আব্দুল্লাহ : উপন্যাসের বাস্তবতা ও বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান পর্ব
ইনামুল করিম
[ছয়]
ইসলাম ধর্মে এই ভাতিভেদ প্রথার অনুপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বর্ণপ্রথার অনুকরণে মুসলিম সমাজে আশরাফ-আতরাফ প্রথার সৃষ্টি করা হয়েছিল। মুসলিম কৌলিন্য প্রথার নি¤œশ্রেণির মধ্যে ছিল সাধারণ কৃষক-তাঁতী প্রভৃতি পেশাভুক্ত শ্রেণির লোক। বাস্তব পরিস্থিতিতে দেখা গেছে একজন কুলীন মুসলমান তথাকথিত নি¤œশ্রেণির কোনো মুসলিম নারী বিবাহ করলে কুলীন পুরুষের বাড়িতে ঐ অকুলীন স্ত্রীর আশ্রয় হতো না। হয় তার জন্য আলাদা বাড়ি করে দেওয়া হতো কিংবা ঐ কুলীন নারী তার পিতৃগৃহে বসবাস করতে হতো। অকুলীন স্ত্রী তো বটেই এমন কি তার সন্তানেরা পর্যন্ত কুলীন স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের সাথে একত্রে বসে খাবার গ্রহণ করতে পারতো না। এমনকি ঐ সন্তানের পিতৃপরিচয় দেওয়ার অধিকার ছিল না। অনেক কুলীন পুরুষ বাদীকে বিয়ে করলে বাদীও তার সন্তানদের একই পরিণতি ভোগ করতে হতো।
বিশ শতকের প্রথম পর্বে এই কুলীন মুসলিম সমাজ অবক্ষয়ের ¯্রােতে প্রবাহিত ছিল। তারা মাদরাসা শিক্ষার প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন। সে কারণে তারা ইংরেজি শিক্ষার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। ইংরেজি ধারা শিক্ষার বিরোধিতা করার আরো একটি কারণ ছিল। সেটা হলোÑ তথাকথিত নি¤œশ্রেণির মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গেলে তাদের উপর কুলীন সমাজের নিয়ন্ত্রণ হারানোর সম্ভাবনা ছিল। অর্থাৎ নি¤œশ্রেণির একজন মুসলমান শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরি পেয়ে একজন কুলীন ব্যক্তি সমকক্ষ হয়ে যাবে।
অন্যদিকে এই অকুলীন মুসলিম সমাজ এবং কুলীন সমাজের একটি অংশ ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হতে থাকে। কারণ তারা দেখতে পেয়েছে হিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাদের থেকে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। আর এভাবে বাঙালি মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হয়ে তাদের থেকে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। আর এভাবে বাঙালি মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভ্রƒণটা বৃক্ষের শরীরে বিকশিত হতে থাকে। বিশ শতকের প্রথম দুই দশক ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি শৈশবকাল।
বৃটিশ ভারতের অবিভক্ত বঙ্গদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন কৃষক ও প্রজাত। তারা জমিদার ও মহাজন শ্রেণির শোষণেল জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নিষ্পেষিত ছিল। ঐ সময়ে মুসলিম সমাজ আরেকটি সমস্যায় আক্রান্ত ছিল সেটা হলো সাম্প্রদায়িকতা। হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান সম্প্রদায়কে ভালো নজরে দেখতো না। বিশেষ করে উচ্চ শ্রেণির হিন্দু সমাজ। মুসলিম সমাজের প্রতি তাদের আচরণ ছিল বিদ্বেষপূর্ণ। যেমন বিশ শতকের প্রথমদিকে বৃটিশ সরকার যখন পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজের উচ্চ শিক্ষার সুবিধার্থে ঢাকায় একটি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল তখন হিন্দু বাবু শ্রেণি বিরোধিতা করেছিলেন। বিরোধিতাকারীদের অন্যতম প্রধান ছিলেন কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি। এ বিরোধিতার অন্তরালের মৌল কারণ ছিল এতে করে পূর্ববঙ্গের সাধারণ মুসলিম (তাদের ভাষায় সাধারণ চাষা-ভুষা মুসলমান) শিক্ষিত হয়ে যাবে।
