং, ক্রসফায়ারের হার বেড়ে যাচ্ছে। গত ১৩ দিনে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে অন্তত ১৭ জন। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, আদালত এই হত্যাকাণ্ডের জবাব চাইতে পারে। জবাব না চাইলে, এই অবস্থা চলতেই থাকবে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ‘আমার তো মনে হয় দেশে কারও কোন সন্দেহ নাই যে, পুলিশ তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে মেরে ফেলছে। বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আইনজীবী বা পরিচিত কারও উপস্থিতির বিধান রয়েছে। কিন্তু, সেই নিয়মটি মোটেও মানা হচ্ছে না। ড. শাহদীন মালিক বলেন, ২০০৪-০৫ সালে হয়তো কেউ কেউ ক্রসফায়ারের কিস্সা বিশ্বাস করতো, এখন কেউ এটা বিশ্বাস করে না। বিষয়টি নিয়ে একটি সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। বলেন, তদন্ত না হলে এ ধরনের ঘটনা চলতেই থাকবে। ফলে পুলিশের আসল অপরাধীকে ধরার যোগ্যতা কমে যাবে।’ তার এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন ছিল, কী ধরনের তদন্ত হওয়া উচিত? তিনি বলেন, একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের উচ্চপদস্থ কোন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা, একজন আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট চার-পাঁচজন সদস্যের সমন্বয়ে একটি কমিটির অধীনে তদন্ত হওয়া দরকার। ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ ঘটনাগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত হওয়া দরকার। এর পাশাপাশি সার্বিক ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সমস্যা নিয়েও একটি কমিশন হওয়া জরুরি বলে তিনি মত দেন। তিনি বলেন, আমাদের বিচার ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের দেশে যত মামলা হয়, তার অন্তত ৯০% মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, ওই সব অপরাধে ভুক্তভোগীর ক্ষতি হয়েছে। কেউ না কেউ তো অপরাধ করেছে। অথচ তাদের বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে তো খালাস পাচ্ছে ৯৮%। (সূত্র: দৈনিক মানব জমিন ২০ জুন ২০১৬)
১৯ মে ২০১৬ ভোর রাত সাড়ে ৪টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) চিকিৎসাধীন অবস্থায় কারাগারের লৌহকপাটে বন্দিত্ব আর রিমান্ডের নির্মমতার হাত থেকে অবশেষে চিরতরে মুক্তি পেলেন রাজশাহীর শিবির নেতা ২১ বছর বয়সী হাফিজুর রহমান। মরণব্যাধি থ্যালাসেমিয়া আর অত্যধিক ওজন স্বল্পতা সত্ত্বেও বর্তমান সময়ের নিষ্ঠুরতা তাকে আটকে রেখেছিলো কারান্তরালে। কিন্তু প্রিজন সেলের খাঁচা ভেঙে হাফিজুর রহমানের প্রাণপাখি উড়ে গেছে চিরতরে মহান প্রভুর দরবারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী মহানগরী শাখার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হাফিজুর রহমান। ২৩ এপ্রিল সকালে নগরীর শালবাগানে রাবি ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই মামলায় সন্দেহবশত ২৮ এপ্রিল দুপুরে গ্রেফতার করা হয় ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হাফিজুর রহমানকে। তার বাসা ছিলো হত্যাকাণ্ডের স্থান শালবাগানের পার্শ্ববর্তী ছোটবনগ্রামে। ঐদিনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। এ সময় তার গুরুতর অসুস্থতা সম্পর্কিত মেডিকেল রিপোর্ট উপস্থাপন করা হলেও রিমান্ড ঠেকানো যায়নি। পরে শুনানি শেষে আদালতের বিচারক মোকসেদা আজগর হাফিজুরকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। তাকে চারদিন ডিবি কার্যালয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। আটকের সময় ওজন দাঁড়িয়েছিলো মাত্র ৩৯ কেজি। প্রতি সপ্তাহে তাঁর শরীরে রক্ত যোগান দিতে হতো। ১৭ মে রাবি শিক্ষক রেজাউল হত্যার সঙ্গে জেএমবি জড়িত থাকার স্বীকারোক্তির বিষয় সাংবাদিকদের জানায় পুলিশ। কিন্তু সে পর্যন্ত অসুস্থ হাফিজুর ছিলেন কারাগারের বাসিন্দা।
