সোমবার ২০ মে ২০২৪
Online Edition

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গোড়ার ইতিহাস

অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন : মুসলিম লীগের অবিসংবাদিত নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। মুসলিম জাতীয়তাবাদ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মূল ভিত্তি। পাকিস্তানের অংশ ছিল দুটি। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। ব্যবধান ছিল প্রায় দেড় হাজার মাইল। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী তথা বাঙালি জনগণের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকেই এর রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পরই এর ভাষা কী হবে এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে মতবিরোধ দেখা দেয়। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং দিল্লী ও আলীগড় কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীগণ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে থাকেন। ১৯৪৭ সালের ১৮ মে হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত ‘উর্দু সম্মেলনে’ এবং ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই অফিস আদালতের পাশাপাশি খাম, পোস্টকার্ড প্রভৃতি জিনিসে শুধুমাত্র ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহৃত হতে থাকে।
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদের উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের অসারতা ও অযৌক্তিকতা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে অবহিত করার জন্য জ্ঞান তাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন তৎকালীন বহুল প্রচারিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায়।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার প্রকাশিত প্রবন্ধে বলেন, “কংগ্রেসের নির্দিষ্ট হিন্দির অনুকরণে উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষারূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাদগমনই হইবে। ইংরেজি ভাষার বিরুদ্ধে একমাত্র যুক্তি এই যে, ইহা পাকিস্তান ডোমিনিয়নের কোনও প্রদেশের অধিবাসীরই মাতৃভাষা নয়। উর্দুর বিপক্ষেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন, যেমন-পুশতু, বেলুচী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা, কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই মাতৃভাষারূপে চালু নয়। যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবি বিবেচনা করা কর্তব্য।”
এই প্রবন্ধটির পর ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ১৩৫৪ সালের ১৭ই পৌষ, ‘তকবীর’ পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা সমস্যা’- নামে আরও একটি মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রকাশিত প্রবন্ধটিতে তিনি বাংলা, আরবি, উর্দু এবং ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানীদের নীতি কি হওয়া উচিত সে বিষয়ে আলোচনা করেন।
বাংলা ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে প্রত্যেক বাঙালীর জন্য প্রাথমিক শিক্ষণীয় ভাষা অবশ্যই বাংলা হইবে।... উন্মাদ ব্যতীত কেহই ইহার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করিতে পারে না। এই বাঙলাই হইবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা।’
আরবী ভাষা সম্পর্কে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অভিমত প্রকাশ করনে যে, ‘‘মাতৃভাষার পরই স্থান ধর্মভাষার, অন্তত মুসলমানদের দৃষ্টিতে।... এই জন্য আমি আমার প্রাণের সমস্ত জোর দিয়া বলিব, বাঙালার ন্যায় আমরা আরবী চাই। সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম সার্থক হইবে, যে দিন আরবী সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হইবে।... কিন্তু বর্তমানে আরবী পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি  বৈকল্পিত ভাষা ভিন্ন একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণের যথেষ্ট অন্তরায় আছে।”
উর্দু সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশের জনগণের মধ্যে যোগ স্থাপনের জন্য, যাহারা উচ্চ রাজকর্মচারী কিংবা রাজনীতিক হইবেন, তাঁদের জন্য একটি আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা শিক্ষা করা প্রয়োজন। এই ভাষা উচ্চ শিক্ষিতের জন্য ইংরেজিই আছে।... কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে ইহা চলে না। তজ্জন্য উর্দুর আবশ্যকতা আছে।... এই জন্য রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চ রাজকর্মচারী ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী প্রত্যেক নাগরিকেরই উর্দু শিক্ষা করা কর্তব্য।”
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ইংরেজিকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষারূপে চালু রাখার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। ইংরেজি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে দেখিতে চাই। তজ্জন্য ইংরেজি, ফরাসী, জার্মান, ইতালীয়ান বা রুশ ভাষাগুলির মধ্যে যে কোন একটি ভাষা আমাদের উচ্চ শিক্ষার পঠিতব্য ভাষারূপে গ্রহণ করিতে হইবে। এই সকলের মধ্যে অবশ্য আমরা ইংরেজিকে বাছিয়া লইব। ইহার কারণ দুইটি ১। ইংরেজি আমাদের উচ্চ শিক্ষিতদের নিকট সুপরিচিত ২। ইংরেজি পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রচলিত আন্তর্জাতিক ভাষা। আমি এই ইংরেজিকেই বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে বজায় রাখিত প্রস্তাব করি।’’
ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ মেধাবী অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে প্রথম থেকেই সভা- সেমিনার, আলাপ-আলোচনা, লেখালেখির মাধ্যমে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ৩ সদস্যবিশিষ্ট তমুদ্দন মজলিস’ ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন। তারা ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’- এই নামে একটি বই প্রকাশ করেন। তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রকাশিত গ্রন্থে লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। তমদ্দুন মজলিসের পক্ষে ভাষা বিষয়ক একটি প্রস্তাবনাও এ বইতে সংযোজিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাসেম এই প্রস্তাবনা রচনা করেন। তাদের লেখা বাংলা ভাষার পক্ষে মানুষকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে এবং প্রেরণা যোগায়। এর আগে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সংবলিত কোন বই প্রকাশিত হয়নি।
পুস্তিকায় ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবনায় অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, ‘‘বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা, পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে দু’টি-উর্দু ও বাংলা। বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা।... উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা। যারা পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকরি ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হবেন তারাই শুধু ও ভাষা শিক্ষা করবেন। ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫ হইতে ১০ জন শিক্ষা করলেও চলবে। ইংরেজি হবে পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা।
অধ্যাপক আবুল কাসেম রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে পুস্তিকাটির প্রস্তাবনায় আরো বলেন, “ইংরেজরা এক সময় জোর করে আমাদের ঘাড়ে ইংরেজি ভাষা চালিয়ে দিয়েছিলো। সেইভাবে কেবলমাত্র উর্দু অথবা বাংলাকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করলে পূর্বের সেই সাম্রাজ্যবাদী অযৌক্তিক নীতিরই অনুসরণ করা হবে। তিনি উল্লেখ করেন যে, কোন কোন মহলে সেই প্রচেষ্টা চলছে এবং তাকে প্রতিহত করার জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এই লেখায় সর্বশেষে তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আবুল কাসেম তৎকালীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকারের কাছে দাবি করেন যে, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে ও পাকিস্তানের প্রত্যেক ইউনিটকে সার্বভৌম ও স্বাধীনতার অধিকার দেয়া হয়েছে। কাজেই প্রত্যেক ইউনিটকে তাদের স্ব স্ব প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নির্ধারণ করার স্বাধীনতা দিতে হবে।”
‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ নামক পুস্তিকায় ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ নামক একটি মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধে বাংলা ভাষার উন্নতি ও চর্চার ক্ষেত্রে মুসলমানদের ভূমিকা উল্লেখ করে বলেন,”মোগল যুগে বিশেষ করে আরাকান রাজসভার অমাত্যগণ, বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন। মুসলমান সভাকবি দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল বাংলা কবিতা লিখে অমর কীর্তি লাভ করেছেন। ’’
ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর প্রবন্ধে আরো বলেন, পূর্ব বাংলার মুসলমানদের আড়ষ্টতার আরও দুটি কারণে ঘটেছিল। প্রথমটি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবহেলা, আর দ্বিতীয়টি ধর্মীয় ভাষায় সম্পর্কিত মনে করে উর্দু ভাষার প্রতি অহেতুক আকর্ষণ বা মোহ। তিনি বলেন, আমি উর্দু ভাষাকে নিন্দা বা অশ্রদ্ধা করি না, কিন্তু বাঙালী মুসলমানদের উর্দুর মোহকে সত্যসত্যই মারাত্মক মনে করি। যখন দেখি উর্দু ভাষায় একটি অশ্লীল প্রেমের গান শুনেও বাঙালী সাধারণ ভদ্রলোক আল্লাহ্র মহিমা বর্ণিত হচ্ছে মনে করে মাতোয়ারা, অথবা বাংলা ভাষায় রচিত উৎকৃষ্ট ব্রহ্মসংগীত ও হারাম বলে নিন্দিত, তখনই বুঝি এই সব অবোধ ভক্তি বা অবোধ নিন্দার প্রকৃত মূল্য কিছুই নাই। এতদিন মুসলমান কেবল হিন্দুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিশ্চিত আরামে বসে বলেছে যে, হিন্দুরা বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানীভাবে ভরে দিয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে তা চলবে না। এখানে ইসলামী নীতি পরিবেশন করার দায়িত্ব মুখ্যত মুসলমান সাহিত্যিকদের বহন করতে হবে। তাই আজ সময় এসেছে, মুসলমান বিদ্বজ্জন পুঁথি-সাহিত্যের স্থলবর্তী বাংলা সুসাহিত্য সৃষ্টি করে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে দেশবাসীর পরিচয় স্থাপন করবেন। মাতৃভাষা সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ হবে এবং ইসলামী ভাবধারা যথার্থভাবে জনসাধারণের প্রাণের সামগ্রী হবে তাদের দৈন্য ও হীনতাবোধ দূর করবে। উর্দুর দুয়ারে ধর্না দিয়ে আমাদের কোনকালেই যথার্থ লাভ হবে না বলে ডক্টর মোতাহার হোসেন মন্তব্য করেন।
তৎকালীন শাসনকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, উর্দুকে শ্রেষ্ঠ ভাষা বা বনিয়াদী ভাষা বলে চালাবার চেষ্টার মধ্যে যে অহমিকা প্রচ্ছন্ন আছে তা আর চলবে না।... বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধুমায়িত অসন্তোষ বেশিদিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব - পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।’
‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ?’ পুস্তিকাটিতে কলিকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদের’ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ ‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক ছোট প্রবন্ধে বলেন,
‘‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারী চাকরীর ‘অযোগ্য’ বনিয়া যাইবেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফরাসীর যায়গায় ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা করিয়া বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি অশিক্ষিত ও সরকারী কাজের অযোগ্য করিয়াছিল।”
রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, ডক্টর এনামুল হক, আবুল কালাম সামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, অধ্যাপক আবুল কাশেমের মতো মুসলিম প-িত ও মনীষীদের ক্ষুরধার লেখনী এবং তমদ্দুন মজলিসের সাংগঠনিক তৎপরতা শিক্ষিত সচেতন ও সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারা উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি জানান এবং ভাষা আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করেন। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকা- বাংলা ভাষার আন্দোলনকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব বুদ্ধিজীবীদের তৎপরতায় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সংগঠিত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করেন। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বক্তব্য রাখেন হাবিবুল্লা বাহার, কবি জসীম উদ্দীন, কাজী মোতাহার হোসেন, সৈয়দ মুহাম্মদ আফজাল ও অধ্যাপক আবুল কাসেম। তমদ্দুন মজলিস ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এ সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নির্বাচিত হন নূরুল হক ভূঁইয়া।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচীতে পাকিস্তান সরকারের এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ৬ ডিসেম্বর বেলা দুইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের নিয়ে এক বিরাট যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেম। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত এই সভাই হলো সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্র সভা। এ সভার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্ররা বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করেন। ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল সেক্রেটারিয়েট ভবন, প্রাদেশিক মন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবন, হামিদুল হক চৌধুরীর বাসভবন এবং সেখান থেকে মিছিল নিয়ে ছাত্ররা প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে উপস্থিত হন এবং তাদের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো দাবি জানান।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লেয়াকত আলী খান ও পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় তা নাকচ হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ‘রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সারের ৪ জানুয়ারি সমগ্র পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বপ্রথম ‘হরতাল’ পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রস্তাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন শামসুল হক। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব অগ্রাহ্য হওয়ায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকা শহরে ছাত্রসমাজ রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালন করে। ঐ দিন ঢাকায় বহু ছাত্র আহত ও গ্রেফতার হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৩ মার্চ পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এই ধর্মঘট ১৫ মার্চ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। দেশের জেলা শহরগুলোতেও সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। এ নাজুক অবস্থার প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ জরুরি ভিত্তিতে আলোচনায় বসেন এবং একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এ চুক্তিতে আটক ছাত্রদের মুক্তিদান, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আইন পরিষদের উত্থাপন, পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত, ১৪৪ ধারাসহ সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সফরে আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’- অপর কোন ভাষা নয়। ২৪ মার্চ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি আবারো জোর দিয়ে বলেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা’। জিন্নাহ্’র ওই ঘোষণায় উপস্থিত ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং না না না বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। জিন্নাহর এ ঘোষণায় ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ঐদিনই রাষ্ট্রভাষা পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে একটি স্মারক লিপি প্রদান করেন।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। নাজিমুদ্দীনের ঘোষণায় পূর্ব বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এর প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে সর্বদলীয় কর্মী সমাবেশে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কার্যকরী পরিষদ গঠিত হয়। এই সভায় ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সারা দেশে হরতাল পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল ও সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ এর প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে। তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের জীবন বাজি রেখে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে নেমে পড়ে। হাজার হাজার ছাত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানে ঢাকা মুখরিত হয়ে উঠে। এ সময় শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ এবং নির্বিচারে গুলী চালায়। পুলিশের গুলীতে নিহত হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, আব্দুল আউয়ালসহ অনেকে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
পরিশেষে ছাত্র-জনতার ভাষা আন্দোলনের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষ পায় গৌরবময় স্বাধীনতা।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তারাগঞ্জ কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