কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা ফেরাতে বিধান সভায় প্রস্তাব পাস : কী করবে কেন্দ্র?
আহমদ মতিউর রহমান
ভারতের জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে ওমর আবদুল্লাহ সরকারের শাসনকালের এক মাস পার হয়েছে। ১০ বছরের ব্যবধানে হওয়া নির্বাচনে ওমর আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন এনসি-কংগ্রেস জোট জয়লাভ করে আর ভোটে জেতার কৌশল করেও হেরে যায় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি। আর সর্ব সাম্প্রতিক খবর হলো জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ৩৭০ ধারা ফেরাতে চেষ্টার কমতি রাখছেন না। তিনি বিধান সভায় প্রস্তাব পাস করিয়েছেন। সরকার চায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হোক। এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক হট্টগোল হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটা বাস্তবায়ন, ৩৭০ ধারা ফিরিয়ে আনা একটা কঠিন কাজ। ওমর আবদুল্লাহ আগেও জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তখন তা ছিল পূর্ণ রাজ্য। ২০১৯ সালে রাজ্যভাগ, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়া ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের ৫ বছর পর প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তার দল ও জোট কাশ্মীর শাসন করছেন। ওমর হলেন আবদুল্লাহ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম, যিনি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর দাদা শেখ আবদুল্লাহ ও বাবা ফারুক আবদুল্লাহ দুজনই জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এবার তিনি কতটা সাফল্য পাবেন তা এখন প্রশ্ন।
সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদসহ জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ফেরানোর দাবিতে এ মাসের শুরুতে বিধানসভা উত্তাল ছিল। ৮ নভেম্বর উত্তেজিত ও মারমুখী সদস্যদের বের করে দেওয়া হয় সভাকক্ষ থেকে। প্রধান বিরোধী দল বিজেপির অভিযোগ, স্পিকার নিজেই সরকারি প্রস্তাবের রচয়িতা। এই গোলমালের মধ্যেই ৮ নভেম্বর শেষ হয় নতুন বিধানসভার পাঁচ দিনের প্রথম অধিবেশন। সরকারি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিশেষ মর্যাদা ফেরানোর জন্য কেন্দ্র অবিলম্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করুক। কারণ, সংবিধান প্রদত্ত বিশেষ মর্যাদা কেন্দ্রীয় সরকার খারিজ করেছে রাজ্যের মানুষের সঙ্গে আলোচনা না করে। বিশেষ মর্যাদা ফেরানোর কথা নির্বাচনী প্রচারের সময়েই উপত্যকার দলগুলো নিজেদের মতো করে তুলেছিল। ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) সরাসরি সেই মর্যাদা ফেরানোর দাবি না জানালেও তাদের পেশ করা প্রস্তাবে বলা হয়, মানুষ যে ওই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেনি, তা ভোটের রায়েই স্পষ্ট। অতএব, সরকার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মর্যাদা ফেরানো নিয়ে কথাবার্তা শুরু করুক। সরকারপক্ষের পেশ করা প্রস্তাবটি ৬/১১/২৪ বুধবার কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়। এতে সরাসরি ৩৭০ অনুচ্ছেদের উল্লেখ যদিও ছিল না। কিন্তু আগের দিন সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের দাবি জানিয়ে পিডিপির পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব তোলার চেষ্টা হয়েছিল; স্পিকার যদিও সেটি খারিজ করে দেন। ৭/১১/২৪ বৃহস্পতিবার অনুরূপ প্রস্তাব পেশের চেষ্টা করেন আওয়ামি ইত্তেহাদ পার্টির সদস্য শেখ খুরশিদ, পিডিপির ওয়াহিদ পারা ও পিপলস কনফারেন্স নেতা সাজ্জাদ লোন। তাঁরা ওই দাবি লেখা পোস্টার ও ব্যানার নিয়ে সভাকক্ষের ওয়েলেও নেমে আসেন। বিজেপি সদস্যরা তাঁদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে দুই পক্ষে হাতাহাতির উপক্রম হয়। স্পিকার বিজেপি ও স্বতন্ত্র সদস্যদের সভা থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেন মার্শালদের। এর কিছুক্ষণ পর বিজেপির অন্য সদস্যরা