রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক জনপদ চুয়াডাঙ্গা

চুয়াডাঙ্গা জেলায় দর্শনীয় স্থান তেমন না থাকায় জেলাটি রয়েছে অনেক পিছিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। যুদ্ধকালীন সময়ে দেশের প্রথম রাজধানী ঘোষণা করা হয় এ জেলাকে। ইতিহাস ঐতিহ্য মন্ডিত এ জেলাটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসেবে তেমন গড়ে উঠেনি। জেলাতে নানা যুগের ১০৪টি প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব জরিপে তা উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। আর সেটা করতে পারলে চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস যেমন হবে পুনর্গঠন, তেমনি আর্থসামাজিক উন্নয়নে সৃষ্টি হবে নতুন দিগন্ত।
ইংরেজ শাসন আমলে দেশের বিভিন্ন জেলায় জরিপ চালিয়ে ঐতিহাসিক স্থান এবং নিদর্শন চিহ্নিত করা হলেও সে জরিপ থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলার নাম বাদ পড়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রাকৃতিক নিদর্শন উদ্ধারে তেমন কেউ উদ্যোগ গ্রহণ না করলেও বর্তমান সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বাদপড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় জরিপের কাজ শুরু করে। তারই আলোকে ইতিহাস সমৃদ্ধ চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রতœতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কারে জরিপ শুরু হয়। প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে-দর্শনা ডিস্টিলারী হাউজ, কেরু অ্যান্ড কোং, রেস্টহাউস, হিরোম-লের পুকুর ও বাগানবাড়ি, পুরাতন হাউলি দোয়া, ম-লবাড়ি বাস্তুপুর, কার্পাসডাঙ্গা নীলকুঠি, আটচালা ঘর ও নদীর ঘাট (নজরুল স্মৃতিবিজড়িত), নাটুদা আটকবর, গচিয়াপাড়া হাজার দুয়ারী স্কুল, নাটুদা জোড়া শিবমন্দির, দর্শনা হল্টস্টেশন, কার্পাসডাঙ্গা মিশন, ডিসি ইকোপার্ক, শিবনগর জামে মসজিদ, গোলাম মোস্তফা (ঘটু মোল্লা) বাড়ি, রাম বাবুর বাড়ি, রেজা চিশতি (র.) মাজার, মধু জমিদারের পুকুর (জলাধার), জুড়ানপুর মমালিতা ভবন, ভালাইপুর নীলকুঠি, লোকনাথপুর নীলকুঠি, হোসেন মঞ্জিল, কার্পাসডাঙ্গা প্রাচীন গির্জা, খ্রিস্টান পাদ্রীর কবর, কার্পাসডাঙ্গা নীলকুঠির প্রবেশ তোরণ, দর্শনা রেলস্টেশন, কুঁকিয়া চাঁদপুর নীলকুঠি (বিলুপ্ত), উক্ত পুরাতন জামে মসজিদ, হযরত কিতাব আলী শাহ মাজার, কমলার দোয়া, চুয়াডাঙ্গা প্রধান ডাকঘর, জীবননগর সেন মন্দির, ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কুড়ুলগাছি পীরগঞ্জ জামে মসজিদ, মোমিনপুর বোয়ালমারী পুরাতন জামে মসজিদ, বোয়ালমারী জমিদার বাড়ি, ভিমরুল্লাহ পুরাতন জামে মসজিদ, জীবননগর কাশীপুর জমিদার বাড়ি, সাগরমনী দেবীর বাড়ি, হীরালাল দত্তের বাড়ি, তিতুদহ মিয়াপাড়া জামে মসজিদ, সিরাজ মঞ্জিল, জেলা আইনজীবী সমিতি ভবন, কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক, শহীদ-উর-রহমানের বাড়ি, সাব রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, জীবননগর সপ্তম অ্যাডওয়ার্ডের পাতকুয়া, বটকৃষ্ণ ইন্দ্র কুমারের বাড়ি (শহীদুল ইসলামের বাড়ি), প্রাচীন লোহারপুল, খন্দকার বাশার মোল্লার বাড়ির ঢিবি, আলমডাঙ্গা দোবে জমিদারদের কাচারী ও তহশিলখানা সনাতনপুর, জমিদার বিজয় কুমার দোবের বাড়ি, দোবে জমিদার বাড়ির মন্দির, ঘোলদাড়ি নীলকুঠি, কামিনী ফকিরানীর বাস্তুভিটা, জামজামি শাহী জামে মসজিদ (বিলুপ্ত), কাজী গোলাম দরবেশের কাচারী বাড়ি (মসজিদ সংলগ্ন), জামজামি ঈদগা ধ্বংসাবশেষ, ঘোষবিলা (ধুলিয়া) নীলকুঠি, মতিলাল আগারওয়াল বাড়ি, আলমডাঙ্গা কুমারী সাহা জমিদার বাড়ি, সাহা জমিদার বাড়ির প্রাচীন পাতকুয়া, কুমারী কালী মন্দির, লালব্রিজ (রেলসেতু), আলমডাঙ্গা দোতালা রেলস্টেশন, হযরত বিনোদিয়া (র.) মাজার, শ্রী শ্রী সত্য নারায়ণ মন্দির, চুয়াডাঙ্গা পৌর বড় মসজিদ, ধোপাখালী পুরাতন মসজিদ, জীবননগর রাখাল শাহ মাজার, চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশন, সুভাষিনী দাসের বাড়ি, মতিরাম আগরওয়ালার বাড়ি, দামুড়হুদা বেগুপাড়া মসজিদ, কার্পাসডাঙ্গার কুতুবপুর মসজিদ, হযরত মেহমান শাহ মাজার ও তৎসংলগ্ন ঢিবি, পীর বুড়া দেওয়ানের দরগাহ, জীবননগর আন্দুলবাড়িয়া অজ্ঞাত ইমারত, হযরত মানিক পীরের মাজার, খাজা পারেশ সাহেবের মাজার, চুয়াডাঙ্গা সদর বড়সলুয়া মহিশতলা মসজিদ ঢিবি, কালুপোল রাজার ভিটা, গড়াইটুপি হযরত মল্লিক শাহ মাজার, মুজিবনগর বাগোয়ান শেখ ফরিদের মাজার, বাগোয়ান শাহী জামে মসজিদ, আলমডাঙ্গা ঘোষবিলা হযরত শাহনূর (বাঘী দেওয়ান) বাগদাদী (র.) এর মাজার, ঘোষবিলা প্রাচীন মসজিদ (বিলুপ্ত)।