সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন : আইনি এবং নৈতিক বিশ্লেষণ
প্রফেসর ড. এবিএম. মাহবুবুল ইসলাম
২০০৫ সালে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ পাক ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিঃ বনাম বাংলাদেশ সরকার নামক কেসের রায়ে ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক ঘোষিত সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেছেন ২০১০ সালে সুপ্রীম কোর্টের রায়ে এবং ২০১১। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেক্যুলারইজমকে প্রতিষ্ঠা করে। অতএব, এদিকে এর ফলে সংবিধানে কি কি পরিবর্তন আসবে তাও বলে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, সুপ্রীম কোর্ট এ রায়টিকে স্থগিত ঘোষণা করলেও তা বাতিল করেনি। নতুন করে Leave to Appeal এর আবেদনপত্র দাখিল করার অনুমতি দেয়া হয় বিএনপির তখনকার সেক্রেটারি জেনারেল খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে। সরকার এ রায় মেনে নিয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে এ্যাপিল করবে না বলে জানিয়েছেন। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ অপরাপর সমমনা দলগুলো বলছে এ রায় কার্যকরী হলে দেশ আবার একদলীয় শাসনে ফিরে যাবে এবং ৪র্থ সংশোধনীর ভিত্তিতে এবং সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহসহ অপরাপর ইসলামী প্রভিশনগুলোও উঠে যাবে। এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রীসহ অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বলছেন এতে করে কোন একদলীয় শাসনেও যাবে না, বিসমিল্লাহও উঠে যাবে না। তবে সংবিধানের ১৯৭২ সালে ঘোষিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি পুনর্জীবিত হবে। এ নিয়ে চলছিল ব্যাপক কথাবার্তা। একজন আইনের শিক্ষক এবং সর্বোপরি সচেতন নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ের আইনগত ও রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে কিছু কথা বলা জরুরী মনে করছি।
৫ম সংশোধনী বাতিল আদেশের প্রেক্ষাপট : মূলত: উপরে বর্ণিত কেসটি ছিল ঢাকাস্থ ওয়াইজঘাটে মুন সিনেমা হল নামক একটি সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলা নিয়ে। মূল সিনেমা হলটি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) ছিল অবাঙালি কর্তৃক পরিচালিত একটি পাক ইতালিয়ান কোম্পানির সম্পত্তি। ১৯৭২ সালে একে abandoned property হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইতোপূর্বে ১৯৭১ সালে এটি কোম্পানির হাতছাড়া হয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ভুক্ত হয়। কোম্পানি তা ফিরে পাওয়ার জন্য আবেদন করলে বলা হয় যে, সম্পত্তিটি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে দেয়া হয়ে গিয়েছে। ১৯৭৫ সালে কোম্পানি সরকারি সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রীট (Writ) করে এবং আদালত কোম্পানির পক্ষে রায় ঘোষণা করে। তবে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সম্পত্তিটি ফেরৎ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৭৭ সালে MLR VII of ১৯৭৭-এর আওতায় উক্ত সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের দখলেই থাকে। পুনরায় কোম্পানি সম্পত্তিটি পাওয়ার জন্য আবেদন করলে আদালত বলে যে, এ বিষয়ে তাদের করার কিছু নেই, তবে যেহেতু MLR VII of ১৯৭৭-এর মাধ্যমে এ সম্পত্তি দেয়া হয়েছে এবং ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে MLR VII of ১৯৭৭ কে প্রটেকশন দেয়া হয়েছে এ ক্ষেত্রে ৫ম সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। এ প্রেক্ষিতে মূলত: কেসটি দায়ের করা হয়। হাইকোর্টের বিচারপতি এবিএম. খায়রুল হক এবং এটিএম ফজলে কবির সমন্বয়ে গঠিত আদালত ৫ম সংশোধনী বাতিলের রায়টি প্রদান করেন। এর Writ Petition No হচ্ছে 6016 of 2000। ২৪২ পৃষ্ঠা রায়টি প্রকাশিত হয়েছে Bangladesh Law Times (BLT) ২০০৬ এর Special সংখ্যায়।
ঐতিহাসিক এ রায়ে বলা হয় যে, সামরিক আইন বা সামরিক শাসন বলতে কোন আইন বা শাসন ব্যবস্থার কথা সংবিধানে নেই। অতএব, জিয়াউর রহমান কর্তৃক ঘোষিত সামরিক শাসন এবং ১৯৭৭ সালে প্রণীত এবং সংবিধানে সংযোজিত ৫ম সংশোধনীর প্রায় সবগুলো বিষয় বাতিল। সংবিধানবহির্ভূত যেকোন সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এ রায়ের ফলে পাক ইটালিয়ান মার্বেল কোং-এর সম্পত্তি ফিরে পায়। যদিও এ কেসের মূল বিষয়বস্তু ছিল সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয় কিন্তু হাইকোর্ট ৫ম সংশোধনীর বিষয়েও রায় প্রদান করে। এ রায়ে ১৯৭২ সালে প্রণীত রাষ্ট্রীয় আদর্শ পুনঃস্থাপনের কথা বলা হয়। এছাড়া সংবিধানের ৬, ৮, ১০, ২৫, ৩৮ ও ১৪২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিষয়েও সিদ্ধান্ত দেয়া হয় যে, এসব অনুচ্ছেদের সংশোধন অবৈধ এবং তা এর মূল অবস্থায় ফিরে যাবে। উল্লেখ্য, পাক ইটালিয়ানের পক্ষে তম্বা ৫ম সংশোধনী বাতিলের পক্ষে কৌশলীর কাজ করেন আজমল কিউসি এর ল’ ফার্ম।