ওয়াকআউট করেন। এর আগে বিরোধী নেতা সুনীল শর্মাসহ অন্য বিজেপি সদস্যরা প্রস্তাব খারিজের দাবি জানিয়ে বলেন, তিন দিন ধরে বিধান সভায় যা চলছে, তা গণতন্ত্রের কালো অধ্যায়। সরকার পক্ষ ও অন্য যাঁরা বিশেষ মর্যাদা ফেরানোর দাবি জানাচ্ছেন, তাঁদের মনে থাকা উচিত, দেশের সংসদ ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিধানসভা কখনো সংসদের চেয়ে বড় হতে পারে না। সুনীল শর্মা বলেন, ৩৭০ ইতিহাস। কোনো দিনই তা ফিরে আসবে না। স্পিকার আবদুল রহিম রাথের বলেন, প্রস্তাব পেশ করেছে সরকারপক্ষ। সভার সদস্যরা তা গ্রহণ করেছেন। খারিজ করার অধিকারও তাঁদের। গৃহীত প্রস্তাব তিনি খারিজ করতে পারেন না।
কিছু তথ্য : জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের মুসলিম প্রধান কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, যা আগে ছিল রাজ্য। শ্রীনগর গ্রীষ্মকালীন এবং জম্মু শীতকালীন রাজধানী। জনসংখ্যা এক কোটি ৫৬ লাখ। কাশ্মীরের ৯৫ শতাংশ মুসলিম আর জম্মুর হিন্দু জনসংখ্যা ৭০ ভাগ, বাকি ৩০ শতাংশ মুসলিম। কাশ্মীর উপত্যকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এ জন্য একে বলা হয় ভূস্বর্গ। ভারতের একটি বিখ্যাত ট্রাভেল স্পট কাশ্মীর। পর্যটন থেকে বিপুল আয় হয়। তবে সহিংসতা আর সরকারের বিধিনিষেধের কারণে তা প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জম্মু অঞ্চলে অনেক হিন্দু মন্দির থাকায় এটি হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। দেশ বিভাগের সময় ভারতবর্ষের মুসলিম প্রধান এলাকাগুলো পাকিস্তানভুক্ত হলেও কাশ্মীর বাইরে থেকে যায়। কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ভারতভুক্তির পক্ষে স্বাক্ষর করবেন এই শর্তে মাউন্টব্যাটেন কাশ্মীরকে সাহায্য করতে রাজি হন। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই করেন। ফলে তা ভারত নিয়ন্ত্রিতই থেকে যায়। জাতিসংঘ এ বিষয়ে নিষ্পত্তি করতে চাইলেও ভারত তা করতে দেয়নি। এরপর ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ হয়। আর ২০১৯ সালে রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা হারায় কাশ্মীর।
২০১৪ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়েছিল কাশ্মীরের আরেক প্রধান মুসলিম দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)। ২০১৮ সালে উক্ত দুই দলের জোট ভেঙে যায়। পতন হয় সরকারের। ২০১৮ সালের ১৯ জুন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় জম্মু ও কাশ্মীরে। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বা অনুচ্ছেদ ৩৭০ প্রত্যাহার করে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়। সেই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন হয় এবং ওমরের জোটের সরকার চলমান। এনসি একক বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, মোট ৪২টি আসন জিতেছে, যেখানে বিজেপি ২৯টি আসন জিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কংগ্রেস ৬টি আসন জিতেছে, পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) ৩টি আসন জিতেছে। সিপিআই(এম), জম্মু ও কাশ্মীর পিপলস কনফারেন্স এবং আম আদমি পার্টি একটি করে আসন জিতেছে। ৭টি আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি শাসনের অবসান হয় ১৩ অক্টোবর। এসব তথ্য মনে রেখে আলোচনা করতে চাই।
ওমর আবদুল্লাহ এখন কী করবেন? তিনি কি ফিরিয়ে আনতে পারবেন ৩৭০ ধারা বা রাজ্যের হারানো মর্যাদা? এসব প্রশ্নের সরল কোন জবাব হবে না, বাস্তবায়ন করাটাও কঠিন আগেই বলেছি। বিশ্লেষকরা কী বলছেন? কাশ্মীর অবজার্ভার সম্প্রতি এক বিশ্লেষণে দেখিয়েছে সেখানকার পরিস্থিতি। বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের সাথে কথা বলে পত্রিকাটি বলছে, তারা নতুন সরকারের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত শেয়ার করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠরা একমত যে প্রশাসনের একটি প্রতীকী মূল্য থাকলেও বর্তমান কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল কাঠামোর অধীনে এর ব্যবহারিক ক্ষমতা সীমিত হতে পারে। অনেকে বিশ্বাস করেছিলেন যে এটি জনসাধারণকে শান্ত করতে সাহায্য করবে, সরকার ও জনগণের মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরি করবে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমান আমলাতান্ত্রিক ঔদ্ধত্যকে রোধ করবে। অন্যরা হাইলাইট করেছেন যে নয়াদিল্লী থেকে দীর্ঘ সময়ের প্রত্যক্ষ শাসনের পর অবশেষে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। কাশ্মীর অবজার্ভার জানায়, সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিয়াজ ওয়ানি পরিবর্তন বাস্তবায়নে নতুন প্রশাসনের প্রকৃত সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন “এটা স্পষ্ট যে সরকার দাঁতহীন হতে চলেছে। তবে, এর প্রতীকী মূল্য খারিজ করা যাবে না। তারা মাঠে উল্লেখযোগ্য কাজ করতে সক্ষম নাও হতে পারে, তবে তাদের এখনও একটি ভূমিকা পালন করতে হবে। ওমরের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন জনগণের প্রতি সহানুভূতির পর সহানুভূতি জানাতে পারে, যা গত কয়েক বছর ধরে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল।”
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক অমিতাভ মাট্টু ওমরের নেতৃত্বাধীন সরকারের সীমিত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, শাসন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরও দায়বদ্ধ হওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি মৌলিক পরিষেবা, শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং অবকাঠামোর মতো মৌলিক সমস্যাগুলো মোকাবেলার গুরুত্বের উপর জোর দেন। “মৌলিক জিনিসগুলো আজকের বিশ্বে আর বিলাসিতা নয়। বিদ্যুৎ একটি মৌলিক প্রয়োজন এবং শ্রীনগর ও আশপাশের এলাকায় একটি উল্লেখযোগ্য বিদ্যুৎ সমস্যা রয়েছে। আমি আশা করি ওমরের নেতৃত্বাধীন সরকার এর সুরাহা করবে।”
সরকারে জোটসঙ্গী না থাকায় নানা কথা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এনসির সাথে কংগ্রেসের চিড় ধরেছে। তবে সে সব সমালোচনার মোক্ষম জবাব দিয়েছেন কংগ্রেস নেতা গুলাম আহমেদ মীর। কাশ্মীরী দৈনিক স্টেট টাইমস ২০ নভেম্বর জানাচ্ছে, “কংগ্রেস নেতা গুলাম আহমেদ মীর মঙ্গলবার বলেছেন যে, জম্মু ও কাশ্মীরে তার দল এবং ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল কনফারেন্সের (এনসি) মধ্যে কোনও বিভেদ নেই। ন্যাশনাল কনফারেন্স কংগ্রেসে পরিণত হবে না এবং কংগ্রেসও এনসি হবে না। যাই হোক, গত কয়েক দশক ধরে দুই দলের মধ্যে আদর্শগত মিল রয়েছে... বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শব্দের পার্থক্য থাকতে পারে তবে এর অর্থ এই নয় যে, জোটের অংশীদারদের মধ্যে ফাটল রয়েছে”।
মীর অনন্তনাগে সাংবাদিকদের বলেছেন। মীর ডুরু অংশের একজন বিধায়ক। তিনি বলেন, আদর্শগত মিলের ভিত্তিতে কংগ্রেস ও এনসি একসাথে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং পাশাপাশি সরকারে প্রত্যেককে সাহায্য করছে। রাজ্যের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের বিষয়ে জেকে অ্যাসেম্বলিতে পাস করা রেজুলেশন সম্পর্কে জানতে চাইলে মীর বলেন, রেজুলেশনে কোনো ভুল নেই। কিছু দল এটাকে নির্বাচনী ইস্যু বানানোর চেষ্টা করছে। ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার পরে দুই দল বৈঠকে মিলিত হতে পারে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। ২০ নভেম্বর ঝাড়খন্ডসহ কয়েকটি রাজ্যে বিধান সভা নির্বাচন হচ্ছে।
কংগ্রেস নেতার কাছ থেকে যা জানা যাচ্ছে তার মানে হচ্ছে ওমর সরকার পরিচালনায় আপাতত কোন সমস্যা দেখা যাচ্ছে না। প্রস্তাব ও দাবির ক্ষেত্রে দুটি দলের বক্তব্যের মধ্যে শব্দের হেরফের থাকলেও নিগলিত অর্থ এক এটা বোঝা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক অধিবেশনের এই প্রস্তাব ও দাবি দাওয়া কেন্দ্র বিবেচনা করবে আপাতত এটাই তাদের চাওয়া। সামনের দিনগুলোতে কী হয় তা দেখতে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।