৬. ‘আব্দুল্লা’ উপন্যাসে মূলত দুটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে : প্রথমত মুসলিম সমাজে বিদ্যমান কৌলিন্য প্রথা ও রক্ষণশীলতা এবং দ্বিতীয়ত ইংরেজি শিক্ষা। এই দুটি থিমকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটির কাহিনী বিকশিত হয়েছে। এই দুটি থিম আবার একটি অপরটির পরিপূরক। এই উপন্যাসে সৈয়দ আব্দুল কুদ্দুস হলেন অবক্ষয়ী রক্ষণশীল ও তথাকথিত অভিজাত বা আশরাফ শ্রেণির প্রতিনিধি। এ দেশে যারা নিজেদেরকে সৈয়দ বংশজনিত সন্তান দাবি করেনÑ তাদের বক্তব্য হলো তাদের পূর্ব পুরুষ আরব দেশ থেকে এ দেশে এসেছিলেন এবং তারা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধর; সে কারণে সমাজে তাদের স্থান সবার উপরে। সৈয়দ সাহেবও নিজেকে উচ্চশ্রেণির বলে দাবি করেন।
অন্যদিকে তিনি হলেন তালুকদার। কিন্তু তাঁর তালুকদারি তলানীতে যাওয়ার পথে। তবু তিনি নিজেকে গ্রামীণ অভিজাত শ্রেণীর লোক মনে করেন। তাঁর সংকীর্ণ আভিজাত্য বোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বরিহাটিতে জুমার নামায পড়ার সময়। তিনি বরিহাটিতে তাঁর ছেলের বাসায় গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তার পীর সাহেব। শুক্রবারে জুমার নামায পড়ার জন্য তার পীর সাহেব মসজিদে যেতে চাইলেন। কিন্তু বরিহাটির সদরে মসজিদ বলে যেটা আছে সেটা হলো- স্থানীয় মুসলমানরা নিজেরা চাঁদা তুলে টিনের একটি জুমা ঘর বানিয়েছে। এখানকার মুসলমানরা হলেন তথাকথিত নি¤œ শ্রেণীর মুসলমান। আর সে কারণে- “সৈয়দ সাহেব পিয়াদা-চাপরাশিদের সঙ্গে নামায পড়িতে যাইবার জন্য মোটেই উৎসুক ছিলেন না; কিন্তু পীর সাহেবের প্রস্তাবে অমতও করিতে পারিলেন না। সুতরাং তাঁহাকে বিরস মনেই যাইতে হইল।”
মসজিদের খতিব সাহেব যখন খোৎবা পাঠ করতে দাঁড়ালেন তখন তাঁকে দেখেই সৈয়দ সাহেব রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন- “এত বড় স্পর্ধা ওর, ব্যাটা জোলা, পাগড়ী বেঁধে এমামতি করতে এসেছো।” ঐ এলাকার প্রধান ব্যক্তিত্ব ও কালেক্টরীর সাবেক কর্মচারী আকবর আলী দৃঢ়স্বরে বললেন- “কেন তাতে কি দোষ হয়েছে? উনি তো দস্তুর মতো পাশ করা মৌলভী; ওর মতো আলেম এ দেশে কয়টা আছে সৈয়দ সাহেব?”
এরপর সৈয়দ সাহেবের রাগ বোমার মতো ফেটে পড়লো। তিনি বললেন-‘এ আলেম হয়েছে! ব্যাটা জোলার ব্যাটা জোলা আজ আলেম হয়েছে। ওর চৌদ্দপুরুষ আমাদের জুতা বয়েছে, আর আজ কিনা ও আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে এমামতি করবে, আর আমরা ওই ব্যাটার পেছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়ব?” এখানে সৈয়দ সাহেবের যে মানসিকতার চিত্র প্রকাশ পেয়েছে সেটা ঐ সময়ের মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর মানসিকতার প্রতিচিত্র। একজন জোলা তথা তাঁতির ছেলে মৌলভী হয়ে মসজিদে ইমামতি করবে, সে বিষয়টা ঐ অভিজাত শ্রেণী মেনে নিতে পারেননি। অর্থাৎ নি¤œবর্গের মুসলিম লোকজন শিক্ষিত হোক এটা তাঁরা চাননি। তাঁদের ধারণা ছিল মাওলানা-মৌলভী হওয়ার অধিকার একমাত্র অভিজাত শ্রেণীর সন্তানদের রয়েছে এবং তাঁদের মানস-ভূগোলে এ ধারণার বীজ সক্রিয় ছিল যে, নি¤œবর্গের লোকজনদের কাজ হলো অভিজাত শ্রেণীর সেবা করা।
