মঙ্গলবার ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Online Edition

বিপ্লব প্রতিবিপ্লব ও রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গে

ড. মো. নূরুল আমিন

ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী ও খুনী হাসিনার পতন ও পলায়নের পর প্রায় এক মাস পার হয়েছে। নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণেরও তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, দেশের সামগ্রিক অবস্থার কি উন্নতি হয়েছে? দেশ কি হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাহুমুক্ত? আমরা কি প্রতিবিপ্লবের শংকামুক্ত হতে পেরেছি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা দরকার।

দু’দিন আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত জনাব মাইলামের একটি মন্তব্য আমাকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি বলেছেন, গত ৩৪ বছরে বাংলাদেশ তিন তিনবার নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হচ্ছে দেশটি ঠিক একই অবস্থা ও অবস্থানে আগে এক ইঞ্চিও এগোতে পারেনি। বাংলাদেশের উপর তার নিবিড় পর্যবেক্ষণ আমাকে বিমোহিত করেছে। তিনি বলেছেন, তিনবার, আমি বলি দেশকে একটি গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য গত ৫৩ বছরে আমরা পাঁচবার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আমাদের অযোগ্যতা ও লোভ-লালসা, প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যবাদ ও ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার জন্য আধিপত্যবাদী শক্তির তাঁবেদারী ও ক্ষমতালিপ্সা প্রভৃতি দায়ী। এটা এদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা দেশ গড়ার প্রথম সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থা,  বিচার ব্যবস্থা, আইন পরিষদ, নির্বাচন ব্যবস্থা বিশে^র উন্নত ও গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্রসমূহের আদলে নতুনভাবে তৈরি করে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়ার একটা সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম। এ ক্ষেত্রে আমরা আমাদের স্বাধীন সত্তাকে ব্যবহার করিনি। ভারতীয় নির্দেশনায় ভারতীয় সংবিধানের মৌলনীতিকে অনুসরণ করে একটি সংবিধান আমরা যেমন তৈরি করেছি তেমনি ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীতের লেখক কবি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতাকেও আমরা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বানিয়েছি। ৯২% মুসলমানের দেশে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো। একটি গণতন্ত্রী দেশের পরিবর্তে আমরা দেশের নাম দিয়েছি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। অর্থাৎ আমরা সবাই প্রজা। রাজা কে? শাসকরা। এরই প্রতিফলন হয়েছে শাসনতন্ত্রের চতুর্থ সংশোধনী এনে শেখ মুজিবুর রহমানকে আজীবন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা এবং একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা ও সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা। রক্ষীবাহিনী গঠন ও তাদের দিয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, ব্যাপক লুটপাটের রাজত্ব কায়েম, পাট শিল্পসহ দেশের শিল্প কারখানা সমূহের ধ্বংস সাধন এবং দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে  পরিণতকরণ। এর অপরিহার্য পরিণতি হিসেবে সপরিবারে সামরিক ক্যুতে শেখ মুজিবের হত্যা এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের পলায়ন ও গ্রেফতার এর ফলে দেশ গড়া ও দেশ সংস্কারের দ্বিতীয় সুযোগ আসে। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এই সুযোগ অব্যাহত থাকে। ধর্মীয় রাজনৈতিক সুযোগসহ গণতান্ত্রিক কাঠামো ফিরে আসে। কিন্তু অশুভ শক্তির তৎপরতায় ১৯৮১ জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যার মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে। জেনারেল জিয়া খালকাটা কর্মসূচি, সবুজ বিপ্লব ও উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষায় যুব সমাজকে সম্পৃক্তকরণ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে পররাষ্ট্র নীতি পুনর্গঠন এবং গ্যারান্টি ক্লজসহ ফারাক্কার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সাথে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে অনন্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন এবং তার প্রবর্তিত স্বনির্ভর কর্মসূচি ও গ্রাম সরকার ব্যবস্থা পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক ধারায় কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর জেনারেল এরশাদ স্বৈরশাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং তার প্রায় এক দশকের শাসনামলে দুর্নীতি দল প্রীতি, স্বৈরাচার, ব্যভিচার