চাঁদাবাজদের খুঁটির জোর কোথায়?
অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন
চাঁদাবাজি এক ভয়ংকর আতঙ্কের নাম। একটি মারাত্মক অপরাধ। এ অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঠিক ঘুষের মতোই। নীরবে নিভৃতে চলছে চাঁদাবাজি। তবু প্রতিরোধ সেভাবে করা যাচ্ছে না। সরকার পরিবর্তন হলেও চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না। কারণ শুধুমাত্র চেহারার পরিবর্তন হয়। আগে চাঁদা নিত যদু। আর এখন নেয় মধু। অর্থাৎ যার নাম ভাজা চাল, তার নাম মুড়ি। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদ পতন হওয়ার পরও ষড়যন্ত্র থামেনি। জুডিশিয়ারি ক্যু এবং আনসার দিয়ে ক্যু করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ছাত্রজনতা তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। এখন চাঁদাবাজি, ওষুধ শিল্প ও পোশাক শিল্পকারখানার পরিবেশ নষ্ট করার ষড়যন্ত্র চলছে। এগুলো শক্ত হাতে দমন করতে না পারলে দেশীয় পোশাক শিল্প ধ্বংসের দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যারা পোশাক শিল্পের পরিবেশ নষ্ট করছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। আওয়ামী সরকারের শাসনামলে যারা চাঁদাবাজি করতো তারাই এখন বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। আবার কোথাও কোথাও বিএনপির নেতা কর্মীরাও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ার খবর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। তবে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগের কথা বলেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ‘‘তিনি বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকার কঠোরভাবে চাঁদাবাজি দমন করবে। চাঁদাবাজি বন্ধ হলে মূল্যস্ফীতি আরও কমবে। তিনি আরও বলেন চাঁদাবাজি বন্ধের বিষয়টি শুধু অর্থনৈতিক নয়, এর সঙ্গে বাণিজ্যও সম্পর্কিত। এর সঙ্গে আরও জড়িত রাজনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। বাজারব্যবস্থায় চাঁদাবাজি বন্ধ না হয়ে শুধু মুখবদল হয়েছে।’’ (সূত্র : ৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো)
রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি আবার আগের রূপে ফিরে এসেছে। মুদির দোকান থেকে শুরু করে চায়ের দোকান, রাস্তার পাশে তরকারি দোকান, ভ্যানগাড়ির দোকান, ফুটপাতের দোকান, নতুন ভবন নির্মাণ, অটো রিকসায়, লেগুনা গাড়িতে, বাসে, ট্রাকে, সিএনজিতে, ময়লার গাড়িতে, বালু উত্তোলনে, যে কোন বাজারে, গামেন্টস কারখানায় চাঁদাবাজি চলে। চাঁদাবাজি চলে না কোন জায়গায় তা আমার জানা নেই। এর বাইরেও চাঁদাবাজি হয়, যা আমরা জানি না। সব সেক্টর থেকে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হলে সবার আগে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্র উদ্যোগ নিলে চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব। ফুটপাতের চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য সরকার কার্ড পদ্ধতি চালু করতে পারে। যে কেউ ইচ্ছে করলেই যেন ফুটপাতে বসতে না পারে। যাদের কার্ড থাকবে কেবল মাত্র তারাই ফুটপাতে বসতে পারবে। এর বাইরে কেউ যেন ফুটপাতে বসতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যেন যে কেউ এসে চাঁদা দাবি না করতে পারে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় ফুটপাতের ব্যবসায়ীদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট দিনে বসার ব্যবস্থা করে দেয়া। দেশের মানুষ দুইভাবে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। প্রথমত কিছু মানুষকে সরাসরি চাঁদা দিতে হয়। দ্বিতীয়ত পণ্য-পরিবহন ও পরিবহন খাতে চাঁদা দিতে হয়। ব্যবসায়ীরা চাঁদা দেয়াকে ব্যবসার খরচ হিসেবে মেনে নিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কোন পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে আসে না। ভোক্তা পর্যায়ে আসতে হলে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে আসতে হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী, স্থানীয় মজুতদার, খুচরা বাজার, পাইকারি বাজার, পাইকারী ব্যবসায়ী, কেন্দ্রীয় বাজার, প্রক্রিয়াজাতকারী ও আড়তদার পর্যন্ত আসতে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা ভাগ ভাটোয়ারা হয়। কারা কারা এখান থেকে ভাগিদার হয় তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর পরই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পেত্মাতারা চাঁদাবাজি শুরু করেছে। কখনো নিজেরা করছে, কখনো বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে করছে। বিএনপিকে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করতে হবে। যদি বিএনপি চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারে তাহলে তার খেসারত বিএনপিকেও দিতে হবে।
ক্ষমতার পট পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে পরিবহন খাতে রাতারাতি পরির্বতন হয়ে গেছে। আগে যারা চাঁদাবাজি করতো তারা অনেকে এখন বিএনপির নেতা সেজে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সারা দেশে পরিবহন খাত থেকে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়। প্রতিটি বাস-ট্রাক থেকে প্রতিদিন ৭০ টাকা তোলা হয়, গেটপাস বা জিপি কিংবা সমিতির সদস্য ফি বাবদ দৈনিক, মাসিক ও এককালীন আরও বিপুল টাকা চাঁদা তোলা হয়। পরিবহন খাতে তিন পদ্ধতিতে চাঁদা তোলা হয়। এক. দৈনিক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদা; দুই. বাস-মিনিবাস নির্দিষ্ট পথে নামানোর জন্য মালিক সমিতির চাঁদা এবং তিন. রাজধানী ও এর আশপাশে কোম্পানির অধীনে বাস চালাতে দৈনিক ওয়েবিল বা গেটপাস (জিপি) চাঁদা। পরিবহন খাতে ব্যক্তিরা শ্রমিক সংগঠনের