সৈয়দ সাহেবের পারিবারিক আভিজাত্য বোধের আরেকটি নমুনা : সৈয়দ সাহেব একটি মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষ করেছেন। সেই উপলক্ষে তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদেরকে দাওয়াত করেছিলেন। এই কারণে-“কয়দিন ধরিয়া বাটীর প্রভু-ভৃত্য সকলকেই ক্রমাগত খাটিয়া প্রাণান্ত হইতে হইয়াছে। কিন্তু অন্দরমহলে যাহা কিছু খাটুনী তিনটি প্রাণীর উপর দিয়া গিয়াছে। হালিমা তো বধূ তাহাকে খাটিতেই হইবে, কিন্তু রাবিয়া ও তাহার বোন সে খাটুনীটা খাটিয়াছিল, যেরূপ বাদীর মতো শ্রমে ও ভগ্নীর মত যতেœ সমাগত বিবিগণের সেবা করিতেছিল, সেই বিবিগণের মধ্যে যাঁহারা উহাদিগকে চিনিতেন না তাহারা উহাদের আভিজাত্য সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া এক দস্তরখানে বসিতে ইতস্তত: করিতেছিলেন। এমন সময় মজিলপুরের এক বিবি কয়েকজনকে একটু অন্তরালে লইয়া গিয়া রাবিয়াদের পরিচয় দিয়া কহিলেন, রাবিয়ার পিতামহ দ্বিতীয়বার যে বিবাহ করিয়াছিল, সে বিবি একটু নীচু ঘরের মেয়ে- রাবিয়ার পিতা তাঁহারই গর্ভে জন্মিয়াছিলেন। এই কথা শুনিয়া শরীফাবাদের এক বিবি কহিলেন, “হু সে আমি চাল-চলন দেখে আগেই ঠাউরে ছিলাম।” তিনি সৈয়দ সাহেবের বড় বিবিকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,-“বেয়ান সাহেব, রাবিয়ারা কি আমাদের সঙ্গে এক দস্তরখানে বসবে?”
বড় বিবি কহিলেন,- ‘না না ওরা কেন বসবে? ওরা খাদিমী করবে খন।’ শরীফাবাদের বিবি কহিলেন-‘না না, সেটা ভাল দেখাবে না। ওদের আলাদা ঘরে বসাইলেই হবে।’ রাবিয়া ও তার বোন কিন্তু সৈয়দ সাহেবের আত্মীয় ও একই বংশের। তাদের পিতা বাদীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করার কারণে তারা আভিজাত হারিয়ে ফেলেছে। সৈয়দ সাহেবের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে একত্রে বসে খাবার গ্রহণের অধিকার লুপ্ত হয়ে গেছে তাদের। সৈয়দ সাহেবের প্রথম সন্তান খোদা নেওয়াজ বাদীর গর্ভজাত হওয়ায় সে সৈয়দ সাহেবের পরিবারে জ্যেষ্ঠ সন্তানের মর্যাদা দূরে থাক সন্তানের মর্যাদাও পায়নি। এই বাড়িতে সে চাকর পরিচয়ে কাজ করছে। সৈয়দ সাহেব তাকে লেখাপড়াও শেখাননি। এহলো তৎকালীন বাঙালী মুসলিম শ্রেণীর পারিবারিক চিত্র। (চলবে)
ঐ সময়ের মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর আরেকটি পারিবারিক চিত্র-“এ বাটীর মহিলাগণ চিঠিপত্রের ধার বড় একটা ধারতেন না। পড়াশুনার মধ্যে কোরানশরীফ, তাহার উপর বড় জোর উর্দু মেফতাহুল জান্নাত পর্যন্ত; ইহার অধিক বিদ্যা তাহাদের পক্ষে নিষিদ্ধ ফল। লেখা- তা সে উর্দুই হোক আর বাঙলাই হোক, আর বাঙালা পড়া এসব তো একেবারেই হারাম।
