বন্যার এই দুঃসময়ে কেন সচিবালয় অবরোধ
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নতুন আশাবাদ। তবে গণআকাংখা পূরণে কথামালা নয়, প্রয়োজন কর্মউদ্যোগ। সেই কাজ করতে গিয়ে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেন যে, সবকিছুই নতুন করে শুরু করতে হবে। তবে সব কর্ম তারা সম্পাদন করে যেতে পারবেন না। গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কিছু কাজ হয়তো তারা শুরু করতে পারবেন, রোডম্যাপ তৈরি করতে পারবেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে নির্বাচিত সরকারকেই। ফলে বলা চলে, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নতির পাশাপাশি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা বর্তমান সরকারের জন্য প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা জানি, গণঅভ্যুত্থানের পর ভঙ্গুর প্রশাসনিক কাঠামোর নিয়ে দেশে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠার কাজ খুবই কঠিন। সরকার যখন এই কাজটি শুরু করেছে, তখনই দেশে নেমে আসলো এক ভয়াবহ বন্যা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব কামরুল হাসান বলেছেন, বন্যায় দেশের ১১ জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯ পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫২ লাখ মানুষ। কোনো কোনো এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, আবার অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে অন্য এলাকায়। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য এবার চ্যালেঞ্জটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারকে হটাতে ছাত্র-জনতা যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছিলো, বন্যার্তদের পাশেও ঠিক সেভাবে এসে দাঁড়িয়েছে পুরো দেশ। ধর্ম, বর্ণ ও রাজনৈতিক মতামতের ঊর্ধ্বে উঠে সবাই আজ একতাবদ্ধ জাতির এই সংকটকালে। সরকারের পাশাপাশি সব নাগরিক আজ স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সামর্থ অনুযায়ী বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে যে ত্যাগ-তিতীক্ষা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছে, তাতে পুরো জাতি আজ অনুপ্রাণিত। সবাই মিলে দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে চায়। সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি সরাসরি মাঠে থেকে ত্রাণ সংগ্রহ, বিতরণ ও উদ্ধার অভিযানে যুক্ত হয়েছেন ছাত্র-জনতা। অভিজ্ঞতা না থাকলেও তরুণরা তীব্র ¯্রােতের মধ্যে জীবনবাজি রেখে পানি ঠেলে উদ্ধার করে আনছেন বন্যা দুর্গতদের। এমন এক তরুণের নাম সাইফুল ইসলাম। এই নির্মাণ শ্রমিক ফেনীতে বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার করতে গিয়ে পানির ¯্রােতে ভেসে যান, জীবন হারান। বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের জন্য প্রতিটি এলাকায় দল বেঁধে গণত্রাণ সংগ্রহ করছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ত্রাণতৎপরতা তো জাতির মধ্যে সৃষ্টি করেছে এক নতুন উদ্দীপনা। তাদের টিএসসি’র ত্রাণভান্ডারে দিনে-রাতে নাগরিকরা আস্থার সাথে দিয়ে যাচ্ছেন অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী। ইতিমধ্যে তারা ৪৪ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
এক বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার। এই দায়িত্ব যে অনেক কঠিন, সেটা এখন সাধারণ নাগরিকও বোঝেন। গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে দেশের সবকিছু ভেঙ্গে পড়েছে। নতুন নির্মাণে এই সরকার মাত্র দুই সপ্তাহ কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। তবে ইতিমধ্যে নানা মহল থেকে কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছে, দাবি-দাওয়ারও কোনো অন্ত নেই। ফলে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। ২৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছেন, ছাত্র-জনতা আমাদের নিয়োগকর্তা, তারা যখন বলবেন চলে যাব, নির্বাচন কমিশন সংস্কার করা হবে, গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা থাকবে, লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়া ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফেরানো হবে, উপদেষ্টারা সম্পদের হিসাব দেবেন, পর্যায়ক্রমে কর্মচারীরাও দেবেন; পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে পারস্পরিক আস্থা, অন্যায় হুকুম মানবে না দেশরক্ষা বাহিনী, আদালতে আসামির ওপর হামলার প্রবণতা থেকে বের হতে হবে, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে, ঘেরাও না করে লিখিত দাবি জানানÑআমাদের কাজ করতে দিন, শেখ হাসিনা সব ধ্বংস করে গেছেন। এই ছিল প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের মূল বিষয়গুলো। ড. ইউনূসের বক্তব্যগুলো আমাদের কাছে সঙ্গত বলেই মনে হয়েছে। যে কাজগুলোর কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, সেগুলো আসলে ছাত্র-জনতার দাবি। জাতি এই কাজগুলোর বাস্তবায়ন চায়। তবে এজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে হবে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, মাত্র দুই সপ্তাহের এই সরকারের কাছে বিভিন্ন মহল নানা দাবি উত্থাপন করে ঘেরাও কর্মসূচিও শুরু করে দিয়েছে। রাজধানী ঢাকা যেন এখন দাবির শহরে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই নিত্যনতুন দাবি নিয়ে রাস্তায় নামছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। চাকরি জাতীয়করণ, স্থায়ীকরণ, পুনর্বহাল, পরীক্ষাপদ্ধতি সংস্কারসহ নানা দাবিতে প্রেস ক্লাব ও সচিবালয়ের সামনের রাস্তাগুলো যেন পরিণত হয়েছে দাবি আদায়ের মঞ্চ। লে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যান চলাচল। অবস্থান কর্মসূচিও বিক্ষোভ সমাবেশ করতে দেখা গেছে বাংলাদেশ আনসার, হেলথ ভলান্টিয়ার, শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষক সমিতিসহ নানা প্রতিস্ঠানকে। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এতদিন তারা কোনো দাবি জানায়নি। এখন সুযোগ পেয়ে যে যার মতো রাস্তা বন্ধ করে দাবি জানাচ্ছে, এটা বাড়াবাড়ি।
তবে শুধু বাড়াবাড়ি নয়, সীমালঙ্ঘন করেছে আনসার সদস্যরা। চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত আনসাররা শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।ঠ তাদের হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহসহ প্রায় ৪০ জন ছাত্র আহত হন। আনসাররা দিনভর অবরুদ্ধ করে রাখে সচিবালয়, আর রাতে জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে। অবশ্য ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, আনসারদের অনেক দাবি মেনে নেওয়া হয় এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বাকি দাবিগুলোর বিষয়ে ধৈর্য ধরার এবং যৌক্তিক সমাধানের আশ^াস দেওয়া হয়। কিন্তু একটি গোষ্ঠী এসব আলোচনা মানতে চাচ্ছিল না। তাদের কথা ও কাজের ধরনে প্রকাশ পাচ্ছিল, তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আনসারের ছদ্মবেশে যারা এসেছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিশৃঙ্খলা করা। এদিকে সচিবালয় অবরুদ্ধ করে ভাঙচুর ও হামলার মামলায় গ্রেফতার ৩৯০ আনসার সদস্যকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের কাজ আদালত অবশ্যই করবেন, তবে ছাত্র-জনতাকেও থাকতে হবে সজাগ। কছাত্রও-জনতার ঐতিহাসিক এই গণঅভ্যুত্থানের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই পৌঁছতে হবে। অপশক্তির ষড়যন্ত্রকে যে কোনো মূল্যে আমাদের ব্যর্থ করে দিতে হবে।