শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

জ্ঞানসাগরের বাতিঘর এবনে গোলাম সামাদ

আহমদ মতিউর রহমান

আকস্মিকভাবেই চলে গেলেন জ্ঞান সাগরের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত এবনে গোলাম সামাদ। তার লেখায় তার কলামে ছড়িয়ে থাকতো নানা তথ্য ও তত্ত্ব। যা অনেকেরই হয়তো ছিল অজানা। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী । প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায়ই চলে গেলেন এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। আমার ধারণা তার অভাব কোনভাবেই পূরণ হবে না। তিনি একাধিক সংবাদপত্রে জ্ঞানগর্ভ কলাম লিখতেন তা আর কারো পক্ষে লেখা সম্ভব কিনা জানি না। রোববার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি ইন্তিকাল করেন। পরিণত বয়সেই তার মৃত্যু হয়েছে। 

এবনে গোলাম সামাদের জন্ম ১৯২৯ সালে  রাজশাহীতে। তিনি সেখানেই বেড়ে উঠেছেন। রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকার তেজগাঁও কৃষি ইনস্টিটিউট থেকে কৃষিবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে প্রথমে বিলেত ও পরে ফ্রান্সে যান উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার জন্য। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন।  বিদেশে লেখাপড়া করতে গেলেও  কিন্তু সেখানে থাকেন নি, ১৯৬৩ তে দেশে ফিরে আসেন।  ১৯৬৫ সালে অধ্যাপনায় যোগ দেন রাজশাহী ভার্সিটিতে। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বা উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের প্রফেসর। তিনি এই বিষয়ে অনেক অসাধারণ বই লিখেছেন। এবনে গোলাম সামাদ উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও বিভিন্ন বিষয়ে বহুমাত্রিক লেখার জন্য ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন। প্রকাশিত হয়েছে তার অন্তত ২১ টি বই। প্রতি সপ্তাহে তার লেখা কলাম প্রকাশিত হওয়ার পর বোঝা যেত মানুষ তার লেখা কত আগ্রহভরে ও গুরুত্বের সাথে পড়তেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় যান এবং প্রবাসী সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সহায়তা করেন, কাজ করেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায়। 

তার বিভিন্ন  লেখায় অপরিসীম জ্ঞান আর প্রখর বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক ছিল। কোন কোন লেখায় আবার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতেও দেখেছি। কিন্তু তাই বলে তিনি মেপে কথা বলতেন না, যা বলা প্রয়োজন মনে করতেন তাই বলতেন। একটা ঘটনা বলতে হয়। হিলারী ও ট্রাম্পের নির্বাচনকালে তিনি অনেক আগেই বলেছিলেন ট্রাম্পই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন, হিলারী জিততে পারবেন না। তিনি এ কারণও বিশ্লেষণ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তার ভক্ত পাঠকরা মনে হয় ইলেকট্রিকের শক খেলেন। বাংলাদেশের মানুষতো বটেই বিভিন্ন দেশের ভাষ্যকার বিশ্লেষকরা হিলারীর আসন্ন বিজয় দেখতে পেয়ে যেন ফুলের তোড়া নিয়ে প্রস্তুত এমন অবস্থা। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের আগ্রহটা ছিল অন্য কারণে, সেটা নাই বললাম। কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা গেল এবনে গোলাম সামাদই সঠিক। বিশ্ব স্তম্ভিত হলো। চার বছর ট্রাম্পের নানা পাগলামি বিশ্বকে দেখতে হয়েছে। এখন যে তালেবান আফগান্তিানে বিদেশী আধিপত্যের অবসান ঘটিয়েছে সেই তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তিও ছিল ট্রাম্প জামানার কাজ। বাইডেন জামানায় বাকিটুকো সমাধা করে মার্কিন সেনারা সবার অজ্ঞাতে ২০ বছর আগে ‘দখল’ করা আফগানিস্তান ছেড়ে গেছে। 

যাক আবার মূল বিষয়ে ফিরি। দীর্ঘদিন থেকেই প্রফেসর সামাদ বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মাঝখানে করোনায় আক্রান্ত হলেও পরে করোনামুক্ত হন।  হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার  উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে  বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কাছে দাবি করা হলেও তার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাকে বীর লেখার হুকুম জারি হলো বটে কিন্তু একজন প্রবীণ ‘বীর’ মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষায় কিছুই করা হলো না, প্রশাসন বা প্রজাতন্ত্র তার প্রতি বীরত্ব সূচক আচরণ করতে পারলো না কেন জানি না। 