৭. এদেশের মুসলিম সমাজের অভিজাত শ্রেণীর উদ্ভবের অন্তরালে কী ঘটনা ক্রিয়াশীল ছিল? এরই একটি উপখ্যান ‘আবদুল্লা’ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস সাহেবের বড় ছেলে আবদুল মালেকের শ^শুর হলেন শরীফাবাদের হাজী বরকত উল্লাহ। -“হাজী সাহেব বড় যে সে লোক নহেন : কি ভূসম্পত্তিতে, কি বংশ মর্যাদায়, বরিহাসি জেলায় আশরাফ সমাজে তাহার সমকক্ষ আর কেহ নাই। এমনকি আমাদের সৈয়দ কুদ্দুসও তাহার সহিত কুটুম্বিতা করিতে পারিয়া আপনাকে ধন্য মনে করিয়াছিলেন। করিবারই কথা : কেননা হাজী সাহেবের পিতা শরীয়তউল্লাহ মাত্র পনের দিনের দারোগাগিরির বদৌলতে যখন এক বিপুল সম্পত্তি খরিদ করিয়া দেশের মধ্যে একজন গণ্যমান্য লোক হইয়া উঠিয়াছিলেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে তাহার শরাফতের দরজাও অতিমাত্রায় বাড়িয়া গিয়াছিল এবং যদিও লোকে বলে যে, পঞ্চদশ দিবসে ভোর বেলায় ওযু করিবার সময় এক মস্ত বড় ডাকাতি- ব্যবসায়ী জমিদার সদ্য খুন করা লাশ সমেত তাহার নিকট ধরা পড়িয়া হাজার টাকা ঘুষ কবুল করিয়াছিল এবং টাকার তোড়া আনিবার জন্য যে লোকটিকে সে পাঠাইয়াছিল, সে দিশাহারা হইয়া টাকার পরিবর্তে মোহরের তোড়া আনিয়া নতুন দারোগাকে দিয়া ফেলিয়াছিল এবং তাহারই বলে শরীয়তুল্লাহ পঞ্চদশ দিনের চাকরিতে ইস্তফা দিয়া হঠাৎ জমিদারী ক্রয় করিয়া বসিয়াছিলেন, তথাপি তাহার সাহেবজাদা বরকত উল্লার পক্ষে বরিহাটি জেলায়, এমনকি বঙ্গ দেশের মধ্যে আদি শরীফতম ঘর দ্বারা পরিচিত হইতে কোনো বাধাবিঘœ ঘটে নাই।’Ñ এ হলো এ দেশের মুসলিম সমাজের অভিজাত শ্রেণির জন্ম ইতিহাস। এছাড়া আরেক শ্রেণির অভিজাত পরিবার ছিলেন যাঁর মুসলিম শাসনামলে শাসকগোষ্ঠী থেকে লাখেরাজ সম্পত্তি, জমিদারি প্রভৃতি বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন, অনেকে এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থবিত্ত করেছেন। পরবর্তীকালে জমিদারীও ক্রয় করিয়াছিলেন। এদের উত্তর পুরুষগণ এদের রেখে যাওয়া অর্থ-বিত্ত-সম্পদের কারণে সমাজে অভিজাত বলে পরিচিতি লাভ করেন। যেমন সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস সাহেব। তার পূর্বপুরুষগণ বিশাল পরিমাণের লা-খেরাজ সম্পত্তির মালিক ছিলেন। এই সম্পত্তি থাকার কারণে তিনি নিজেকে অভিজাত বলে দাবি করেন। কার্যত বাস্তবতার আলোকে এটা যৌক্তিক অনুসিদ্ধান্ত যে অর্থ-বিত্ত হলো আভিজাত্যের মাতৃগর্ভ।
৮. ঔপনিবেশিককালীন বৃত্তে সাধারণ নি¤œবর্গের মুসলমান সমাজের আর্থিক বাস্তবতা কেমন ছিল? তারই একটি চিত্র পাওয়া যায় ‘আবদুল্লা’ উপন্যাসেÑ ‘রসুলপুর গ্রামখানি বেশ বর্ধিষ্ণু। তথায় বহু সংখ্যক উচ্চশ্রেণীর হিন্দু এবং মুসলমান রইস বাস করেন। হিন্দুগণ প্রায় সকলেই সম্পন্ন গৃহস্থ; কিন্তু মুসলমান রইসগণের অবস্থা ভালো নহে। তাহাদের অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি, এমনকি কাহারও কাহারও বসতবাটীখানি পর্যন্ত রসুলপুরেরই হিন্দু মহাজনদিগের নিকট ঋণদায়ে আবদ্ধ; তথাপি তাহারা সাংসারিক উন্নতির জন্য কোন প্রকার উদ্যোগ করিবার আবশ্যকতা বোধ করেন না। একমাত্র খোদা ভরসা করিয়াই খোশ মেজাজে, বহাল-তবিয়তে দিনগুজরান করিয়া থাকেন।
এতদ্ভিন্ন পলাশ ডাঙ্গা প্রভৃতি নিকটস্থ গ্রামগুলিতে অনেক মুসলমান কৃষক বাস করে। গ্রাম সন্নিহিত বিল এবং ক্ষেত্রগুলো প্রচুর উৎপাদনশীল হইলেও এই সকল হতভাগ্য কৃষকের অবস্থা সচ্ছল নহে। তাহারা যাহা কিছু উপার্জন করে তাহার অধিকাংশই মহাজনেরা গ্রাস করিয়া বসে, অবশিষ্ট যাহা থাকে কায়ক্লেশে বৎসরের অর্ধেক কাল চালাইয়া বাকি অর্ধেকের খাওয়া-পরার জন্য ইহারা আবার মহাজনের হাত-পায়ে ধরিতে যায়।’
