সমাজ জিজ্ঞাসায় আল মাহমুদের কবিতা
ড. ফজলুল হক তুহিন
একজন মানুষ সমাজে জন্মায়, বেড়ে ওঠে এবং সমাজেই মৃত্যুবরণ করে। জীবনের প্রতিটি স্তরের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। সমাজে বসবাস করার কারণে সমাজ সম্পর্কে একটা চেতনা প্রত্যেক মানুষের মাঝে বিরাজমান। ধনিক অথবা দরিদ্র যে শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত হোক, প্রত্যেকেরই সমাজ সম্পর্কে একটা দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই থাকে এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মানুষের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ গঠিত ও কর্মধারা পরিচালিত হয়। প্রাকৃতিক ও সামাজিক নানা ঘটনা মানুষের মনে অহরহ যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং সেগুলোর যে অভিব্যক্তি ঘটে তার মধ্যেও এই দৃষ্টিভঙ্গি স্বাভাবিকভাবে প্রতিফলিত হয়। একজন কবি অন্য দশজন মানুষের মতো সামাজিক সত্তার অধিকারী। সমকালীন জীবনপ্রবাহ, সমাজ ও পরিপার্শ্বে কবিও বেড়ে ওঠে। সমাজের একজন সদস্য হিসেবে কবির সৃষ্টিপ্রেরণার জায়গা অনেক সময় সমাজ হয়ে থাকে। আত্মপ্রকাশের ফলে কবির সৃষ্টিকার্যের সঙ্গে সমাজের পরিচয় ঘটে। পারস্পরিক এই সম্পর্কের কারণে কবিতা অর্জন করে মৌল ভিত্তি। বাহিরের জগতের সাথে কবি মনের সংযোগ এবং কবিতায় সেই জগতের প্রতিফলন কবিতাকে একটা নিগূঢ় ঐক্যসূত্রে নিয়ে আসে। ফলে ব্যক্তিসত্তা ও সমাজসত্তার সম্মিলনে কবিতা অর্জন করে তার প্রার্থিত সমগ্রতা।
আল মাহমুদ কাব্যচর্চার প্রথম থেকেই সমাজচেতন কবি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’-এ বোদলেয়ারীয় আত্মসংকট ও আত্মমুক্তির মাঝে সমাজচেতনার অনুষঙ্গ বর্তমান। অন্যদিকে সম্পূর্ণ অনুভবলোক অনেক সময় নির্মিত হয়েছে সমাজকে কেন্দ্র করে। ভাষা আন্দোলনোত্তর সময়ে কবিদের হাতে তীক্ষè বক্তব্য প্রধান ও তাৎক্ষণিক অনুভূতিজাত কবিতা সৃষ্টি হতে থাকে। মূলত সমাজ-রাজনীতির উত্তাল ঢেউয়ের কারণে শিল্পের বদলে শ্লোগান প্রাধান্য পেয়েছে। তবে ১৯৫৮-তে সামরিক শাসন জারি হলে মধ্যবিত্ত মানসিকতার কবিরা পলায়নী ও নেপথ্যচারী চরিত্রে পরিণত হয়। তাদের বক্তব্য প্রতীকী ও পরোক্ষ হয়ে ওঠে। আল মাহমুদের কাব্যযাত্রার শুরু হয়েছে স্বদেশের সমাজ ও সময়ের অস্থির ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। তাঁর ‘লোক লোকান্তর’-এ আত্মদ্বৈরথ, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈরাশ্য, নিঃসঙ্গতা, ক্ষোভ, ক্রোধ, বেদনা, আর্তি প্রভৃতি জীবনের নেতিবাচক বিষয়গুলোর সমাবেশ ঘটেছে। জীবিকার সন্ধানে কবি গ্রাম থেকে এখন শহরবাসী। কাকের মতো অনেক চেষ্টা ও ঘোরাঘুরি করেও কোথাও জীবনের কোনো আশ্রয়, বাঁচার নির্ভরতা ও উৎস খুঁজে পাননি। ‘জীবিকাবিজয়ী’ তাঁর প্রাণ এমন এক চরম তৃষ্ণার্ত সময়ের উত্তপ্ত প্রকৃতিতে বাঁচার জন্যে আর এগিয়ে যেতে সাহসী হয় না। অথচ ‘মায়ের দেহের মতো’ চিরকালের চিরচেনা শহরে জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার পাথেয়- ‘কুম্ভভরা জল’ খুঁজে পাননি। তাই কবির ক্ষুব্ধ ও হতাশাপূর্ণ সিদ্ধান্ত:
জীবিকাবিজয়ী দেহে কোন ঘরে দাঁড়াবোরে আজ
কাকের ধূর্ততা নিয়ে ফিরেছি তো এখানে ওখানে
খুঁজেছি জলের কণা থর থর ধুলোর তুফানে
এখন বুঝেছি মানেÑ এও এক নারকী সমাজ;
জলসত্র নেই কারো এই শেষে মেনে নিলো মন,
ধুলোকে এড়িয়ে আর কারো ঘরে যাবো না এখন।
[“তৃষ্ণার ঋতুতে”, লোক লোকান্তর]
তৃষ্ণার্ত সময়ে যখন জীবন বিপন্ন, তখন কবির মনে হয়েছে সমাজ ‘নারকী’। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় নিঃসঙ্গ একজন কবি কোথাও বাঁচার পরিবেশ না পেয়ে কঠোর এই সত্যে পৌঁছেছেন। বাইরে যেমন জীবন বাঁচে না, ঘরেও তেমনি কোনো নির্ভরতা নেই, আছে শুধু ‘অশ্রুজল’ আর ‘আত্মহত্যা’র প্ররোচণা। অন্ধকারময় চরাচরের মাঝে তার লোকালয়কে মনে হয় ‘নির্বান্ধব প্রকোষ্ঠের কারা’। গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন ও শহরে ‘ভয়ানক একা’ কবি প্রিয়তমাকে পর্যন্ত নিরুৎসাহিত করেন আপন ঘরে আসতে। কেননা এই সমাজে জীবনের সজীবতার প্রতীক চালের লতানো ফুল মরে যায় ‘বৃষ্টির অভাবে’:
কেন যে আসতে চাও, এ যে বড় ভয়ানক দিন
চালের লতানো ফুল মরে যাবে বৃষ্টির অভাবে
দুঃখের চৌকাঠ ভেঙে যদি আসো, দাঁড়াবে কীভাবে?
এখানে যৌবন দ্যাখো কাঁটা-ঘাসে, এমন মলিন।
বাতাসে বিশ্বাস নেই, আঙিনার ধবল পাথরে
আগুন ঠিক্রে ওঠে, বুঝি এ-ই দুঃসহ দোজখ।
[“বৃষ্টির অভাবে”, লোক লোকান্তর]
এমনই এক পরিপার্শ্বে কবি বসবাস করেন যে, সেখানে আগামী প্রজন্মকে স্বাগত জানাতেও তার মাঝে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করে। ‘নির্জল নির্দয় দেশে’ সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় কবি উদ্বিগ্ন। আসলে কবি ষাটের দশকের সামাজিক অবস্থাকে নরকের সাথে এবং নিজের ঘরকে কারাগারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। জীবন অভিজ্ঞতা দুর্বহ, রূঢ় বাস্তবতায় অতিবাহিত হওয়ার প্রেক্ষিত থেকেই তাঁর কবিতায় সমাজচেতনা কালো রঙে বিম্বিত। বিরূপ সময়ে বিরূপ সমাজের ধুলোময় পথে হেঁটে কবি জীবনকে দেখেছেন বিপন্নÑ এ ক্ষেত্রে কবি এলিয়টের The Waste Land কবিতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বন্ধ্যাভূমির রূপকল্পে তাঁর জগতকে দেখেছেন। যে পৃথিবী রুক্ষ-কঠিন ক্যাকটাসে আবৃত, অনেক দিন বৃষ্টির কোনো চিহ্ন সেখানে নেই। সেজন্যেই নিজের সমাজকে নরক মনে হয়েছে বারবার।
‘কালের কলস’ কাব্যে আল মাহমুদ সময়-জর্জর ও সমাজ-আক্রান্ত নেপথ্যচারী সত্তার খোলস ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসেন স্বজাতি ও স্বদেশের সামাজিক পটভূমিকায়। কবি যে সমাজে বাস করেন তা ক্ষয়িঞ্চু সামন্ত-উপনিবেশবাদী সমাজ; যেখানে কেবলই ধনতান্ত্রিক নগর সভ্যতার রুক্ষ মূর্তি নিজের শরীরের ছায়াপাত ঘটাতে চায়; সেখানে কবির দৃষ্টি কোথাও সুখের সামান্য আভাসও দেখে না। পৃথিবীব্যাপী ধনতান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের চেহারা এবং স্বদেশে আইয়ুবী শাসনের বিরূপ অবস্থায় কবি ডান ও বাম উভয় দিকের রাস্তাকেই ভয়ঙ্কর বলে মনে করেন।
(চলবে)