ফুলে ফেঁপে কয়েকশ’ গুণ বেড়ে যায়। নব্বই সালের গণঅভ্যুত্থানে তার পতন ঘটে। এ অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের সামনে দেশ গড়ার তৃতীয় সুযোগটি আসে। এই সময়ে যে দলটি নির্বাচনে সর্বোচ্চ আসন পেয়েছেন তা তাদের ক্ষমতায় যাবার জন্য যথেষ্ট ছিল না। জামায়াতে ইসলামী ঐ সময়ে এককভাবে নির্বাচন করে ১৮টি সংসদীয় আসনে জয়লাভ করে। দেশ গড়ার স্বার্থে কোনো রকম কোয়ালিশন বা ক্ষমতার অংশ না নিয়ে তারা ঐ দলটি তথা বিএনপিকে শর্তহীন সমর্থন দেয় এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসে। দুঃখজনকভাবে সত্য হলেও আমরা এরশাদবিরোধী অভ্যুত্থানের স্পিরিট রক্ষা করে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থার সংস্কার করতে পারিনি, রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি, আওয়ামী লীগ জনরায়ে ক্ষমতায় যেতে না পেরে নতুন বিএনপি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দিনই ঘোষণা করে যে, একদিনও শান্তিতে থাকতে দেব না। সংসদ বর্জন, ধ্বংসাত্মক আন্দোলন দেশকে অচল করে দেয়। দেশ গড়ার বা সংস্কার নয়, বৈধ অবৈধ আন্দোলন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, দেশপ্রেম শেখ হাসিনা ও তার দলের একচেটিয়া সম্পত্তি হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বা তারা ছাড়া আর কারুর দেশপ্রেম থাকতে পারে তারা বিশ্বাস করতে পারতেন না। তেমনিভাবে তাদের বিশ্বাস ছিল শাসন করার অধিকার একমাত্র তাদেরই, They are born to govern. এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি চলে আসে। ২২ জানুয়ারি ঐ বছর নির্বাচন হবার কথা ছিল। বিশেষ পরিস্থিতিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দুনিয়ার ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। ৪ দলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষ। মাঠ  দখলের জন্য আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে উঠেছিল। শেখ হাসিনা সারা দেশ থেকে তার নেতাকর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকা আসার নির্দেশ দেন। তারা ঢাকা আসেন এবং সমাবেশ করেন। ঐ সময় পল্টনের উত্তর গেটে জামায়াত-শিবিরের একটি গ্রুপ তাদের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সমাবেশরত ছিল। লগি-বৈঠাধারী আওয়ামী নেতাকর্মীরা তাদের উপর চড়াও হয় এবং প্রকাশ্য দিবালোকে ৬ জন জামায়াত-শিবির কর্মীকে সাপের মতো লাঠি পেটা করে হত্যা করে। সারা দুনিয়ার টেলিভিশন চ্যানেলসমূহে কোটি কোটি মানুষ তা দেখেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে, আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি প্রভৃতির প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন সেনাপ্রধান ও আরো কয়েকজন কর্মকর্তা প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং জরুরি অবস্থা জারি ও সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার দাবি জানান, প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা জারি করেন। সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ না করে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে তাদের মাধ্যমে প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারা প্রথমে ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ এ পদে আসীন হন। তিনি এর আগে যথাক্রমে বিশ^ব্যাংক ও পল্লী কর্মসংস্থান প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন, সেনা সমর্থিত এই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তারা দুই বছর ক্ষমতায় ছিলেন যদিও প্রচলিত কেয়ারটেকার সরকারের মেয়াদ হচ্ছে তিন মাস বা ৯০ দিন। তাদের আমলেই বিখ্যাত ২৮ অক্টোবরের লগি বৈঠা হত্যার মামলার তদন্ত ও চার্জশিট হয়। সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে সাবেক দুইজন প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে আওয়ামী লীগ বিএনপির মন্ত্রী এমপিসহ বহু নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের কারণ দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি, অন্যের সম্পত্তি দখল, জ্ঞাত আয়ের বেশি অর্থ সম্পদের মালিকানা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐ সময়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয় এবং ৪টি মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ ও শুনানি শেষ পর্যায়ে ছিল। এগুলোতে ১৪০০০ কোটি টাকার দুর্নীতি জড়িত ছিল। আর্মি সমর্থিত এই সরকার ৪টি খাতে সংস্কার আনার লক্ষ্যে ব্যাপক কাজ করেছিলেন। এই খাতগুলো হচ্ছে : (১) নির্বাচন কমিশন (২) আইন শৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট এজেন্সিসমূহ (৩) বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও প্রশাসন (৪) বিচার বিভাগ।