এখানে যে বাস্তবতার ফসল প্রস্ফুটিত সেটা হলো, নি¤œবর্গের মুসলমানগণ ছিলেন উদ্যমহীন এবং মহাজনের ঋণের কারাগারে বন্দি। মহাজনের ঋণের সুদ দিতে গিয়েই সর্বস্বান্ত হয়ে যেত। কার্যত উনিশ-বিশ শতকের বাস্তবতা ছিল মহাজনী শোষণের যাঁতাকলে মুসলিম কৃষক-তাঁতী প্রভৃতি শ্রেণীর পিষ্ট হওয়ার বাস্তবতা। মুসলিম কৃষকশ্রেণি নিঃস্ব হওয়ার প্রক্রিয়ার প্রতিচিত্র ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাসের পলাশডাঙ্গার মদনগাজী, মদনের আর্থিক অবস্থা সচ্ছলই ছিল। সে পলাশডাঙ্গার অবস্থাসম্পন্ন কৃষক- ‘গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু-ছাগল এবং উঠানভরা মোরগ-মুরগি লইয়া সে বেশ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে দিনাতিপাত করিত।’ তার একমাত্র ছেলে সাদেক আলীর বিয়ে। এই বিয়ে উপলক্ষে তার আত্মীয়-স্বজনের ইচ্ছা এই বিয়েতে তারা বেশ ধুমধাম করবে। দুই-চারখানা গ্রামের লোকজনদের খাওয়াতে হবে।Ñ ‘নহিলে শুধু মদন গাজীর কেন, পলাশডাঙ্গার শেখেদের কাহারও মান থাকিবে না। শেখেরা তো আর এখন আগেকার মেেতা মিঞা সাহেবদের গোলামী করে না।’ আর ছেলের বিয়ের খরচপাতির জন্য মদনগাজীকে ঋণ করতে হলো। আত্মীয়-স্বজনদের শখ মিটাতে গিয়ে সে বাধ্য হয়ে রসুলপুরের দিগম্বর ঘোষের নিকট সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নিলো।
মদনের ভাগ্য খারাপ। দুই তিন বছর ধরে জমিনে ফসল কম উৎপাদিত হচ্ছিল। সে কারণে মদন ঋণের কিস্তি দিতে পারেনি। অর্থাৎ- ‘মদনের দেয়া সুদ কিস্তির পর কিস্তি বাকি পড়িয়া চক্রবৃদ্ধিহারে ক্রমাগত বাড়িয়া চলিল।’ ফলে মদনের ঋণের টাকা আর পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।’
অন্যদিকে ‘তিন বৎসরের অজন্মার পর চতুর্থ বৎসরে যখন সুপ্রচুর ফসল জন্মিবার সম্ভাবনা দেখা গেল, তখন মদনের আশা হইল যে, খোদায় করিলে এবার মহাজনের টাকা পরিশোধ করিতে পারিবে। কিন্তু ওদিকে ঘোষ মহাশয়ের সজাগ দৃষ্টি ফসলের প্রাচুর্যের দিকে পতিত হইয়া তাঁহাকে একটু ব্যবস্থা করিয়া তুলিলÑ পাছে মদন ঋণ পরিশোধ করিবার সুযোগ পাইয়া বসে, এই ভয়ে তিনি তামাদির অজুহাতে তাড়াতাড়ি নালিশ করিয়া দিবেন।... মদনের খামার জমিগুলি নিলাম হইয়া গেল এবং ঘোষ মহাশয় সেগুলি খরিদ কয়িা ফেলিলেন।’
মদনের খামার জমিগুলো নিলাম হওয়ার পরও ঋণ পুরো পরিশোধ হয় নাই। কিছু ঋণ রয়ে গিয়েছিল। সেই বাকি ঋণের টাকার জন্য মদন তার বসতবাড়ি বন্ধক দিতে বাধ্য হয়। এই ঋণের টাকা করতে না পারায় তার বসতবাড়িও নিলাম হয়ে যায়। দিগম্বর ঘোষ ও তার ছেলে জনার্দন ঘোষ বাড়ি দখল নিতে আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে মদন গাজীর ছেলে সাদেক গাজী নদী সাঁতরিয়ে ঐ পাড়ের গ্রাম রসুলপুরের মীর মোহসেন আলীর বাড়িতে গিয়ে তার সাহায্য চায়। মদন গাজীকে মীরসাহেব বিপদ হতে উদ্ধার করেন।
দিগম্বর ঘোষের মূল লক্ষ্য ছিল তার উর্বর জমিন। সে কারণে সে মদনগাজীকে ঋণ পরিশোধের সময় দেয়নি। প্রথম কয়েক বছর কিছু বলেনি। কারণ জমিনে ফসল হয়নি। সেই ফসল হলো সেই মাত্র সে আদালতে মামলা ঠুুকে দিয়ে জমি নিজ দখলে নিয়ে নেয়। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে মহাজন শ্রেণির লোভ ও সুবিধাবাদী মানসিকতার বাঘের হিং¯্র রূপ প্রস্ফুটিত হয়েছে।
