মঙ্গলবার ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Online Edition

বিভেদ সৃষ্টি করবেন না

জাফর আহমাদ

ইসলাম একতা ও অখন্ডতাকে অধিক পছন্দ করে। অনৈক্য ঈমানের পরিপন্থি। কারণ ইসলামের প্রতিটি ইবাদাতই মানুষের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করে। দৈনন্দিনের প্রতিটি ইবাদাত ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে একেকটি বিশেষ কর্মসূচী। ইসলাম বলে ‘মানুষের প্রতি রহম তথা সহানুভূূতিশীল হও, তাহলে আকাশের মালিকও দয়া করবেন। তাওহীদ, নামায, যাকাত, রোযা ও হজ্বের প্রতি গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বুঝা যায় যে, প্রতিটি ইবাদাত মানুষের সামগ্রিক জীবনকে ইসলামের ধাঁচে গঠনে সুনিপুণভাবে সাহায্য করে থাকে। মানুষকে দানশীল, উদার হৃদয়, সহানুভূতিশীল, মানব-দরদী ও পারস্পরিক কল্যাণকামী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এই ইবাদাতগুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করে। ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ কায়েমে এই ইবাদাতগুলোর মতো ভালো ও অধিক কার্যকরী কোন বিকল্প খোঁজে পাওয়া যাবে না। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এ সত্যটি থেকে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

পৃথিবীর প্রথম মহামানব হযরত আদম (আঃ) থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত ইসলাম যে জিনিসটির প্রয়োজনীয়তাকে তীব্রাকারে উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করেছে সেটি হলো, ঐক্য বা ‘বুনিয়ানুম মারসুস’। আর এ বুনিয়ানুম মারসুস বা ঐক্য গড়ার জন্য আল্লাহ তা’আলা মানুষকে প্রথমেই যে শিক্ষা দিয়েছেন তা হলোঃ সুন্দর ভাষায় ও ভালো কথার মাধ্যমে মানুষকে ডাকো। সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম তাদের মিশনকে এগিয়ে নেয়ার সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবীদার ছিল ‘তাঁদের সুন্দর আচরণ, যাকে আল কুরআন ‘শুহাদা আ’লান নাস’ বা বাস্তব সাক্ষ্য হিসেবে অভিহিত করেছে। ইসলামে ভালো কথা ও ভালো আচরণের গুরুত্ব কতটুকু তা নিমোক্ত আয়াতগুলো থেকে সহজেই অনুমেয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি দাউদের রাষ্ট্রক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে দিয়েছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা আর সর্বোত্তম বাগ্মিতার শক্তি বা অকাট্য কথা বলার যোগ্যতা।”(সূরা সোয়াদ: ২০) হযরত মূসা ও হারুনকে (আঃ) ফিরাউনের কাছে প্রেরণের প্রাক্কালে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “তোমরা দু’জন যাও ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে। আর তার সাথে কোমলভাবে কথা বলবে, যাতে করে সে উপদেশ গ্রহণ করে, কিংবা ভীত হয়ে যায়।”(সূরা ত্বাহা: ৪৩-৪৪)

শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “এটা আল্লাহ তা’আলারই দয়া যে, তুমি তাদের প্রতি ছিলে কোমল প্রকৃতির। তা না হয়ে যদি তুমি তাদের প্রতি কঠোর হতে, তাহলে তারা তোমার নিকট থেকে সরে যেত।” (আলে ইমরান: ১৫৯) “তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর ভাষায় আহ্বান করো।” (নাহল ঃ ১২৫) “যারা তোমার অনুসরণ করে সে সকল বিশ্বাসীদের প্রতি বিনয়ী হও।” (শুয়ারা ঃ ২১৫) রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মু’মিনদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “তখন আল্লাহ তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাঁদের জন্যে ন্যায় ও বিবেকসম্মত বা তাক্ওয়ার কথা বলা কর্তব্য করে দিলেন, আর তাঁরাই এ ধরনের কথা বলার অধিক উপযুক্ত।” (ফাতাহ: ২৬)

ঈমান আনার পরই মু’মিনদেরকে সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাকে করা হয়েছে হারাম। ঐক্যের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছেঃ “তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সকলে দলবদ্ধ বা জামায়াতবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধভাবে শক্ত করে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (আলে ইমরান ঃ ১০৩) তাছাড়া এ আয়াতের শেষের দিকে ইসলাম নামক নিয়ামতের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আল্লাহ নিশ্চিত ধ্বংসের কবল থেকে উদ্ধারের কথা বলেছেনঃ “আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো। তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তার অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো। (তোমাদের অবস্থা এমনটি হয়েছিল যে) তোমরা একটি অগ্নিকুন্ডের কিনারে দাঁড়িয়েছিলে। আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়েছেন। এভাবে আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলেন। হয়ত এ নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা পথ দেখতে পাবে।” (আলে ইমরান ঃ ১০৩)

এ আয়াতের আলোকে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার নামান্তর। ঐক্য বিনষ্ট হয় এ ধরনের বিচ্ছিন্নতার কথা যারা বলে বেড়ায় এবং বিশৃংখলা সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন দল, উপদলে বিভক্ত হয়, তারা অবশ্যই অনৈসলামিক কাজ করছেন। এর ফলে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয় এবং সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। আর বিপর্যয় সৃষ্টি করা তো শয়তানের কাজ। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “হে মুহাম্মদ, আমার বান্দাদেরকে বলো, তারা যেন মুখ হতে সে সব কথাই বের করে যা অতি উত্তম। আসলে শয়তানই মানুষের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে থাকে। প্রকৃত কথা হলো, শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।”(বনী ইসরাঈল ঃ ৫৩) 

এমনকি ধর্মীয় লেবাসে ফরয-ওয়াযিব ও হালাল-হারামের বাইরে গিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করাও কুরআন-হাদীস সমর্থন করে না। অর্থাৎ ফরয ও ওয়াজিব ও হালাল হারামের বাইরে নফল-মুস্তাহাবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হওয়া বা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা দু:খজনক। অত্যন্ত দরদী মন নিয়ে নিজের সহীহ বুঝটুকু অন্যকে বুঝানোর চেষ্টা করুন। এতে শয়তানের সুযোগ গ্রহণের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ শয়তান কখনো ফরয ওয়াজিব নিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করে না। উপরে উল্লেখিত ত্বাহা: ৪৩-৪৪, নাহল ঃ ১২৫, শুয়ারা ঃ ২১৫, ফাতাহ: ২৬ ও বনী ইসরাঈল ঃ ৫৩ আয়াতগুলোতে লক্ষ্য করেছেন মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে এই পথ নির্দেশনাই দিয়েছেন। একটি কথা আমাদেরকে খুব ভালো করে মনে রাখতে হবে, তা হলো, এমন কোন কথা বলবেন না বা এমন কোন কাজ করবেন না, যে কথা ও কাজের রেশ ধরে শয়তানের পথ সৃষ্টি হয় অথবা শয়তান প্রবেশ করার পথ সুগম হয়। 

সুতরাং বিভেদ সৃষ্টি করবেন না, বিভেদ সৃষ্টি হয় এমন ধরনের কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকুন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ

string(11) "18.97.14.81"