১৬ জুন ২০১৬ রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ৯ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাসার ছয় তলা থেকে সাদা পোশাকের লোকজন পারভেজকে তুলে নিয়ে যায়। আটকের ১৫ দিন পর পুলিশ ঠাণ্ডা মাথায় গুলী করে হত্যা করে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ডের পর বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা। তারা তাৎক্ষণিকভাবে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও জেলা-উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছিল। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব খুনের প্রতিবাদ ও খুনীদের বিচারের দাবি জানিয়েছিল।
ঝিনাইদহে চলমান সংখ্যালঘু হত্যাকাণ্ডের সাথে যখন জঙ্গি নিবরাসের নাম উঠে আসছে, ঠিক তখনই পুলিশ নতুন স্বীকারোক্তি নাটক সাজাতে চাইছে। মূলত নিজেদের অপকর্ম থেকে দায়মুক্তির জন্যই এই স্বীকারোক্তির নাটক সাজাচ্ছে বলে জনগণ মনে করে। বিগত কয়েক মাসে কোন প্রকার যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ঝিনাইদহে প্রায় অনেক নিরপরাধ ছাত্র জনতাকে হত্যা করেছে। যার দায় পুলিশ কিছুতেই এড়াতে পারে না। ৩০ জুন ২০১৬ দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের উত্তরের মাঠে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছাত্রশিবিরের ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের সাবেক সভাপতি মোঃ আনিসুর রহমান (২৬) ও শিবির কর্মী শহীদ আল মাহমুদ (২৫) নিহত হন। এ সময় তিন পুলিশ সদস্য আহত অস্ত্র ও বোমা উদ্ধারের দাবি করেছিল পুলিশ।
১ জুলাই ২০১৬ শুক্রবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উত্তর কাস্টসাগরা গ্রামের রাধামদন মঠের অদূরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ঝিনাইদহ শহর ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ইবনুল ইসলাম পারভেজ (২৯) নিহত হয়। এ সময় পুলিশ কনস্টেবল আরিফ ও সামান্ত কুমার আহত এবং একটি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলী, একটি ছোরা, তিনটি রামদা ও একটি চাপাতি উদ্ধার করেছে বলে পুলিশ দাবি করে।
১৮ জুলাই ২০১৬ পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে শৈলকুপা উপজেলার ভটাই অঞ্চলের ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি সাইফুল ইসলাম ওরফে মামুন (২৫) নিহত হয়েছেন। রাত ৩টার দিকে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মধুপুর গ্রামের চারমাইল নামক স্থানে এ ঘটনাটি ঘটে। এ সময় কনস্টেবল ফয়সাল হোসেন ও সুমন হোসেন আহত এবং অস্ত্র, গুলী, পাঁচটি বোমা ও তিনটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে।
৩ জুলাই ঝিনাইদহের নিজ বাসা থেকে সাইফুল ইসলামকে আটক করে ১৬ দিন নির্যাতনের পর পুলিশ ঠাণ্ডা মাথায় গুলী করে হত্যা করে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিমত। তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করে বলেন, ছাত্রশিবির করার কারণে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক রোষানলের শিকার হয়েছে সাইফুল ইসলাম। এলাকার সাধারণ মানুষকে নামাযের পথে ডাকতো এবং কুরআন-হাদিসের শিক্ষা দিতো। যে কারণে এলাকায় সে জনপ্রিয় ও মেধাবী ছাত্রনেতা হিসাবে পরিচিত ছিল। তার জনপ্রিয়তা সহ্য করতে না পেরে সরকার পরিকল্পিকভাবে তাকে হত্যা করেছে। (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম ২০ জুলাই ২০১৬)
১২ আগস্ট সকালে উপজেলার জোড়াপুকুর এলাকা থেকে ঝিনাইদহের হরিণাকু-ুর নিখোঁজ রঘুনাথপুর ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি, রঘুনাথপুর হোসেন আলী আলিম মাদরাসার শিক্ষক ও মহিষগাড়ি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা ইদ্রিস আলী ওরফে পান্না হুজুরের (৫৬) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ ওই সময় বলেছিল-জোড়াপুকুরিয়া মাঠ এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় একজন নিহত হয়েছে এমন খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে ইদ্রিস আলীর লাশটি উদ্ধার করা হয়।  [চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