৯. বিশ-শতকের প্রথম পর্বে শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের পথটা সহজ-সরল ছিল না। তাদেরকে অনেক প্রতিকূল স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হয়েছে। বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষিত বাবু শ্রেণি এক্ষেত্রে বাধার হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সৈয়দ সাহেবের পুত্র আবদুল কাদের পিতার সিদ্ধান্ত অমান্য করে বাড়ি থেকে বের হয়ে বরিহাটি শহরে তার বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সে তার বন্ধুর পিতা আকবর আলীকে একটা টিউশনি যোগাড় করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু এতে- ‘আকবর আলী তাহাকে বুঝাইয়া কহিলেনÑ যদিও বরিহাটিতে অনেক শিক্ষিত লোকের বাস আছে, কিন্তু সকলেই হিন্দু, তাঁহাদের বাড়িতে টুইশন পাওয়া অসম্ভব, কেননা, একে তো তাহার স্বজাতীয় লোক পাইতে অপরকে কাজ দিতে রাজিও হবেন না। তাহার ওপর আবার হিন্দু গ্রাজুয়েট, আন্ডার গ্রাজুয়েটের অভাব নাই, সুতরাং এন্ট্রাস পর্যন্ত পড়া মুসলমানের পক্ষে এই শহরে টুইশনের প্রত্যাশা করা ধৃষ্টতা বৈ আর কিছু নহে।’ অর্থাৎ শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে কোনো হিন্দু পরিবারে সাধারণ টুইশন পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
অন্যদিকে, ‘যে আশা ও উৎসাহ লইয়া আবদুল্লাহ কলিকাতায় আসিল, দু’দিনেই তাহা ভঙ্গ হইয়া গেল। কোন স্কুলেই মাস্টারি জুটিল না। কলিকাতায় এক মাদ্রাসা ভিন্ন তখন আর কোনো মুসলমান স্কুল ছিল না; সেখানে একটা চাকরি খালি পাইয়াও আর একজন বিহারবাসী উমেদারের বিপুল সুপারিশের আয়োজনের সম্মুখে সে টিকিতে পারিল না।’ সে সময়ে একজন সুশিক্ষিত মুসলমান কি পরিমাণ বিপ্রতীপ স্রোতের মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেটা এখানে প্রস্ফুটিত। এটা ছিল উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথম দিকের বাস্তবতা।
বরিহাটির গভর্নমেন্ট স্কুলে একজন মুসলমান আন্ডার গ্রাজুয়েট শিক্ষক নেওয়া হবে বলে খবর পেয়ে আবদুল্লাহ যখন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নিকট সাক্ষাৎ করতে গেল তখন প্রধান শিক্ষক তাকে বলেন, ‘তবে কি জানেন, এতে মাইনেও অতি সামান্য, প্রসপেক্ট তো কিছু নেই, আপনাদের মতো লোকের কি আর এসব চাকরি পোষাবে? আমি তাই ভাবছি।’Ñ এরপর আবদুল্লাহর কথা শুনে আবার বললেন, ‘তা আপনি একটু চেষ্টা করে খুব ভালো চাকরিই পেতে পারেন। ডেপুটি না হোক সাব-ডেপুটি তো চট করে হয়ে যাবেন। কেন মিছিমিছি এই সামান্য মাইনের চাকরি করবেন, এতে না আছে পয়সা না আছে ইজ্জত...।’ স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহকে স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি না করার জন্য উৎসাহিত করেছে। কারণ কি? প্রধান শিক্ষকের কথায় সে যদি নিরুৎসাহিত হয়ে স্কুলের শিক্ষকতার জন্য দরখাস্ত না করে তাহলে পদটা শূন্য থকে যাবে। আর ঐ শূন্য পদে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন লোককে চাকরিটি দেওয়া যাবে। এ হলো প্রধান শিক্ষকের পরিকল্পনা বা কৌশল।
