সিনথিসিস প্রণয়ন করলেন আমীর
অন্য দিনের মতো ২৭ অক্টোবরও সকালের কাজটা করছিলাম, অর্থাৎ মনোযোগ দিয়ে জাতীয় কয়েকটি দৈনিকের প্রতিবেদন পড়ার চেষ্টা করছিলাম। প্রথম আলোর একটি শিরোনামে দৃষ্টি আটকে গেলো। শিরোনামটি হলো, ‘আমরা সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু শব্দ শুনতে চাই না।’ এমন স্মার্ট শিরোনামের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলাম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা চাই না এই জাতিকে আর কেউ বিভক্ত করুক। আমরা সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু শব্দ শুনতে চাই না। যারাই এখানে জন্ম নিয়েছে, তারা গর্বিত নাগরিক। সব ধর্মের মানুষ দলমত নির্বিশেষে এখানে বসবাস করবে। সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। যদি মসজিদে নামায পড়ার সময় পাহারা দিতে না হয়, তাহলে মন্দিরে উপাসনার সময়ও যেন পাহারা দেওয়ার প্রশ্ন না ওঠে।’ খুবই সঙ্গত এবং স্মার্ট বক্তব্য। এমন বক্তব্যই মানুষের কাম্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শনিবার বিকেলে বগুড়ার ঐতিহাসিক আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে এক সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর আমীর আরও বলেন, জামায়াতে ইসলামী এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে, যে দেশে বিচারকের চেয়ারে বসে কোনো দুর্বৃত্ত ঘুস খাওয়ার চিন্তা করবে না। ন্যায় বিচারের জন্য মানুষকে এক আদালত থেকে অন্য আদালতে ঘুরতে হবে না। জামায়াতে ইসলামী কুরআনের আলোকে একটি মানবিক বাংলাদেশ দেখতে চায়। শফিকুর রহমান আরও বলেন, জামায়াতে ইসলামী তরুণদের প্রতি আস্থাশীল। ‘জামায়াত তরুণদের এমন শিক্ষা দিতে চায়, যাতে তারা আল্লাহকে ভয় করবে, মানুষকে ভালোবাসতে শিখবে, দেশকে ভালোবাসতে শিখবে। সুশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কাক্সিক্ষত কাজ তাদের হাতে চলে আসবে। কোনো মামা-খালুর তদবির চলবে না। যার যার যোগ্যতায় চাকরি পাবে। জামায়াত সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। জামায়াত এমন বাংলাদেশ চায়Ñযেখানে হিংসা, হানাহানি ও প্রতিহিংসার রাজনীতির কবর রচিত হবে। প্রতিশোধের রাজনীতি না চাইলেও ফ্যাসিস্ট সরকারের খুন-হত্যা, গুম এবং অর্থ চুরির বিচার হতে হবে।’
প্রথম আলোর প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা জামায়াতে ইসলামীর কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ সম্পর্কে অবগত হলাম। বর্তমান সময় ও বাস্তবতার আলোকে জামায়াত আমীরের বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও সুবিবেচিত বলে আমরা মনে করি। তার বক্তব্যের বিষদ ব্যাখ্যা করা যায়, তবে সম্পাদকীয়ের সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা সম্ভব নয়। এখানে শুধু একটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। আমীর বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামী কুরআনের আলোকে একটি মানবিক বাংলাদেশ দেখতে চায়।’ এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া এক রকম হয় না। রাজনৈতিক দর্শনের কারণে ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে অতীতেও। কেউ এটাকে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন, কেউবা বলেছেন, এটা মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাথে যায়। তবে যারা শুধু সোয়াবের উদ্দেশ্যে নয়, বরং জানার উদ্দেশ্যেও কুরআন অধ্যয়ন করেছেন, তারা গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে সাক্ষি দিয়েছেন যে, কুরআনের বক্তব্যে সাম্প্রদায়িকতা নেই, নেই তথাকথিত জাতীয়তাবাদও। কুরআনের কেন্দ্রীয় বিষয় মানুষ এবং মানব জাতি। এ বিষয়টি উপলব্ধি করার কারণেই হয়তো আধুনিক বিশে^র থিসিস ও এন্টিথিসিসের দ্বন্দ্ব পেরিয়ে জামায়াতের আমীর সিনথিসিস প্রণয়ন করে বলতে পেরেছেন, আমরা কুরআনের আলোকে একটি মানবিক বাংলাদেশ দেখতে চাই। তিনি কোনো সাম্প্রদায়িক বা কোনো ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলেননি। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ইসলামের বক্তব্য যথামর্যাদায়, যথাভাবে সবসময় প্রকাশিত হয় না। অনেক সময় বিভ্রান্তি ছড়াবার প্রয়াশও লক্ষ্য করা যায়। যারা ইসলামের কথা বলেন, তাদের মর্যাদাময় পরিচয়ও কর্তন করা হয়। প্রথম আলোর প্রতিবেদনেও ডা. পরিচয়টি কর্তন করে শুধু শফিকুর রহমান লেখা হয়েছে। একই দিনের পত্রিকায় কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস লেখা হয়েছে। প্রথম আলো এখানে কিন্তু নাম থেকে ড. কর্তন করেনি। বগুড়ার সেদিনের বিশাল সুধী সমাবেশের খবর কিন্তু অন্যান্য পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছে, ছাপা হয়েছে ছবিও। অথচ প্রথম আলোয় খবরটি দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছে সিঙ্গেল কলামে, ছবির দেখা মিলেনি। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতিমালাটা হয়তো এরকমই। এখানে আমাদের কিইবা বলার থাকতে পারে। তবে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে বলার বিষয় রয়েছেÑবৈষম্যহীন মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবার নীতিমালার ত্রুটি সংশোধনের এখনই সময়।