লেবাননে স্থল হামলা শুরু ইসরাইলের
সংগ্রাম ডেস্ক : সকল শঙ্কাকে সত্য করে লেবাননে স্থল হামলা শুরু করেছে দখলদার ইসরাইল। ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনী গতকাল মঙ্গলবার স্থল হামলা চালানোর ঘোষণা দেয়। যদিও হামলাটি সীমিত এবং নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তু লক্ষ্য করে চালানো হচ্ছে বলে দাবি করেছে তারা। ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনী স্থল হামলার ব্যাপারে বলেছে, কয়েক ঘণ্টা আগে হিজবুল্লাহর অবকাঠামো লক্ষ্য করে দক্ষিণ লেবাননের সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রামে ‘নির্দিষ্ট এবং সীমিত’ স্থল অভিযান শুরু করেছে সেনারা। ব্লু লাইনের কাছে অবস্থিত হিজবুল্লাহর এই অবকাঠামোগুলো ইসরাইলী শহরগুলোর জন্য তাৎক্ষণিক হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আল জাজিরা, রয়টার্স, এপি।
এর আগে গত সোমবার রাতে লেবাননে স্থল হামলার অনুমোদন দেয় দখলদার ইসরাইলর নিরাপত্তা পরিষদ। ওই সময় জানানো হয়, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরবর্তী ধাপের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। লেবাননে স্থল হামলার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার আগে দেশটির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক বিমান ও কামান হামলা চালায় ইসরাইলী বাহিনী।
ওই সময় ধারণা করা হচ্ছিল, স্থল সেনাদের লেবাননে প্রবেশের ব্যবস্থা করতে এমন তীব্র হামলা চালানো হচ্ছে। ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনী বিবৃতিতে দাবি করেছে, এই স্থল হামলা হবে ‘সীমিত, স্থানীয় এবং হিজবুল্লাহর নির্দিষ্ট অবস্থান’ লক্ষ্য করে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, দখলদার ইসরাইলের নিরাপত্তা পরিষদ লেবাননে সীমিত এবং স্বল্পমেয়াদি স্থল হামলার অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া ইসরাইলী সেনাদের উত্তর লেবানন দখল করার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে সংবাদমাধ্যমটিতে দাবি করা হয়েছে। লেবাননে ইসরাইলের নতুন স্থল অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন নর্দান অ্যারোস’। ইসরাইলী বাহিনী জানিয়েছে, হামলাটি চালানো হচ্ছে স্থল, আকাশ এবং কামান বাহিনীর সমন্বয়ে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, স্থল হামলার আগে ইসরাইল সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক কামান হামলা চালিয়েছে যেন হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা তাদের অবস্থান থেকে সরে যান এবং তারা সেসব অবকাঠামো ধ্বংস করে দিতে পারে। তবে যদি হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাহলে ইসরাইলের এই ‘সীমিত’ স্থল অভিযান ধরে রাখা কষ্ট হবে। ইসরাইল যদি লেবাননে শক্ত অবস্থান গড়তে চায় তাহলে তাদের আরও সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
সীমান্ত থেকে সরে গেলো লেবাননের সেনারা
এপি, রয়টার্স: দখলদার ইসরাইলের সম্ভাব্য স্থল হামলার শঙ্কার মধ্যে ইসরাইল-লেবানন সীমান্ত থেকে সরে গেছে লেবাননের সেনারা। গত সোমবার রাতে লেবাননের সেনারা সরে যেতে শুরু করেন। এরফলে এখন সীমান্ত পাহারায় শুধুমাত্র হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা থাকবে। লেবাননের সেনাবাহিনী এবং হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা সম্পূর্ণ আলাদা। দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের। এতে যুক্ত হচ্ছে না লেবাননের সরকারি সেনারা।
লেবানের নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, তাদের সেনাদের সীমান্ত থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর এ কর্মকর্তার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি তথ্যের সত্যতাও নিশ্চিত করেননি। আবার এ তথ্য অস্বীকারও করেননি। রয়টার্সকে মার্কিন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ইসরাইলী সেনারা যেভাবে সীমান্তে অবস্থান নিয়েছে; তাতে ধারণা করা হচ্ছে লেবাননে তারা খুবই অল্প সময়ের মধ্যে স্থল হামলা চালাবে।
ইসরাইলী সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, দখলদার ইসরাইলের নিরাপত্তা পরিষদ হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ‘পরবর্তী ধাপের’ অনুমোদন দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এরমাধ্যমে মূলত লেবাননে স্থল হামলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে হিজবুল্লাহর উপপ্রধান শেখ নাঈম কাসেম গতকাল সোমবার জানান, ইসরাইলের স্থল হামলা এবং দখলদার সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তারা প্রস্তুত আছেন। যদিও গত ১০ দিনে সিরিজ হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহকে অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছে ইসরাইল। এই মুহূর্তে ইসরাইল স্থল হামলা চালালে হিজবুল্লাহ কতটা সফল পাবে সেটি স্পষ্ট নয়।