প্রধান শিক্ষকের কৌশলের ভেতরে প্রবেশ করলে একটি ভয়াবহ চিত্র প্রস্ফুটিত হয়। সেটা হলোÑ মুসলমানদের প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের বৈরী মনোভাব। স্কুল কমিটির সভাপতি হলেন স্থানীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সেক্রেটারি হলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সদস্য হলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, একজন উকিল ও একজন স্থানীয় জমিদার। আবদুল্লাহ ব্যতীত ঐ পদে আরো একজন মুসলমান প্রার্থী ছিলেন। ঐ প্রার্থীটি এফএ পাস ও কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। এই প্রার্থীটি প্রধান শিক্ষকের পছন্দীয় ছিল। কিন্তু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহকে যোগ্য মনে করেছিলেন। কমিটির অন্য তিন সদস্য তার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি। ফলে আবদুল্লাহর চাকরি হলো। এরপর ম্যাজিস্ট্রেটেরÑ ‘কুটি হইতে বাহিরে আসিয়া পথে চলিতে চলিতে জমিদার বাবুটি হেড মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি সাহেবের বিরুদ্ধে ও লোকটার জন্য এত উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন কেন?’
‘উকিল বাবুটি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা ও দু’ব্যাটাই তো নেড়ে, ওর আবার ভাল কি? একটা হলেই হল।’
এই দুই বাবুর কথা শুনে হেড মাস্টার জবাব দিলেন- ‘আরে না মশায়, এর ভেতর কথা আছে এ লোকটা (আবদুল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী) পি-এল লেকচার কমপ্লান্ট করেছে, এখন একজামিন দিয়ে দিয়ে পাশ করেই চাকরি ছেড়ে দেবে আমি সঠিক খবর জানি। ছেড়ে দিলে একটা প্লি হত নেড়েগুলো স্টিক করে না তাতে কাজের বড্ড ডিমলোকেশন হয়। তারপর নিজেদের একজন লোক নেওয়া যেত।’
কি সুদূরপ্রসারী সাম্প্রদায়িক মানসিকতা। একজন স্বজাতি হিন্দুকে চাকরিতে নেওয়ার জন্য শিয়ালের চতুর কৌশল। কার্যত ঐ সময়ের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানসিকতা এরকমই ছিল।
ঐ সময়ে মুসলমানদের প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গী কেমন ছিল এর আরো একটি প্রতিচিত্র। আবদুল কাদের বরিহাটিতে স্থানীয় উকিল শশী বাবুর বাসা ভাড়া নিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া দিয়েই আবদুল কাদের বাসা ঠিক করেছেন। কিন্তু কয়দিন পর শশী বাবু আবদুল কাদেরকে জানালেন যে, তাকে বাসাভাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ কী? শশী বাবু বললেন, ‘আমাদের বারের প্রেসিডেন্ট অতুল বাবু ঐ পাড়াতেই থাকেন কিনাÑ তা তিনি এবং আরও পাঁচজনে বলেছেন, ও পাড়ায় ভদ্দর লোকের বাস, ওখানে মুসলমানকে বাড়ি দিলে সক্কলকারই অসুবিধা হবে।’ অর্থাৎ মুসলমানরা ভদ্রলোক নন। একমাত্র হিন্দুরাই ভদ্রলোক। সে কারণে অভদ্র জনকে বাড়িভাড়া দিলে তাদের জাত যাবে। তাই মুসলমান ব্যক্তিকে বাড়ি ভাড়া দিবেন না।
১০. উপন্যাস রচনা হলো অনেকগুলো চলকসহ একটি সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া। চলকগুলো উপন্যাসের কাঠামো নির্মাণ করে এবং এই কাঠামোতেই উপন্যাসটি বিকশিত হয়। অর্থাৎ কাঠামোই উপন্যাসের প্লটকে ধারণ করে থাকে। এই কাঠামো হলো গল্প বলার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ। প্লটের ভিত্তি হলো কাহিনী। কার্যত উপন্যাসের মৌলিক বিষয় হলো সময় ক্রম অনুসারে বিন্যস্ত ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা। কাহিনীর মাধ্যমে ঔপন্যাসিক সময়ের প্রবাহমানতাকে ধারণ করে থাকেন এবং সময়কে ভাঙতে পারেন। ‘আবদুল্লা’ উপন্যাসের কাহিনী কী? একটি উপন্যাসে মূলত একটি মূল কাহিনী থাকে। এই মূল কাহিনীকে প্রস্ফুটিত করার জন্য একাধিক উপকাহিনী থাকে। এখানে মূল কাহিনী কোনটা? উপন্যাসটির নামকরণে যৌক্তিকভাবে মনে হতে পারে আবদুল্লাহর জীবন প্রবাহের বর্ণনা করাই এই উপন্যাসটির মৌল উদ্দেশ্য। কিন্তু উপন্যাসটির গতি প্রবাহ সেই অনুসিদ্ধান্তকে সমর্থন করে না। তবে আবদুল্লাহর জীবন প্রবাহ উপন্যাসটির অধিকাংশ স্থান জুড়ে বর্তমান। এই উপন্যাসে একাধিক কাহিনী রয়েছে। কার্যত উপন্যাসটির প্লট হলো বিশ শতকের প্রথমার্ধের বাঙালি মুসলিম সমাজ। বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশধারা। বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি হলো আবদুল্লা, আবদুল কাদের প্রমুখ। আর সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস সাহেব। আর মীর মোহসেন আলী হলেন বিকাশমান বাঙালি মুসলিম ধনিক শ্রেণি। কুদ্দুস সাহেব যদি সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি হন তাহলে মীর সাহেব হলেন বাণিজ্যিক পুঁজির প্রতিনিধি। ঐ সময়ে সামন্ত্রতন্ত্রের সাথে বিকাশমান মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও উঠতি ধনিক শ্রেণির দ্বন্দ্বটাই ছিল প্রধান। ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাসে এ দ্বন্দ্বের বিষয়টাই হলো মূল থিম।
অন্যদিকে উপন্যাসে কাহিনীর গুণ কার্যটা একটিইÑ এরপর কি ঘটবে সে বিষয়ে পাঠাককে উৎকণ্ঠিত রাখা। ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাসের কাহিনী বুননে এই গুণটা বৃক্ষের সতেজতায় প্রস্ফুটিত। এই উপন্যাসের প্রথমেই একটি উৎকণ্ঠার আবহ সৃষ্টি হয়েছে। ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাসের শুরু এরকমÑ ‘বিএ পরীক্ষার আর কয়েক মাস বাকি আছে, এমন সময় হঠাৎ পিতার মৃত্যু হওয়ায় আবদুল্লাহর পড়াশুনা বন্ধ হইয়া গেল।’ এখানেই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে এরপর কি হলো? আবদুল্লাহ তার মায়ের কথামতো লেখাপড়ার খরচের ব্যাপারে সাহায্যের জন্য তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল। তখনই একটা প্রশ্ন জাগে সে কি শ্বশুরের নিকট হতে কোনো সাহায্য পেয়েছিল? নাকি পায়নি? আবদুল্লা যখন চাকরির খোঁজে কলিকাতায় গিয়েছিল তখনও পাঠকের মধ্যে একটি উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। কলিকাতায় তার কি হলো এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে জাগে। আবদুল কাদের যখন পিতার সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল তখনও একটি উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। সে কোথায় গেল? লেখাপড়া করতে পারল কি? এ উৎকণ্ঠাই এ উপন্যাসের কাহিনীকে গতি দিয়েছে।
মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিসাধ সিন্ধু’ এর পর ‘আবদুল্লাহ’ হলো কোনো বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক কর্তৃক লিখিত প্রথম উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। মীর মোশাররফ হোসেনের পর কাজী ইমদাদুল হক হলেন বিশ শতকের প্রথম পর্বের শক্তিশালী মুসলিম সাহিত্যিক। অন্যদিকে আবদুল্লাহ উপন্যাসটি উপনিবেশকালীন সময়ের বাঙালি মুসলিম সমাজের বিদ্যমান বাস্তবতার একটি সাহিত্যিক অনুসন্ধানের ফসল।