নামে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা চাঁদা তোলেন। অথচ এই খাতের সাধারণ শ্রমিকেরা মানবেতর জীবন যাপন করে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন এতদিন সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য শাজাহান খান এর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সম্প্রতি আইনশৃংখলা বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে। সড়কে শাজাহান খানের চাঁদাবাজি পকেটে ৬ হাজার কোটি টাকা শিরোনামে ৭ আগস্ট দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন এর ছত্রছায়ায় গত ৪ বছরে বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়েছে। শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান সড়কে চাঁদাবাজিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ২৪৯ শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হতো এবং একটি বড় অংশ শাজাহান খানের পকেটে যেত। শাজাহান খানের নির্বাচনী হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ সালে শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। যা ২০২৪ সালে হয়েছে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ সময়ে তার আয় প্রায় ৩২ গুণ বেড়েছে। এককথায় পরিবহন খাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজির নেতৃত্বে ছিলেন শাজাহান খান। ফেডারেশনের সবকিছুই শাজাহান খানের ইশারায় চলত। ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিবহন সেক্টরে ১২ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন শাজাহান খান (সূত্র: ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ যুগান্তর)। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সড়কের সকল চাঁদাবাজির মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন সকল চাঁদাবাজদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা, যেন পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা ও বাড়তি ভাড়ার নৈরাজ্য বন্ধ হয়।
ছাত্রজনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনকালে চাঁদাবাজির হাত থেকে জনগণ নিষ্কৃতি পাবেন এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু কিছু এলাকায় চাঁদাবাজি এখনো বন্ধ হচ্ছে না। সম্প্রতি চট্টগ্রামের চাক্তাই খাতুনগঞ্জ বাজারের চাঁদাবাজির খবর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়েছে। বাজারের ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ। প্রতি ট্রাক ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি নেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী সরকারের শাসনামলে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা চাঁদা তোলত। এখন তাদেরই একটি অংশ বিএনপির নেতা সেজে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছে। চাঁদা না দিলে চালক হেলপারদের মারধর ও হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজির কারণে বড় বিপদে আছেন। (যুগান্তর ৩১ আগস্ট ২০২৪) প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সর্বস্তরের শাস্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়েনি। জমি কেনা, বাড়ি নির্মাণ কিংবা ব্যবসা করতে গেলে ও চাঁদা গুণতে হয় । চাঁদা না দিলে মারধরের শিকার হতে হয়। ঢাকা শহরে হরহামেশাই চাঁদাবাজি হচ্ছে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা মামলা করছে না। কেন করছে না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অথচ চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর আইন রয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন ২০০২ এর ধারা ২ (খ) (অ)১ আইনে সুনির্দিষ্টভাবে চাঁদাবাজিকে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হইতে চাঁদা, সাহায্য বা অন্য কোন নামে অর্থ বা মালামাল দাবী আদায় বা অর্জন করা বা অন্য কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা আদায় করা বা আদায়ের চেষ্টা করলে তা হবে আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তির কথা ৪ ধারায় বলা আছে যে, যদি কোন ব্যক্তি উক্ত অপরাধ করে তাহলে সে সর্বনিম্ন ২ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি হয় পলাতক ও কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে। চাঁদাবাজদের তালিকায় ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মীদের নাম যখনই আসে তখন সংগঠন থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়। জিরো টলারেন্সের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যমান কোন প্রতিফলন দেখা যায় না। ইদানিং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে দেশের কোথাও কোথাও একটি চক্র চাঁদাবাজি শুরু করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চাঁদা না দিলে ফেসবুকে বিষোদগার ও মামলায় ফাঁসির দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। ভয় দেখিয়ে টাকা চাইছে। যারা টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করছে, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ভুয়া আইডি থেকে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের সকল সিটি করপোশেন, বাজার, মার্কেট, হকার বা অন্য কোনো বাণিজ্যিক এলাকায় যে বা যারা চাঁদাবাজি করে তাদের বিরুদ্ধে নিকটস্থ সেনা ক্যাম্পে কিংবা থানায় অভিযোগ দায়ের করার জন্য সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা কর্মীদের চাঁদাবাজি বন্ধে এলাকা ভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া ও গোপন হেল্প নাম্বার চালু করা-যেন সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারে। সরকার অতি দ্রুত চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।