দেশ বিভাগের পূর্বে চুয়াডাঙ্গা জেলা পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার অন্তর্গত ছিলো। পূর্বে এটি বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত ছিলো। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে নদীয়া জেলার অন্তর্গত কুষ্টিয়া জেলার জন্ম হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে চুয়াডাঙ্গা স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে মানচিত্রে জায়গা পায়। চুয়াডাঙ্গা আয়তনে ৫৪তম বৃহত্তর জেলা। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে সর্বপ্রথম চুয়াডাঙ্গাকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী ঘোষণা করা হয়। নিরাপত্তা এবং কৌশলগত কারণে পরবর্তীতে চুয়াডাঙ্গা থেকে রাজধানী মেহেরপুরের মুজিবনগরে সরিয়ে নেয়া হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে জেলায় পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় শতাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধকালীন গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের পেছনে, দামুড়হুদার নাটুদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে তিনটি গণকবর, হৈবতপুরে, জীবননগরে সীমান্তবর্তী ধোপাখালী গ্রামে এবং আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ ক্যানালের তীরবর্তী স্থানে যুদ্ধের স্মৃতিধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতিস্তম্ভ। জেলায় রয়েছে- নবগঙ্গা নদী, চিত্রা নদী, ভৈরব নদ, কুমার নদ, মাথাভাঙ্গা নদী। যদিও কালের আবর্তে সবগুলো নদী আজ মৃত প্রায়। দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আছে জীবননগরের দত্তনগর কৃষিখামার, দামুড়হুদার নাটুদহের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর, দর্শনা কেরুজ চিনিকল, ডিস্টিলারি কারখানা, হাজার
দুয়ারি স্কুল, কার্পাসডাঙ্গার নীলকুঠি, আলমডাঙ্গার ঘোলদাড়ি ওমর শাহর মসজিদ, তিয়রবিলা বাদশাহী মসজিদ, চুয়াডাঙ্গা সদরের গড়াইটুপিতে সাধক হযরত খাজা মালিক উল গাউস (র.) মাজার, চারুলিয়ার মেহমান শাহরের মাজার, জমিদার নফর পালের প্রাকৃতিক শোভাবর্ধনকারী তালসারি সড়কসহ বিভিন্ন স্থান। চুয়াডাঙ্গার ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ১০৪টি নিদর্শনের মধ্যে ২টি স্থানকে চিহ্নিত করে খননের কাজ শুরু করেছে। তার মধ্যে রয়েছে- দামুড়হুদার চারুলিয়া মেহমান শাহর মাজার সংলগ্ন ঢিবি এবং চুয়াডাঙ্গা সদরের কালুপোল গন্ধর্প রায়ের রাজার ভিটা। রাজার ভিটা এবং চারুলিয়া ঢিবি খনন করে বেশকিছু প্রাচীন পুরাকীর্তি  পাওয়া গেছে। তার মধ্যে আছে ধুপচি, লোহার তৈরি বল্মম, মাটির হাড়ি, সারা, কড়ি, পশুর হাড়, হরিণের শিং, মাটির তৈরি পুতুল, প্রদীপ, সানকিসহ নতুন অনেক কিছু। খননের কাজ শেষ হলে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র ও জাদুঘর। যা দেখতে প্রতিদিন দেশ ও বিদেশের পর্যটকরা ভিড় জমাবে জেলায়। আর অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে সরকারসহ জেলার মানুষ। উল্লেখ্য,তৎকালীন দক্ষিণবঙ্গের ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য আসেন হযরত খানজাহান আলী (র.)। তিনি ছিলেন একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক এবং বাংলাদেশের বাগেরহাটের স্থানীয় শাসক। ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে খানজাহান আলী প্রায় লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারে দিল্লি থেকে বঙ্গে যাত্রা শুরু করেন। ধারণা করা হয় ভৈরব নদী পথে ধরে তিনি খুলনা বাগেরহাটে পৌঁছানোর পূর্বে চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন জায়গায় যাত্রাবিরতি করেন। আর যেখানেই বিরতি নিয়েছেন সেখানেই গড়ে তুলেছেন প্রাসাদ, মসজিদ, মক্তব, খনন করেছেন পুকুরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। স্থান ত্যাগ করার সময় সেখানে রেখে গেছেন অনুসারীদের। যার কারণে চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন জায়গায় যে সমস্ত নিদর্শন প্রত্নতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করছেন তাতে অনেকাংশে হুবহু মিল রয়েছে। তারা জানিয়েছেন, নিদর্শনের চারপাশে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা সাংস্কৃতিক জঞ্জাল, পাতলা টালি ইটের ভগ্নাংশ, কারুকার্য খচিত ইট, চুন সুরকির নমুনা থেকে অনুমান করা যায় ঢিবির নিচে সুলতানি আমলের প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন লুকিয়ে আছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