এ রায়ের প্রভাব আল্লাহর প্রতি আস্থা এর বিলুপ্তি : ১৯৭২ সালে সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শই এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।” ৫ম সংশোধনীতে বলা হয় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ... সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।” তবে উল্লেখিত রায়ের ফলে সংবিধান ১৯৭২ সালের প্রস্তাবনায় ফিরে গেছে ১৫শ’ সংশোধনীর মাধ্যমে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতিপূর্ণ আস্থা এবং সমাজতন্ত্র অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ ... এসব আর থাকলো না সংবিধানে।
২. বাংলাদেশী নয় বাঙালি : ৭২-এর সংবিধানের ৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “বাংলাদেশের নাগরিকগন বাংগালী বলিয়া পরিচিত হইবেন।” পঞ্চম সংশোধীতে বলা হয়েছে যে, “বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।” ২০০৫ সালে হাইকোর্টের রায়ের ফলে বাংলাদেশীগণকে পুনরায় বাংগালী বলে পরিচিতি লাভ করছে।
৩. আল্লাহর প্রতিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থাকলো না : সংবিধানের ৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার এই নীতিসমূহ ... রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া গণ্য হইবে।” ৫ম সংশোধনীতে বলা হয়েছে: সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার ... রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। ... আইন ২ প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন... আইনের ব্যাখ্যা দানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে...। ৫ম সংশোধনী বাতিলের ফলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আর থাকছে না, এর স্থান লাভ করবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Seculaism)।
৪. বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুনঃজীবন : ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্ত্বা বিশিষ্ট যে বাংগালী জাতি... বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাংগালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিগণ সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহ দান করিবেন এবং এ সকল প্রতিষ্ঠানসমূহে কৃষক শ্রমিক ও মহিলাদের যথাসম্ভব বিশেষ প্রতিনিধি দেওয়া হইবে।” ৫ম সংশোধনী বিলুপ্তির ফলে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ আর থাকবে না উপরন্তু বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের স্থলে বাংগালী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন হবে।
৫. জাতীয় জীবনে মহিলাদের অংশ গ্রহণ বিলুপ্তী : ১৯৭২ সালের সংবিধানে বলা হয়েছে “মানুষের উপর মানুষের শোষন হইতে মুক্ত ও ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।” ১৯৭৭ সালের ৫ম সংশোধনীতে বলা হয়েছে যে, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। ৫ম সংশোধনী বাতিলের ফলে মুক্ত, ন্যায়নুগ ও সাম্যবাদী (বা কম্যুনিস্ট) সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ফিরে যাবে যদিও সমাজতন্ত্র এখন একটা ব্যর্থ জনস্বার্থহীন মতবাদ। উল্লেখ্য, (CEDW) ১৯৪৯ অনুমোদনের মাধ্যমে নারীর উদ্যম স্বাধীনতার পথ প্রশস্থ করে দিয়েছে যার পরিণতি ভয়াবহ।
৬. ইসলামী ও ধর্মভিত্তিক দলসমূহের বিলুপ্তি সাধন : ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদটি ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। অনুচ্ছেদটি ছিল: ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার। কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা উহার উপর নিপীড়িত বিলোপ করা হইবে।” এ অনুচ্ছেদের আলোকে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী ও পিডিপিসহ সকল ইসলামী দলকে অবৈধ ঘোষণা করেন শেখ মুজিব সরকার এবং ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহেরও নাম পরিবর্তন করা হয় যেমন কবি নজরুল ইসলাম কলেজের স্থলে কবি নজরুল কলেজ নামকরণ করা হয়। ৫ম সংশোধনী বাতিলের ফলে ১২নং অনুচ্ছেদটি পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ইসলামী নামের সকল দল ও সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান আপনা-আপনিই বাতিল হয়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য, ২০২৪-এর ১ জুলাই জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় এবং মাত্র পাঁচ দিন পর শেখ হাসিনার পতন ঘটে।