মোসাদ সদরদপ্তরে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা : লেবাননের প্রতিরোধ গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারা ইসরাইলের গিলত সামরিক ঘাঁটি ও তেলআবিবের নিকটবর্তী মোসাদ সদরদপ্তরে হামলা চালিয়েছে। ফাদি-৪ রকেট ব্যবহার করে এই হামলা চালানো হয়। ইসরাইল জানিয়েছে, লেবানন থেকে তেলআবিবে আছড়ে পড়া রকেটের আঘাতে বেশ কয়েকজন বসতিস্থাপনকারী আহত হয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকে এটা হিজবুল্লাহর চালানো অন্যতম বড় হামলা বলেই দাবি করা হচ্ছে। হিজবুল্লাহ এর আগে জানিয়েছিল, তারা লেবাননে ইসরাইলের মারাত্মক হামলার প্রতিশোধ নিতে অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূখ-ের উত্তর অংশে আর্টিলারি এবং রকেট হামলায় ইসরাইলী সেনাদের সমাবেশকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত পৃথক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ বলেছে, শত্রু সেনাদের জমায়েত লক্ষ্য করে তারা মেতুল্লা, আভিভিম এবং রোশ পিনা বসতিতেও হামলা চালিয়েছে। হিজবুল্লাহ ফালাক-২ রকেট দিয়ে ডোভিভ ব্যারাক এবং রকেটের ঝাঁক দিয়ে রোশ পিনা বসতির কাছে ইসরাইলী বাহিনীর জমায়েতকেও লক্ষ্য করে।
তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা : ১ অক্টোবর, লেবাননের ইরানপন্থি সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ‘খায়বার’ নামের একাধিক অভিযানের অংশ হিসেবে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরাইলে হামলা চালিয়েছে।
গত মঙ্গলবার সকালে সংগঠনটি জানায়, ‘ও নাসরাল্লাহ! আমরা তোমার সেবায় আছি স্লোগান দিয়ে ইসরাইলী গোয়েন্দা ইউনিট ৮২০০ এবং গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের তেল আবিবের উপকণ্ঠে অবস্থিত গিলট ঘাঁটিতে একাধিক ‘ফাদি-৪’ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ফিলিস্তিন বিষয়ক সংবাদমাধ্যম প্যালেস্টাইন ক্রনিকল এ খবর জানিয়েছে। ইসরাইলের চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, তেল আবিবে রকেটের টুকরো পড়ে কমপক্ষে দুই ইসরাইলী নাগরিক মাঝারি আঘাত পেয়েছে। এছাড়া, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা আকাশে বাধাপ্রাপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরো তেল আবিবের উত্তরে রাস্তায় পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসরাইলি দমকল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তেল আবিবের উত্তরে কফার সাবার কাছে একটি রকেট পড়লে আগুন ধরে যায়। ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম কেএএন জানিয়েছে, লেবানন থেকে বৃহত্তর তেল আবিব এলাকার দিকে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরাইলী সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, মোট ১০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লেবানন থেকে তেল আবিবের দিকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
ইসরাইলী সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, হিজবুল্লাহর রকেট হামলার কারণে লক্ষাধিক ইসরাইলী নাগরিক বোমা আশ্রয়ে গেছে। ইসরাইলী বাহিনী বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত ও বাধা দেওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে।
গত মঙ্গলবার ভোরে ইসরাইলী বাহিনী দক্ষিণ লেবাননে একযোগে সামরিক অভিযান শুরু করে। এই অভিযানের লক্ষ্যবস্তু ছিল সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি গ্রাম। লেবাননের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ইসরাইলী আক্রমণের ফলে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি : গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরাইলের হামলা শুরুর পর থেকে হিজবুল্লাহ সরাসরি এই যুদ্ধে অংশ নিলেও সীমিতভাবে জড়িত ছিল। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ইসরাইল কয়েক দশক ধরে লেবাননের অংশবিশেষ দখল করে রেখেছে এবং ২০০০ সালে হিজবুল্লাহর নেতৃত্বে লেবাননের প্রতিরোধের মুখে দেশটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। ২০০৬ সালে পুনরায় লেবানন দখলের চেষ্টা করলেও ইসরাইল ব্যর্থ হয়, যা লেবাননের জন্য একটি বড় বিজয় হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে ইসরাইল এখনও শেবা ফার্মসসহ লেবাননের কিছু অংশ দখল করে রেখেছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। হিজবুল্লাহ অঙ্গীকার করেছে, ইসরাইলের দখল করা প্রতিটি ইঞ্চি ভূমি পুনরুদ্ধার করা হবে।