তারা দু’বছর কাজ করে যাবার আগে দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল তথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছ থেকে তাদের গৃহীত পদক্ষেপ ও সংস্কারগুলো অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তাদের প্রত্যেকটি কাজের তাৎক্ষণিক অনুমোদন দেন, কিন্তু বেগম জিয়া পার্লামেন্টে পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া তাৎক্ষণিক অনুমোদন দিতে অস্বীকার করেন এবং জেনারেল মঈনসহ সামরিক কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়েন। ফলে সামরিক বাহিনী ও প্রতিবেশী দেশের সহযোগিতা ও দি ইকনমিষ্টের রিপোর্ট অনুযায়ী বস্তা বস্তা ভারতীয় অর্থের বলে শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় এসে তিনি প্রতিশ্রুতি সংস্কারের কথাই শুধু ভুলে যাননি, নিজের এবং দলের বিরুদ্ধে আনীত মামলাসমূহ, বিচারকৃত মামলার শাস্তি ও জরিমানাও মওকুফ করে দেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অর্থলোপাট, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিকদের হত্যা-গুম, স্বেচ্ছাচারিতা, একনায়কতন্ত্র তাকে আরো বেপরোয়া করে তোলে এবং দেশ বসবাসের অনুপযোগী ও অপরাধীদের আখড়ায় পরিণত হয়। তিনি হয়ে উঠেন Crime Boss-এ। এই অবস্থায় ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান ও বিপ্লব ঘটে এবং ৫ আগস্ট তার পতন ও পলায়নের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্যের পুনরোদয় ঘটে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সব রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনী এবং ছাত্র জনতার সমর্থনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। তারা এমন এক সময় দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন যখন আমাদের সরকার ব্যবস্থার প্রত্যেকটি খাত ধ্বংস প্রায়, ব্যাংকগুলো ফতুর। দেশ এবং দেশের ১৮ কোটি মানুষ একদিকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার দেশী বিদেশী ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত অন্যদিকে এখনো আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নেত্রীর ঘরে নগদ শত শত কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। ২৫ লক্ষাধিক কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।

আমি কয়েকটি প্রশ্ন দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজ নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছেও এমন কোনও আলাদীনের প্রদীপ নেই যে, তারা রাতারাতি একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনবেন। আমরা অনেকে আওয়ামী লীগকে চিনতে ভুল করি। আওয়ামী লীগের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্ষমতায় থাকলেও তারা দেশের মানুষের জন্য বিপদ ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বিপদ। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে পালিয়েছেন, কোথায় গেছেন? ভারতে। ভারত তার এবং তাদের Mentor এবং Creator ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি নিজেই বলেছেন, তাদের যা দিয়েছি তারা চিরদিন তা মনে রাখবে। সমুদ্র বন্দর, নদী বন্দর, সড়ক ও রেল ট্রানজিট এমন কোনও সুযোগ নেই যা তাদের দেয়া হয়নি। ভারত কি তার প্রতিদান তাকে দেবে না? আরেকটি কথা, আওয়ামী লীগের জাল সারা দেশে বিস্তৃত। জনবল, অর্থবল, অস্ত্রবল তিনটাতেই তারা বলিয়ান। এক সাথে তাদের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী পার্লামেন্টের সকল সদস্য, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলার, জেলা-উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সবাই পালিয়েছেন, পুলিশ বাহিনীর লোকেরাও পালিয়ে এখন কিছু আবার ফিরে এসেছে। দুনিয়ার ইতিহাসে এটা বিরল। কিন্তু তাই বলে তাদের তিনটি বল বা শক্তির একটিও কি নষ্ট হয়েছে? গত কয়েকটি দিনে প্রধানমন্ত্রীসহ তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা হয়েছে। এগুলো সংহত করে তদন্ত শেষে বিচার পর্যায়ে নিতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। ঐ পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত তারা দুর্বল হবে? প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী তাদের প্রত্যেকটি বাড়িতে এক একটি ব্যাঙ্কের ভল্টে রক্ষিত টাকারও বেশি টাকা আছে। এতে হাত দেয়া হয়নি। সরকার যদি এক হাজার টাকার সেই অচল (Demonetization) ঘোষণা করেন এবং নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে তা জমা দেয়ার ঘোষণা দেন তাহলে তারা আর্থিক দিক থেকে অনেক দুর্বল হয়ে পড়বে। ব্লক রেইড নয়, সারা দেশে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র‌্যাব দিয়ে অস্ত্র তল্লাশি করে অস্ত্র উদ্ধার করা জরুরি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২৮ অক্টোবরের মামলা ও প্রত্যাহৃত ১১টি মামলা পুনরুজ্জীবন এবং তার মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে রুজুকৃত কিছু মামলার মেরিটের ভিত্তিতে নিশ্চিত সাক্ষ্য-প্রমাণসহ দ্রুতবিচার আদালতে বিচার করে শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলে অনেকে নৈতিক বল হারিয়ে ফেলবে এবং প্রতিবিপ্লবের স্বপ্ন হারিয়ে ফেলবে। শেখ হাসিনা ও অন্যান্য যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের দেশে এনে বিচার করা দরকার। এটা করতে হলে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা দরকার। তাকে সেখানে রাখা হলে ভারত তাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখবে এবং প্রতিবিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করবে। এটা হবে সরকার ও জনগণের জন্য একটা বিরাট হুমকি।

