শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪
Online Edition

জীবনঘুড়ির আকাশ দেখা

সাজজাদ হোসাইন খান

অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে আমাদের দালান। দূর-কাছের এলাকা। আরামবাগ ফকিরাপুল। টপাটপ জ্বলছে বাতি। সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা খাম্বার মাথায় মাথায়। প্রতি সন্ধ্যার এমন দৃশ্য। ছবি। ঝুলে থাকা আগুন। অপেক্ষায় থাকি কখন জ্বলবে আগুন বাতি। সেই আগুনের চারপাশটায় রাজ্যের পোকা। উড়াল পোকা। এসব আবার কেমন পোকা? ভয় নাই ডর নাই। ওরা বুঝি আগুন পছন্দ পোকা। আলোকে ভালোবাসে। তাই জ¦লজ¦লে বাতির চারপাশটায় ঘুরঘুর। সকাল এলেই চম্পট। সন্ধ্যার শরীর থেকে ঝরছে কুয়াশা। বাতাসে বরফকুঁচি। এই যখন সময়, শুরু হয় রাতের পড়া। হররোজ। সামনে পরীক্ষা, ফাইনাল। তাই মনোযোগ একটু অন্যরকম। রাতের পেটে ঢুকে যাই। বিশেষ করে বছর পরীক্ষা যখন ঘাড়ে বসে ঠ্যাং দোলায়। আব্বা বললেন এতো রাত জাগার কি দরকার। এখন শুধু চোখ বুলাও। পরীক্ষার আর কদিন। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়লো আমার। মগজে তখন ঠা-া বাতাস তিরতির। সহি সালামতে শেষ হলো পরীক্ষা ফাইনাল। নবম শ্রেণীর। ঊনিশশ চৌষট্টি তখন যাই যাই। কদিন বাদেই উঠবে নতুন সুরুজ। নতুন বছরের।

অলস সময়। অলস দুপুর। দিনগুলো বড় বড় লাগে। হাঁটে তো হাঁটে না। সূর্য যেন বসেই থাকে। চোখে ধাউ ধাউ আগুন। এক সময় সেই আগুনে পানকৌড়ি উড়ে। স্কুল নাই। পড়া নাই। লেখা নাই। বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো বসে আছে চুপচাপ। চুপ থাকলেই কী চুপ থাকা যায়? মনে হয় কি যেনো নাই, নাই। মগজের অলিতে গলিতে গল্প-কবিতা। ইতিহাস ভূগোল। বই ভর্তি টেবিল, তাকিয়ে আছে। সড়কের শেষ মাথায় এসে দাঁড়িয়ে গেলো সময়। নবম থেকে দশম কতটাই বা দূর। লীনু এসে হাজির একদিন বিকালে। জানালো আগামীকাল রেজাল্ট হবে। তৈরি থাকিস আসবো সকালে। প্রায় দিনই একসাথে স্কুলে যাই। পীরজঙ্গি মাজার থেকে। তারপর বাস একদৌড়ে শহীদ মিনার-মেডিকেল। মেডিকেল পৌঁছলেই তো নবকুমার। হাঁটাপথে বড়জোড় দশ মিনিট। বুকটা কেমন ধরফর করে উঠলো। কি জানি কেমন হয় রেজাল্ট। মনের ময়দানে ভয় আর সাহস হাঁটছে কাঁধে হাত রেখে। ডাব্বা মারবো না সেই ভরসা আছে। ভালো মন্দের তো একটা ব্যাপার থাকেই।

