রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

ইতিহাস ঐতিহ্যে রাজধানী গাবতলীর ‘পশুর হাট’

মুহাম্মাদ আখতারুজজ্জামান : দেখতে দেখতে চলে আসছে মুসলিম উম্মাহর অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহা আসে ত্যাগের মহান বার্তা নিয়ে। জাগতিক লোভ-লালসা ত্যাগ করে আল্লাহর দরবারে পশু কোরবানি করা এ ঈদের প্রধান কাজ। পশু কোরবানি করতে হয় বলে এই ঈদ কোরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশ উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। পশুর হাটগুলোয় ধুম পড়ে যায় বেচাকেনার। স্থায়ী পশুর হাট ছাড়াও দেশের নানান জায়গায় গড়ে ওঠে অস্থায়ী হাট। এসব হাটে বিক্রেতারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে গরু নিয়ে আসেন, ক্রেতারাও কিনতে পারেন তার পছন্দের গরুটি। রাজধানীর সবচেয়ে বড় এবং ঐতিহ্যবাহী হাট হলো গাবতলী গরুর হাট।
গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের কাছেই বসে এ হাটটি। গাবতলী হাটে অনেক গরু ওঠে বলে ক্রেতারা এখান থেকে গরু কিনতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। গাবতলী হাট গরুর একটি স্থায়ী হাট, সারা বছরই এখানে গরু বেচাকেনা চলে। গাবতলীর মতো স্থায়ী হাট ছাড়াও এ সময় রাজধানীতে গড়ে ওঠে অনেক মৌসুমি হাট।
এসব হাট মূলত কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এসব হাটের মধ্যে রয়েছে আগারগাঁও তালতলা গরুর হাট, মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিং গরুর হাট, উত্তরার আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, হাজারীবাগ গরুর হাট, পুরান ঢাকায় ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব মাঠ ও পোস্তগোলা গরুর হাট। ঢাকা মহানগরে গাবতলীর মতো সাভারের নয়ারহাট একটি ঐতিহ্যবাহী গরুর হাট। এ ছাড়া নবাবগঞ্জ, দোহার ও কেরানীগঞ্জে বসে গরুর বেশকিছু হাট।  গাবতলীর ইতিহাস: ব্রিটিশ আমলে বর্তমান ঢাকার (জাহাঙ্গীর নগর) মোকিমাবাদ পরগনার জমিদার ছিলেন হাজী মুন্সি লাল মিয়া সাহেব। তিনি ঢাকার মিরপুরের মাজার রোড এলাকাতে বসবাস করতেন। তিনি একজন সমাজ সেবক, ধার্মিক ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। ১৯১৭ সালে তিনি মাজার রোডে দুধ মেহের দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং সম-সাময়িক সময়েই তিনি এখানে একটি হাট বসিয়েছিলেন। তখন সপ্তাহে একদিন হাট বসতো এবং এই এলাকা সহ আশ-পাশের এলাকার লোকজন পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে এই হাটে এসে বেচাকেনা করতো। তখন এই হাটটি ছিল তুরাগ নদীর পাড়ে বর্তমান মাজার রোডে অবস্থিত। তৎকালীন সময়েও তুরাগ নদী ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নদীকে কেন্দ্র করে নদীর পাড় ধরে একটু উঁচু এলাকাতে মানুষের বসবাস বেশি ছিল। আর তুরাগ নদীর পাড়ে এই হাটটি অবস্থিত হওয়ার কারণে দিন দিন এটি বেশ জম-জমাট হয়ে উঠতে শুরু করে। সে সময়ে এখানে জমিদারের একটি বাগান ছিল, আর এই বাগানে বিশাল-বিশাল আকারের আম,কাঁঠাল ও গাবগাছ ছিল। বিশেষ করে, হাটের ভেতরে ও হাটের পাশে বিশাল আকারের বিপুল সংখ্যক গাবগাছ থাকার কারণে এটি গাবতলীর হাট নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৩১ সালে জমিদার মুন্সি লাল মিয়া মাজার রোডে এখানকার মোট ৩১ একর জমি ওয়াকফ করে দিয়ে যান। এই ওয়াকফ এস্টেটের মধ্যে গাবতলীহাট, দুধ মেহের দাতব্য চিকিৎসালয়,তিনটি মসজিদ, একটি মাদ্রাসা, একটি প্রাইমারি স্কুল (মুন্সি লাল মিয়া প্রাইমারি স্কুল), একটি ঈদগাহ মাঠ, একটি বড় কবর স্থান (সাধারন মানুষের জন্য) এবং একটি পারিবারিক কবর স্থান প্রতিষ্ঠা করে যান। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় জমিদার সাহেবের নাতি জাহাঙ্গীর আলম বাবলা জানিয়েছিলেন, ওয়াকফ এস্টেটের চুক্তিনামা অনুযায়ী এই জমি থেকে আয়ের টাকা দিয়ে উল্লেখিত সকল প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ খরচ বহন করার পর যে টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে সেই টাকা জমিদারের আওলাদগণ ভোগ করতে পারবেন। তবে এই জমি কখনোই জমিদারের আওলাদগণ বিক্রি করতে পারবেননা। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এই হাটে গবাদি পশু বেচা-কেনা হতো। কালের পরিক্রমায় এই হাটটি দিন দিন আরো বেশি পরিচিতি লাভ করতে থাকে। এমনকি গাবতলী গরুর হাট হিসেবে এর পরিচিতি আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। তুরাগ নদীর পাড়ে এ হাটকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় গরু/মহিষ ও ঘোড়ার গাড়ী চলার প্রচলন ছিল। এখানে নৌকা ঘাট ছিল এবং পরবর্তী সময়ে এখানে বাস স্টেশন তৈরি হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ রুটের এই সড়ক নির্মিত হয়েছিল। গাবতলী হাটকে কেন্দ্র করে তখন এখানে(মাজার রোডে একটি বাস স্টেশন/টার্মিনাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর ১৯৫৪ সালে এটি গাবতলী হাট এর পাশাপাশি গাবতলী বাস স্টেশন হিসেবেও পরিচিতি পায়।
গাবতলী পশুর হাট : ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত পুরাতন গাবতলীতে (মাজার রোড) ছিল পশুর হাট। আর ১৯৮২ সালে পুরাতন গাবতলী পশুর হাটকে সাভারের ফুলবাড়িতে শিফট করা হয়। তখন ফুলবাড়ি এলাকার প্রভাবশালী কবির সাহের তার নিজের জায়গার উপরে পশুর হাটটি বসতে দিয়েছিলেন। এদিকে গাবতলী থেকে পশুর হাট চলে যাওয়ার কারণে এই এলাকার এক শ্রেণীর লোকের (যারা পশুর হাটের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল) আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। তখন এই এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি জনাব, লাল মিয়া ফকির (ডিপজল সাহেবের নানা) এর নেতৃত্বে স্থানীয় অন্যান্য ব্যক্তি বর্গকে সাথে নিয়ে পুনরায় এখানে গাবতলী পশুর হাট বসিয়েছিলেন। মাত্র ৫/৬ মাস সাভারের ফুলবাড়িতে পশুর হাট ছিল। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন টেন্ডারের মাধ্যমে ইয়ারলি গাবতলী পশুর হাটকে ইজারা দিয়ে থাকেন। এই পুশুর হাট থেকে প্রতি বছর সরকারের রাজস্ব খাতে কোটি কোটি টাকা জমা হয়। রাত দিন ২৪ ঘন্টা এই হাটে গবাদি পশু বেচাকেনা হয়ে থাকে। একটি সাধারন দিনে গড়ে ২০০০-৩০০০ গবাদি পশু এই হাটে বেচাকেনা হয়ে থাকে।
আর কোরবানীর ঈদসহ বিভিন্ন উৎসব পার্বণে এই হাট থেকে লক্ষ লক্ষ গবাদি পশু বেচাকেনা হয়ে থাকে।
বংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হাটে গবাদি পশুকে বেচাকেনার জন্য আনা হয়। এই হাট থেকে একজন ক্রেতা কোন পশু ক্রয় করলে তাকে ক্রয় মূল্যের উপর প্রতি হাজারে ৩৫ টাকা হারে হাসিল দিতে হয়।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে মাজার রোডের ঐ ওয়াকফ স্টেটের মধ্যে অবস্থিত গাবতলী গরুর হাটটি থেকে সরকার রাজস্ব/খাজনা আদায় করা শুরু করে। এরপর পেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এই স্টেটের কিছু জমি সরকারের যুব কমপ্লেস অধীনে নিয়ে যায়। অবশেষে ১৯৮৪ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেব মাজার রোডের এই পুরাতন গাবতলী স্টেশনকে সামান্য একটু পশ্চিম দিকে সরিয়ে নিয়ে বাগবাড়ী নামক জায়গাতে নতুন বাস টার্মিনাল তৈরি করেন। এটিই বর্তমানে গাবতলী বাস টার্মিনাল হিসেবে পরিচিত।
এই এলাকার মুরুব্বীরা এখনো মাজার রোডকে পুরাতন গাবতলী হিসেবে সম্ভোধন করে থাকেন। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদ ঢাকার বিখ্যাত ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালকে ভেঙ্গে দিয়ে ঢাকার ৩ টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ৩ টি বাস টার্মিনাল তৈরি করেন। যথা (১) গাবতলী বাস টার্মিনাল (২)মহাখালী বাস টার্মিনাল (৩) সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল।
এই টার্মিনাল ৩ টি তৈরি হওয়ার ফলে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন তথা সরকারের রাজস্ব খাতে বড় অংকের টাকা জমা হতে থাকে। এক কথায় বলতে গেলে, তিনটি বিখ্যাত কারণে গাবতলী সেরা এবং দেশ ও বিদেশের কাছে যথেষ্ট পরিমানে সুনাম অর্জন করেছে। এই বিখ্যাত/ সেরা হওয়ার ৩ টি বিষয় হলো- ১.গাবতলী বাস টার্মিনাল, ২.গাবতলী গরুর হাট, ৩. ইমারত/অবকাঠামো তৈরির সরঞ্জামাদি ক্রয়-বিক্রয়ের গদিঘর। চলবে..

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