এখন রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে আসি। সরকার, জনগণ, ছাত্রসমাজ, রাজনৈতিক দলসমূহ তথা দেশের আপামর জনতা এই সংস্কার চান। নতুন সরকার এই কাজ শুরু করেছেন। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার যে চারটি ক্ষেত্রে যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো এনেছিলেন সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংযোজন-বিয়োজন করে একটা সিদ্ধান্তে হয়ত পৌঁছা যেতে পারে। এই সময়ে পুলিশ প্রশাসন বলুন, বেসামরিক ব্যুরোক্রেসি বা জুডিশিয়ারি সকল ক্ষেত্রে সংস্কারের পাশাপাশি অযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ণ দলীয় ব্যক্তিদের অপসারণ করে যোগ্য, সৎ ও নিরপেক্ষ লোকদের পদায়নই সবচেয়ে বেশি দরকার। জেনারেল মইনের সরকার সিটিজেন চার্টার ও তথ্য অধিকার আইন করেছিলেন সেগুলোর নির্মোহ ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টিও নিশ্চিত করা যেতে পারে।

আরেকটি কথা। রাষ্ট্র সংস্কারের সাথে ব্যক্তির চরিত্র সংস্কারের প্রশ্নটি জড়িত। ব্যক্তি সৎ হলে পরিবার ও সমাজ নিষ্কলঙ্ক হবে। এর সাথে ঈমানের সম্পর্ক, আল্লাহর প্রতি জবাবদিহিতা আখিরাতের ভয় প্রভৃতি জড়িত আছে। এসব ক্ষেত্রে যদি কিছু করা না হয় তাহলে সকল প্রচেষ্টাই ভেস্তে যেতে বাধ্য। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকেন তাদের দায়িত্ব অনেক। এ ব্যাপারে সূরা হজ্জের ৪১ নং আয়াতটির উদ্ধৃতি দেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। এতে বলা হয়েছে : ‘আল্লাজিনা ইন মাক্কান্নাহুম ফিল আরদে আকামুস সালাতা ওয়া আতুজ জাকাতা, ওয়া আমারু বিল মারুফ ওয়ানাহাও আনিল মুনকার ওয়া লিল্লাহে আকেবাতুল উমুরে।’ অর্থাৎ (এরা হলো তারা) যাদের আমরা জমিনে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে, ভালো কাজের আদেশ করবে, মন্দ কাজ করতে নিষেধ করবে। আর সব ধরনের পরিণাম তো আল্লাহ দায়িত্বে।’ রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামীকিকরণ জরুরি বলে আমি মনে করি। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রযন্ত্রে সৎ, ধার্মিক ও যোগ্যদের পদায়ন বাঞ্চনীয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ

string(11) "18.97.14.81"