স্কুলে পৌঁছে দেখি হালীম আর মুহিবুর দাঁড়িয়ে গেইটে। ঠোঁট থেকে ঝরছে কামিনী। নববকুমার দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁয়। সাদা ধবধবে। ক্লাসগুলো নীরব নীরব। ফাইনালের রেজালট বলে কথা। কাঁপছে চোখের তারা-শরীর মন। কি জানি ভাগ্যে কি জোটে। শীতের সকালেও ঘাম চিকচিক। কপালে নাকের ডগায়। অনেকেরই। আমরা চারজন চোখে চোখ রেখে বসে আছি। ভয়েরা কাছে ঘেঁঁষতে সাহস পাচ্ছে না। এমনটাই মনে হলো। সময় যাচ্ছে টিকটিক। একঝাঁক শীতের বাতাস হুড়মুড় করে এসে ঢুকলো ক্লাসে। তখনই স্যারও এসে হাজির। হাতে একগাদা রেজাল্ট সিট। আন্দাজ করলাম। ওগুলো তাই হবে। অবাক করা ব্যাপার হাতে বেত নেই।  অন্য সময় যেমনটা দেখি। ফল প্রকাশ হবে আজ। বেত  নেই কেন? হালীম ইশারা করলো আমাকে। জিজ্ঞাসার নজর। স্যারের ঠোঁটে হালকা  হাসির টান।  আওয়াজ নাই শব্দ নাই। স্যারই আওয়াজ করলেন শেষে।  তোমরা কেমন আছো। একসাথে বলে উঠলো সবাই। ভালো স্যার। হ্যাঁ! ভালো থাকারই দিন আজ। নবম থেকে দশম শ্রেণীতে উঠে যাবে একটু পরেই। কি আনন্দ। কি মজা তাই না?  স্যারা ক্লাস জুড়ে যেনো খুশির ঝুনঝুনি। তারপর একটু দম নিলেন। নড়েচড়ে বসে সারা ক্লাসে ঘুরিয়ে আনলেন নজর। এদিকে ঠান্ডা বাতাস নামছে কানের লতি বেয়ে। স্যারের চেহারায় সবার চোখ। সেখানে আনন্দের জবা দুলছে। রেজাল্টের কাগজগুলো খুলতে খুলতে জানালেন ভয়ের কোনো কারণ নাই। কেউ ফেল করোনি। সবাই পাস। খুশির খবর না? কি বলো। ক্লাসসুদ্ধ লাফিয়ে উঠলাম আমরা। খুশিতে আনন্দে। নাম ডাকছেন স্যার। আর হাতে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন কাগজ। রেজাল্ট সিট। ততক্ষণে থিতিয়ে আসছে বুকের ধরফরানি। খুশির দাপাদাপি ক্লাসসুদ্ধ। মনমতো ফল। খুশির উঠান থৈ থৈ। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম চার বন্ধু। ক্লাসের ইতি ঘটলো নবম শ্রেণীর। একটু বাদেই ঘণ্টা ইলিয়াসের। ছুটির ঘণ্টা।

 বাইরে শীতের ডানা  ঝাপটানি। দুইটা কুকুর শুয়ে আছে স্কুল গেইটের ধার ঘেঁষে। রিকসা যাচ্ছে টুং টাং। এখানে সেখানে জটলা। রেজাল্ট নিয়ে আলোচনা সমালোচনা। কোন জটলায় আনন্দের তবলা। কোনটায় চুয়ে চুয়ে নামছে বেদনার ঠা-া পানি। নীরব নিঃশব্দ। ফল প্রকাশের পর যেমনটা হয়। আমরা হাঁটছি আলীয়া মাদরাসা নিশানা করে। উমেশ দত্ত লেনের  শেষ মাথায় মাদরাসা। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম ঢুকবো ক্যাফে কাশে। এখন তো রেজাল্টের আসমানে জোসনা ফকফক। আড্ডা চলতেই পারে। বাতাসে উড়ছে টক মিষ্টি গন্ধ। নবকুমারের লাগোয়া দালানে ওরিয়েন্ট রুটির কারখানা। সেই রুটির গন্ধেই মৌ মৌ করে তামাম স্কুল। ধারে কাছের অলিগলি। গন্ধ নাকেমুখে মাখতে মাখতে পৌঁছলাম ক্যাফে কাশে। পেছনে আলীয়া মাদরাসা। সামনে হোসনী দালান-নিমতলি। বরাবরের মতো চা-সিংগারা। সিরকাভেজা সিংগারার মজাই আলাদা। অন্য কিসিমের। হালীম উশখুশ করছে। লীনুও উঠি উঠি। কি আর করা, ক্যাফে কাশের আড্ডার মাথায় বাড়ি। শেষমেষ উঠতেই হলো। চা গিলতে গিলতেই ঠিক হলো জাদুঘরের সিঁড়িতে পা রাখবো। সিরাজউদদৌলা-ঈসা খাঁর সাথে মোলাকাত করব। জেনে যাবো ঘাসফড়িং বিমানের নামধাম। ঘরের খবর। কাজ রেখে পালিয়ে গেলো ওরা কারা। ভাংগা মিনার ভাংগা দালান। বিমানের লেজ ছুঁই ছুঁই। দেখলাম হালীমের ইচ্ছার কপাটে তালা। বললো জাদুঘর ফাদুঘরে যেতে মন চাইছে না। চল বাড়ি যাই। সময়তো মরে যাবে না। লীনু আর আমার পিড়াপিড়িতে হালীমের মনের তালা ঝনঝন, সড়কে। ইচ্ছার কপাটে ফাটল। 

জাদুঘরের জাদুতে ভাটার টান। সিরাজউদ্দৌলার তলোয়ার ঈসাখাঁর কামান কি যেনো বলতে চায়। সে কথা হাওয়ায় ভাসে। ধরতে গিয়েও ধরতে পারি না। চোখের মনিতে এসে ধাক্কা খায়। ঘুরতে ঘুরতে চোখের সাথে ঠেংগেরও কাহিল দশা। এদিকে সময়ের কপালেও ভাঁজ। হালীম বারবার তাকিদ দিচ্ছে। লিনু বললো চল বাড়ি ফিরতে হবে। সূর্য বসে আছে আকাশের কপালে। (চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