আমি কলেজ জীবনে বোটানির উপর সুন্দর একটি বই পেয়ে সেটি কিনি। চারপাশের গাছ নিয়ে, এসবের নানা গুণাগুণ নিয়ে লেখা ছিল বইটি। বইটির নাম মনে নেই, বইয়ের লেখক এবনে গোলাম সামাদ। তখন থেকে মাথায় নামটি ঢুকে যায়। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই তাকে বোঝার জন্য। আমার ছোট মেয়ের রাজশাহী ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে সপ্তাহ খানেক সেখানে ছিলাম। বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন ডেটে পরীক্ষা, তাই না থেকে উপায় নেই। একদিন বিকেলে গেলাম ইনকিলাবের রাজশাহী ব্যুরো অফিসে। ব্যুরো চীফ রাজশাহীর নামকরা সাংবাদিক রেজাউল করিম রাজু ভাই আমাদের পেয়ে খুব খুশি হলেন। দেখলাম সেখানে এক বৃদ্ধ বসে লিখছেন। উনিই প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ। লেখার ফাঁকে সালাম দিলাম, তার লেখা বই ও কলামের ভক্ত পাঠক জেনে তিনি খুশি হলেন। মেয়ের কথা জানতে চাইলেন। বললেন : তাহলে একটু টেস্ট নেই, কেমন ছাত্রী। আমার মেয়ে তার নাতনির বয়সী, দেখলাম আলাপ জমেছে ভালই। আমি একটু বাইরে বেরুলাম, ওরা নিজেদের মতো করে আলাপ করুক। ফিরে আসতেই স্যার বললেন, আপনার মেয়ে তো বেশ জানে। কোন প্রশ্নেই আটকাতে পারিনি। আমি বললাম, স্যার আমাকে তুমি বলুন। শেষে তিনি রাজি হলেন। মেয়ে বললো, স্যারের সাথে ছবি তুলবো। সাথে আগেকার দিনের ক্যামেরা ছিল , ফিল্মও লোড করা ছিল। তুললাম ছবি। স্যার জানতে চাইলেন: বোটানিতে পড়বে? তাহলে চেষ্টা করতে পারি। বললাম দেখেন না স্যার। কি করে বলি, আসলে মেয়ে বোটানিতে পড়বে না। ঢাকার ইডেন কলেজে কয়েক মাস প্রাণিবিদ্যা পড়েছে, ভাল না লাগায় সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে রাজশাহীতে ভর্তি পরীক্ষা দেয়াচ্ছি। কয়েক দিনই কথা বলেছি ওনার লেখার ফাঁকে। জেনেছি অনেক জ্ঞানগর্ভ বিষয়। তবে খুব বেশি কথা বলতেন না তিনি, একটা গুরুগম্বীর ভাব ওনার মাঝে ছিল। বলতে গেলে কয়েক দিনে আমাদের সঙ্গে একটা অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়েছিল, তাই কথা বলতেন আমাদের সাথে। এই হলো এবনে গোলাম সামাদ সাহেবের সাথে আমার স্মৃতি। এর পর আর দেখা হয়নি। তার দেখা পেুাম পত্রিকার পাতায়। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছেন। 

এবনে গোলাম সামাদ বিরল প্রতিভার অধিকারী একজন অনন্য লেখক ও কলামিস্ট ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। বিজ্ঞান তিনি শিখেছেন ও শিখিয়েছেন পদ্ধতিগতভাবে। তার একটি বৈজ্ঞানিক মানস ও স্বকীয় চিন্তারীতি গড়ে উঠেছিল। এই বিষয়ে তার সমৃদ্ধ ইউরোপীয় উচ্চশিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা ছিল আর সেটাই কাজে দিয়েছে। তিনি লিখেছেন : ‘‘আমি ছিলাম, ঐ যাকে সাধারণভাবে বলে অভিজ্ঞতাবাদী (Empiricist)। সবকিছু যুক্তি দিয়ে প্রমাণিত হয় না। কেউ যদি বলে, রাজশাহীর বাজারে ১৪০ রকম আম বিক্রি হয়, তবে তার কথাটা সত্য কি না, সেটা জানবার জন্য যেতে হবে রাজশাহীর বাজারে। বিশুদ্ধ যুক্তি দিয়ে এটার সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না।’’

তিনি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণমূলক অভিজ্ঞতাকে সবচাইতে গুরুত্ব দিতেন। আর এখানেই নিহিত  তার নৈর্ব্যক্তিক, নির্মোহ, বস্তুনিষ্ঠ এবং ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক মানসের উৎস। তার আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল যা তার লেখার পরতে পরতে দৃশ্যমান ছিল। এদেশের গণমাধ্যমে ও বুদ্ধিবৃত্তির বলয়ে বহুল প্রচলিত যেসব ভাষ্য, তথ্য বা  বয়ান যা-ই বলি না কেন তা পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ব করছিল,  তিনি সেগুলোকে তার জ্ঞান ও বিচার-বিশ্লেষণ দিয়ে যাচাই বাছাই করে নিতেন, ঢালাওভাবে সেগুলোকে গ্রহণ করতেন না। তিনি এমন কোন দল বা পক্ষ অবলম্বন করেননি, যেখানে তথ্য ও সত্যের চাইতে রঙ মাখানো প্রচার-প্রপাগা-াই মুখ্য ছিল। এ কারণে তাকে এদেশে বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত তথ্যাদি বা বয়ানগুলোর পক্ষাবলম্বন অথবা সেগুলো পুনর্লিখন করতে দেখা যায়নি। বরং তিনি নির্মোহভাবে তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে প্রতিটি বিষয়কে দেখতে, বুঝতে ও বোঝাতে চেয়েছেন। তার এসব লেখা আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। তার রূহের মাগফেরাত করছি। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