৭. মুসলিম দেশসমূহের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ : ৫ম সংশোধনীতে ২৫ অনুচ্ছেদের সাথে একটি অংশ সংযোগ করা হয়। তাহলো, “(২৫)(২) অনুচ্ছেদের আলোকে রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।” তবে হাইকোর্টের রায় এ অংশটিকেও বাতিল বলে ঘোষণা করে। অতএব, ৫ম সংশোধনী বাতিল কার্যকর হলে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের স্থলে সমাজতান্ত্রিক বা সেক্যুলার বিশ্বের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির সাংবধিানিক কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না। বৃহত্তর এ মুসলিম দেশ পুনরায় চলে যাবে ইসলামের বিপক্ষ শক্তিধর রাষ্ট্র সমূহের নিয়ন্ত্রণে। হয়েছেও তাই। উল্লেখ্য, হাসিনা সরকার মুসলিম বিশে^র সাথে সম্পর্ক রাখলেও তা আইনগতভাবে নয়, বরং প্রথাগত এবং প্রয়োজনের তাগিদেই তা করেছে।
৮. ধর্মীয় ভাবধারায় ধারা বা ধর্মের নামে কোন সংগঠন বা সমিতি করা যাবে না : ১৯৭২ সালে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের প্রথমাংশে প্রতিটি নাগরিকের শর্ত সাপেক্ষে দল গঠনের অধিকার দিয়েছে। শর্তটি হচ্ছে উক্ত দলটিকে ধর্মীয় দর্শনের আলোকে হওয়া যাবে না। যেমন: “জনশৃংখলা ও নৈতিকতার স্বার্থে ... সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।” “তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষানুযায়ী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দশ্যে সম্পন্ন বা লক্ষানুযায়ী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্ম ভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠণ করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবেনা।” এই অনুচ্ছেদ শুধু ধর্মীয় নাম নয় বরং ধর্মীয় দর্শন বা ধর্মীয় বিধান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত যে কোন রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক যে কোন দল বা সমিতি গঠন এবং এর সদস্য হওয়ার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। ১৯৭৭ সালে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে এ অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তটি বিলুপ্ত করা হয়। ৫ম সংশোধনী বাতিলের রায়ে শর্তটি পুনঃ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আর বাধা থাকবে না। অর্থাৎ ধর্মীয় দর্শন ভিত্তিক কোন দল আর থাকবেনা দেশে।
১৯৭২ এর এ বিধানটি গণতন্ত্র বিরোধী ও বটে। গণতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন মত ও সংগঠনের স্বাধীনতা থাকা গণতন্ত্রেরই মত। অথচ এ গণতান্ত্রিক বৈশিষ্টই বিলীন হয়ে যাবে এ রায়ের মাধ্যমে। তবে যেটুকু এখন বজায় আছে বা বা ছিল তা হাসিনার দয়ার বদৌলতে সাংবিধানিকভাবে নয়।
৯. রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তনে গণভোটের বাধ্যবাধকতার বিলুপ্তি : ৫ম সংশোধনীতে বলা হয়েছিল সংবিধানের ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০ বা ৯২-ক অনুচ্ছেদের সংশোধন আনিত হলে তা রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করার ৭ দিনের মধ্যে তিনি তাতে সম্মতি দেবেন কি দেবেন না- বিষয়টি গণভোটে প্রেরণের ব্যবস্থা করা হবে। ৫ম সংশোধনী বাতিল আদেশের ফলে গণভোটের আর প্রয়োজন থাকলো না অর্থাৎ সরকার যেকোন সময় যেকোনভাবে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে বিসমিল্লাহ, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, অর্থনৈতক ও সামাজিক সুবিচারের লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে গণভোটে ছাড়াই বিলুপ্ত করতে পারবেন। এ বিলুপ্তিতে জনগণের শক্তি ও ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে। তত্ত্বগতভাবে জনগণ এ বিষয়গুলোতে তাদের মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ পেত কিন্তু তা আর বহাল রইল না।
১০. বিসমিল্লাহ এবং বাকশালী শাসন এর অবস্থান : হাইকোর্টের রায়ে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রণীত প্রস্তাবনাকে (Preamble) অবৈধ করেছে যা শুরু হয়েছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দ্বারা। বিসমিল্লাহ যেহেতু প্রস্তাবনারই অংশ তা যেহেতু ৫ম সংশোধনী দ্বারা সংযোজিত, অতএব, বিসমিল্লাহও বাতিল আদেশেরই অংশই হতে পারে। উল্লেখ্য, ইসলামী সকল ব্যবস্থা বাতিল করে ৭২ সালের ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি যার সবগুলোই ইসলাম পরিপন্থী- তা পুনঃস্থাপন করে একে বিসমিল্লহ বা আল্লাহর নাম দিয়ে শুরু করার কোন প্রয়োজনও নেই আর তা করার অর্থ হবে আল্লাহর আইন বিরোধী দর্শনকে আল্লাহর নামে শুরু করারই শামীলÑ আর এটা হবে আল্লাহর সাথে তামাশা করার মত বিষয়! (চলবে)